ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রমবান্ধব শ্রমআইন ’১৮-এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শ্রমবান্ধব শ্রমআইন ’১৮-এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ শ্রমিকদের জন্য শ্রমবান্ধব এবং সুশৃঙ্খল মালিক-শ্রমিক পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন- ২০১৮ এর খসড়ায় নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে কারখানা-শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি কমিয়ে আনা হয়েছে। শিশুশ্রমকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভা বৈঠকে এই অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের এই অনুমোদনের কথা জানান। তিনি বলেন, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ২০০৬ সালে প্রথম এই আইনটি করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে এর অনেক বড় সংশোধন হয়। প্রায় ৯০টি ধারা সংশোধন হয়। অনেকগুলো ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান শ্রম আইনে ৩৫৪টি ধারা রয়েছে। সংশোধিত আইনে নতুন দুটি ধারা, চারটি উপধারা ও আটটি দফা সংযোজন; ছয়টি উপধারা বিলুপ্তি এবং ৪১টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আইএলও (বিশ্ব শ্রম সংস্থা) এর কনভেনশন অনুযায়ী এটাকে (শ্রম আইন) আপডেট করার জন্য অর্থাৎ শ্রমবান্ধব পলিসি সব জায়গায় যাতে নিশ্চিত হয় সেটার জন্য আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে যেখানে শাস্তি বেশি ছিল সেখানে শাস্তি কমানো হয়েছে। শাস্তিগুলো মোটামুটি অর্ধেক কমানো হয়েছে। অনেক নতুন সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে মালিক ও শ্রমিকদের অসদাচরণ বা বিধান লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদ- বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ-। আগে শাস্তি ছিল ২ বছরের কারাদ- বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ-। প্রস্তাবিত আইনে মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন অসদাচরণের বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। বল প্রয়োগ, হুমকি প্রদর্শন, কোন স্থানে আটক বা উচ্ছেদ শারীরিক আঘাত এবং পানি, বিদ্যুত, গ্যাসসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অথবা অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করে মালিককে নিষ্পত্তিনামায় দস্তখত করতে বা কোন দাবি গ্রহণ বা মেনে নিতে বাধ্য করতে চেষ্টা করতে পারবেন না শ্রমিকরা। করলে এটা অসদাচরণ হবে। কোন মালিক শ্রমিকের চাকরির চুক্তিতে ট্রেড ইউনিয়নে যোগদান নিষেধাজ্ঞা, কোন ট্রেড ইউনিয়নে এর সদস্য পদ চালু রাখার অধিকারের ওপর কোন বাধা সম্বলিত কোন শর্ত আরোপ করতে পারবেন না। মালিক এই বিধান লঙ্ঘন করলে শাস্তি পাবেন। বেআইনী ধর্মঘট ডাকার দ- আগে এক বছর ছিল, এখন ৬ মাস করা হয়েছে। জরিমানা আগের মতোই ৫ হাজার টাকা রয়েছে। কোন ব্যক্তি একই সময়ে একাধিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হলে তিনি আগে ৬ মাস কারাদ-ে দ-িত হতেন। এখন সেটা কমিয়ে এক মাস করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিকের সমর্থন হার কমছে ॥ নতুন আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সমর্থনের হার কমানো হয়েছে। বর্তমানে কোন প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে হলে মোট শ্রমিকের ৩০ শতাংশের সমর্থন প্রয়োজন হয়। এখন সেটা কমে হচ্ছে ২০ শতাংশ। ধর্মঘট ডাকার ক্ষেত্রে আগে দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিকের সমর্থন লাগত নতুন আইন অনুযায়ী সেটা ৫১ শতাংশ হচ্ছে। আইনগত ভিত্তি পাচ্ছে উৎসব ভাতা ॥ মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রস্তাবিত আইনে নতুন জিনিস উৎসব ভাতা যুক্ত করা হয়েছে। যেটা সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেয়ে থাকি। কোন কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শ্রমিকদের তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় উৎসবের প্রাক্কালে বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে উৎসব ভাতা দিতে হবে। শ্রমিকরা এতদিন উৎসব ভাতা পেলেও শ্রম আইনে এ বিষয়ে কোন বিধান ছিল না। আগের আইনে থাকা প্রধান পরিদর্শকের পদটি মহাপরিদর্শকসহ আরও কিছু পদের নামে পরিবর্তন ও নতুন কিছু পদ যুক্ত করা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ॥ প্রতিবন্ধী শ্রমিককে বিপজ্জনক যন্ত্রপাতির কাজে বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা যাবে না। আগে এক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে শিশু শ্রমিককে বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ করার বিধান ছিল। অপ্রাপ্ত বয়স্ক শব্দটি শ্রম আইন থেকে বাদ দিয়ে সেখানে কিশোর শব্দটি যোগ করা হয়েছে। আগে ১২ বছর বয়সী শিশুরা কারখানায় হালকা কাজের সুযোগ পেত। সংশোধিত আইন অনুযায়ী ১৪-১৮ বছর বয়সী কিশোররা হালকা কাজ করতে পারবে। কোন ব্যক্তি কোন শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে দ-িত হবেন বলেও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। আগের আইনে বিশ্রাম কক্ষ রাখার বিধান ছিল। এখন খাবার কক্ষও যুক্ত হয়েছে। ২৫ জনের বেশি শ্রমিক নিযুক্ত থাকেন এমন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা যাতে সঙ্গে আনা খাবার খেতে ও বিশ্রাম করতে পারেন সেজন্য উপযুক্ত খাবার কক্ষ ও বিশ্রাম রুম রাখতে হবে। আগের আইনের বাধ্যতামূলক গ্রুপ বীমা চালু করার জায়গায় বলা হয়েছে, যেখানে কেন্দ্রীয় কল্যাণ ফান্ড থাকবে, সেখানে থেকে যে শ্রমিকরা সুবিধা পাবে সেখানে আলাদা গ্রুপ বীমা করার দরকার নেই। মাতৃত্বকালীন ছুটি না দিলে শাস্তি ॥ কোন নারী শ্রমিক মালিককে নোটিস দেয়ার আগেই যদি সন্তান প্রসব করে থাকেন। তবে সন্তান প্রসবের প্রমাণ পেশ করার পরবর্তী তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রসূতি কল্যাণ সুবিধাসহ প্রসব পরবর্তী ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত অনুপস্থিত থাকার অনুমতি দেবেন মালিক। মাতৃত্বকালীন ছুটির বিকল্প হিসেবে এটি যুক্ত করা হল। কোন মালিক কোন নারী শ্রমিককে প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করলে তিনি ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে দ-িত হবেন। আগে এ ধরনের কোন শাস্তি ছিল না। তবে শর্ত থাকে যে, কোন নারী শ্রমিক প্রসূতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার নির্ধারিত তারিখের আগে গর্ভপাত ঘটলে তিনি কোন প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাবেন না। তবে স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটির প্রয়োজন হলে তা পাবেন। ছুটি ও কর্মঘণ্টা ॥ প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী শ্রমিকরা ইচ্ছা প্রকাশ করলে সিবিএ বা অংশগ্রহণকারী কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজ করে, উৎসব ছুটির সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটির যোগ করে তা ভোগ করতে পারবে। কোন শ্রমিকের কাজের সময় এমনভাবে ব্যবস্থা করতে হবে যাতে আহার ও বিশ্রামের বিরতি ছাড়া ১০ ঘণ্টার বেশি না হয়। তবে সরকার কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করলে সেটা ভিন্ন কথা। কোন শ্রমিককে উৎসব ছুটির দিনে কাজ করতে বলা যাবে না জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তবে এজন্য তাকে একদিনের বিকল্প ছুটি এবং দুদিনের ক্ষতিপূরণমূলক মজুরি দিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের সময় কমবে ॥ ট্রেড ইউনিয়নে রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে একটি পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে যেটা পরিচালক করতেন এখন সেটা করবেন মহাপরিচালক। রেজিস্ট্রেশনের দরখাস্ত পাওয়ার ৫৫ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। আগে এই সময় ছিল ৬০ দিন। তবে আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে ৩০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতে আপীল করতে পারবেন। রেজিস্ট্রেশন কাজ সম্পন্ন করার জন্য সরকার এসওপি বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর তৈরি করে দেবে। এটা নতুন যুক্ত করা হয়েছে। কোন শ্রমিক বেআইনী ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করবেন না বা চালু রাখবেন না বা এতে অংশগ্রহণের জন্য অন্য কোন ব্যক্তিকে প্ররোচিত করবেন না। এগুলো আইএলও কমিটির বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আনা হয়েছে। শ্রম আদালতগুলো মামলা দায়েরের তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে রায় দিয়ে দেবে। ৯০ দিনের মধ্যে কোনভাবে দেয়া সম্ভব না হলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে অবশ্যই রায় দিতে হবে। অর্থাৎ ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা শেষ করতে হবে। শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালকেও ৯০ দিন করে দুই দফায় ১৮০ দিনে মধ্যে অবশ্যই আপীল শেষ করতে হবে। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী সংশোধিত আইনে মালিক, শ্রমিক ও সরকার মিলে একটি ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ গঠন করতে পারবে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, শ্রমিকরা কর্মরত অবস্থায় মারা গেলে এক লাখ টাকার বদলে দুই লাখ টাকা এবং স্থায়ীভাবে অক্ষম হলে সোয়া এক লাখ টাকা পরিবর্তে আড়াই লাখ টাকা পাবেন। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী শ্রমিক সংগঠনগুলো বিদেশ থেকে চাঁদা গ্রহণ করলে সরকারকে জানাতে হবে। এই শ্রম আইন ইপিজেড এলাকার কারখানার জন্য প্রযোজ্য নয়। তবে বিদ্যমান আইনগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা হচ্ছে।
×