ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগ পেতে চায় সব আসন, জাতীয় পার্টি বিএনপি ভাগ চায়

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আওয়ামী লীগ পেতে চায় সব আসন, জাতীয় পার্টি বিএনপি ভাগ চায়

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ অলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (র.)-এর স্মৃতি বিজড়িত শ্রী চৈতন্যের লীলাভূমি, সুরমা কুশিয়ারা মনু খোয়াই বিধৌত দুটি পাতা একটি কুঁড়ির জেলা সিলেটের রয়েছে আলাদা ইতিহাস ঐতিহ্য। তেল গ্যাস পাথরে সমৃদ্ধ প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট নানান কারণে মর্যাদার দাবিদার। সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের উন্নয়নে আন্তরিক। দেশের সংসদীয় নির্বাচনে সিলেটের আলাদা একটি অবস্থান রয়েছে। নির্বাচন বোদ্ধারা সিলেট-১ আসনকে মর্যাদার আসন হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। স্বাধীনতা পরবর্তী কাল থেকে একটি প্রথা চালু রয়েছে। সিলেট-১ আসনে যে দল বিজয়ী হয়ে থাকে সে দলই সরকার গঠন করে থাকে। দীর্ঘ সময়ে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো সিলেট-১ আসনের গুরুত্ব বিবেচনা করে হেভিওয়েট প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়ে থাকে। সংসদ নির্বাচনসহ গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতারা হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজার জিয়ারত করেই নির্বাচনী প্রচার কাজ শুরু করে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচিত প্রার্থীরা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ও দায়িত্ব পেয়েছেন। বর্তমানে সিলেটের ৬টি আসনের মধ্যে ৪টিতেই আওয়ামী লীগ ও ২টিতে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রয়েছেন। এর পূর্বে ৬টি আসনই ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে দুটি আসন ছেড়ে দেয়া হয়। তবে এবার আওয়ামী লীগ সব আসন, জাতীয় পার্টি তাদের দুটি আসন ধরে রাখতে এবং বিএনপি তাদের হারানো আসনগুলো পুনরুদ্ধারে মাঠে নেমেছে। সিলেট-১ (সদর) ॥ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে নড়েচড়ে বসেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি ও সাবেক বিরোধীদল বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতারা। সংসদীয় আসনগুলোতে প্রার্থিতা নির্ধারণ নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। সিলেট-১ আসনের প্রার্থী নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে সরব আলোচনা। আওয়ামী লীগ থেকে এই আসনটির জন্য একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসনের প্রার্থী বাছাইয়ে প্রত্যেক দলই তাদের গুরুত্বপূর্ণ, জনপ্রিয় নেতাকে মনোনয়ন দিয়ে থাকে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ থেকে এই আসনে নির্বাচন করে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত এমপি। বিগত দিনে এই আসন থেকে বিএনপির হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। এবারের নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী কয়েকজনের নাম আলোচনায় আসছে। সিনিয়র প্রার্থীদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, তাঁর অনুজ চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. একে আবদুল মোমেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। নতুনভাবে আওয়ামী লীগ থেকে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করতে পারেন এমন আলোচনায় আসছে আরও দুজনের নাম। এরা হলেন- সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সপ্তম গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন। নির্বাচনের বিষয়ে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বললেও দলীয় নেতাকর্মীদের আলোচনায় শোনা যাচ্ছে তাঁরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হতে পারেন। বিগত দিনে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কথা বললেও এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। দেশের অভিজ্ঞ ও সজ্জন এই অর্থমন্ত্রী আবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন এমন ধারণা করছেন অনেকেই। অন্যদিকে ড. এ কে আবদুল মোমেনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পেতে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছেন এ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ প্রায় সময় প্রকাশ্যে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। নগরীর আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সামনে প্রকাশ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রত্যাশা জানিয়েছিলেন। সর্বশেষ বিগত ঈদ-উল ফিতরেও তাকে সংসদে দেখতে চান এমন দাবিতে নগরীজুড়ে ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়েছেন তার শুভাকাক্সক্ষী, সমর্থকরা। রাজনীতির তারকা ব্যক্তিত্ব, সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের উত্তরসূরী হতে সিলেট-১ থেকে বিএনপির মনোনয়ন তালিকায় একমাত্র প্রার্থী খন্দকার আবদুল মুক্তাদির। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা খন্দকার আবদুল মালিকের ছেলে এবং দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। কয়েক বছর ধরে খন্দকার মালিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মুক্তাদির চালিয়ে যাচ্ছেন সমাজসেবামূলক কর্মকা-। বলতে গেলে এই সময়ে মুক্তাদির নিজেকে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন। প্রথমদিকে এই আসন থেকে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পত্মী ডাঃ জোবাইদা রহমানের নাম শোনা গেলেও তাদের কারও এ আসন থেকে নির্বাচন করার সম্ভাবনা নেই। এদিকে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা করা হচ্ছে, দেশের বর্তমান বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী হিসেবে সিলেট-১ আসনে প্রার্থী হতে পারেন দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গেল বছরে সিলেট সফরে নগরীর রেজিস্ট্রারি মাঠের জনসভায় এরশাদ নিজে এখান থেকে নির্বাচনের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি সিলেটকে নিজের দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে অভিহিত করেন। বিএনপি থেকে এ আসনে বিজয়ী এম সাইফুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণের পর এখনো অন্য কোন প্রার্থী এই আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেননি। নবম সংসদ নির্বাচনে আবুল মাল আবদুল মুহিত মুহিত ১ লাখ ৭২ হাজার ৮১৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর সাইফুর রহমান পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ২১৩ ভোট। এটিই ছিল সাইফুর রহমানের জীবনের শেষ নির্বাচন। সিলেট-২ (বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) ॥ গুরুত্বের বিবেচনায় সিলেট-১ আসনের পরই রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে ‘সিলেট-২’ আসন। নানাকারণে প্রবাসী অধ্যুষিত আসনটি চলে এসেছে আলোচনার শীর্ষে। এই জনপদের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ইংল্যান্ড ও আমেরিকাতে থাকা প্রবাসীদের কলকাটি নাড়ানোয়। তাই দেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচনী প্রচার চালাতে হয় প্রবাসেও। ভোটব্যাংক বাড়াতে বিদেশে থাকা স্বজনদের মাধ্যমে দেশের স্বজনদের কাছে ভোট চাওয়া হয়। বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর এই তিন উপজেলা নিয়েই বিস্তৃত সিলেট-২ আসন। সম্প্রতি দেশের অন্য নির্বাচনী এলাকার মতো এখানেও থেমে নেই আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জল্পনা-কল্পনা। এই আসনে প্রধান তিন রাজনৈতিক দলেরই একজন করে প্রার্থীর নাম রয়েছে সর্বশেষ আলোচনাতে। শেষমেষ তিন দলেই আলোচনার শীর্ষে থাকা ওই তিন প্রার্থী টিকে থাকবেন অনেকটা নিশ্চিত। এরা হচ্ছেন- আওয়ামী লীগের সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী, নিখোঁজ বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা তাহসিনা রুশদীর লুনা এবং জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান সংসদ সদস্য ইয়াহইয়া চৌধুরী। এই আসনে আওয়ামী লীগের আরেক প্রার্থী হচ্ছেন প্রবাসী নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনিও মনোনয়ন লাভের আশায় জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক সমঝোতায় বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়াকে সমর্থন করে আওয়ামী লীগ। ১৪ দলের সমর্থন নিয়ে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৪৮ হাজার ১৫৭ ভোট পেয়েছিলেন ইয়াহইয়া। তার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী নেতা মুহিবুর রহমান আনারস প্রতীক নিয়ে পান ১৭ হাজার ৩৮৯ ভোট। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ছেড়ে দেন নিজের আসন। মহাজোটের স্বার্থেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীর জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন আসনটি। তার আগে নবম সংসদ নির্বাচনে এই শফিকুর রহমান চৌধুরী চমকের জন্ম দিয়েছিলেন বিএনপির তৎকালীন জনপ্রিয় ও হেভিওয়েট প্রার্থী এম ইলিয়াস আলীকে হারিয়ে দিয়ে। সেই নির্বাচনে ইলিয়াসের চেয়ে ৩ হাজার ১৭৪ ভোট বেশি পেয়ে জয়ের মালা পরেছিলেন শফিক। আসছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকার শীর্ষে থাকা শফিক চৌধুরীকে টেক্কা দিতে মাঠে নেমেছেন নিখোঁজ ইলিয়াসপতœী তাহসিনা লুনা। এ আসনে ইলিয়াস আলীর একটি অবস্থান রয়েছে। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তাঁর পতœী লুনা। ইলিয়াস অনুসারীরা এই আসনে ইলিয়াস পতœী ছাড়া আর কাউকে প্রার্থী হিসাবে মেনে নিবে না। এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী দুই নেতা সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও প্রবাসী নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী প্রতিযোগিতায় থাকায় দুজনই নিজস্ব বলয় তৈরি করতে মাঠে কাজ করছেন। এই কারনে এখনই দলীয় বিভেদ শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। অন্যদিকে মহাজোটের প্রার্থী না হলেও বর্তমান সংসদ সদস্য ইয়াহইয়া চৌধুরীর প্রার্থিতাও নিশ্চিত বলে দলের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়িত এলাকায় সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ও দলীয় কর্মসূচীতে তাঁর উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। দলের নেতা কর্মী ও সাধারণ মানুষ ডাকলেই তাঁকে কাছে পান, সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারেন। এই ইস্যুটি নির্বাচনকালীন মাঠে শফিকুর রহমানকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দলের নেতাকর্মীরাও তাঁকে নিয়ে নির্বাচন করে বিজয় নিশ্চিত করতে প্রস্তুত। সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জের একাংশ) ॥ রাজনৈতিক সমঝোতার হিসেব ভুলে গিয়ে সিলেট-৩ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির ১৩ জন প্রার্থী মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েস মনোনয়ন তালিকায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছেন। তবে দলের ভেতর থেকে কে প্রার্র্থী হবেন তা নিয়ে এরই মধ্যে ওপর মহলের সঙ্গে লবিং করতে শুরু হয়েছে দৌড়ঝাঁপ। আওয়ামী লীগের শীর্ষ চার নেতা এই আসনে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী। ধারণা করা হচ্ছে, মাঠের বিরোধী দল বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন আরও ৪ জন। সেক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও। এ আসন থেকে জাপার ৫ প্রার্থী মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ভূরি ভূরি এসব প্রার্থীর মধ্যে সিলেট-৩ আসনের শক্তিশালী প্রার্থী হচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বর্তমান এমপি মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন এমন প্রার্থী হচ্ছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী সদস্য সাবেক এমপি শফি আহমদ চৌধুরী। আওয়ামী লীগের ভেতরে বিদ্যমান গ্রুপিং ও বিভেদকে কাজে লাগাতে চাইছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ থেকে বিজয়ী হওয়া বর্তমান এমপি মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েস এমপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে দলীয় নেতাকর্মীদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বলা যায়, সামাদ চৌধুরীকেই ঠেকাতে নিজ দল আওয়ামী লীগসহ বিএনপি ও জাপার প্রার্থীরা এখন মরিয়া। তবে এ আসন থেকে টানা দুবার নির্বাচিত হয়েছেন মাহমুদ উস সামাদ। ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ থেকে অন্য যেসব প্রার্থী সামাদের বিদ্রোহী হতে পারেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এ্যাডভোকেট নিজাম উদ্দিন। এছাড়া যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হাবীবুর রহমান হাবীবের নামও আসছে। অন্যদিকে, শফি আহমদ চৌধুরী ছাড়াও সিলেট-৩ আসন থেকে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেতে আগ্রহী অন্য তিনজন হলেন- সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আবদুল গফফার, বিএনপি নেতা আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার এম এ সালাম। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আতিকুর রহমান আতিক এ আসন থেকে আগে একবার নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি এবারও এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনোনয়ন প্রাপ্তির দৌড়ে আছেন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও জেলা জাপার সদস্য সচিব উছমান আলী, কেন্দ্রীয় সদস্য ও যুক্তরাজ্য জাপার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা এবং যুক্তরাজ্য প্রবাসী জাপা নেতা ব্যারিস্টার ইম্মানুল হামিদ এনাম ও মুহিদুর রহমান। সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ) ॥ খনিজসম্পদ পাথরের সাম্রাজ্য বলে খ্যাত সিলেট-৪ আসন। এ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য হচ্ছেন আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য দিলদার হোসেন সেলিমকে পরাজিত করে দুই মেয়াদ সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এখানে আওয়ামী লীগের পক্ষে অন্য প্রার্থীর সম্ভাবনা নেই, এটা প্রায় নিশ্চিত। বর্তমান সাংসদ ইমরান আহমদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের রয়েছে সুসম্পর্ক। এছাড়াও এলাকায় তার একটি ভাল ও স্বচ্ছ ইমেজ রয়েছে। এই আসনটিও একবার জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। মরহুম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সিলেট ১ ও সিলেট ৪ আসন থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়ে, সিলেট ৪ আসনটি ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে এই আসনে উপ-নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী দিলদার হোসেন সেলিম বিজয়ী হন। পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনটি নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দুই প্রার্থী ছাড়াও আলোচনায় আসছে বিএনপির আরও দুই নেতার নাম। এরা হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান জামান ও বর্তমান গোয়াইনঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আব্দুল হাকিম চৌধুরী। বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, বিগত সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকে ঘরমুখো হয়ে পড়েন দিলদার হোসেন সেলিম। নির্বাচনকে সামনে রেখে তার প্রকাশ্যে আসা এবং সমাবেশ করে প্রার্থী হিসেবে নিজের প্রচার চালানোয় দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। দিলদার হোসেন সেলিম বর্তমানে শারীরিকভাবেও অনেকটা অসুস্থ বলে প্রচার করছেন তার দলের কর্মীরা। এই উপজেলা থেকে দুবারের নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিমকে নিয়েই দলের বড় অংশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। বিএনপির অন্য প্রার্থীরাও মনোনয়ন নিতে কেন্দ্রের সঙ্গে লবিং পেতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দুবার নির্বাচিত আব্দুল হাকিম চৌধুরী এলাকায় নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গেও রয়েছে তার সুসম্পর্ক। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আব্দুল হাকিম এগিয়ে রয়েছেন। সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) ॥ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সিলেট-৫ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নির্বাচনী মাঠে কাজ শুরু করেছেন। গত নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা সেলিম উদ্দিন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও এবার মহাজোট না থাকলে পাল্টে যাবে সব হিসেব-নিকেশ। এ আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী একাধিক প্রার্থী মাঠে কাজ করছেন। দশম নির্বাচনে প্রথমে মনোনয়ন পেলেও দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে মহাজোটের প্রার্থীকে আসন ছেড়ে দেন জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাসুক উদ্দিন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেষ্টা চালাচ্ছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আহমদ আল কবির। দুজনেই নির্বাচনী এলাকার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় রাখার চেষ্টা করছেন। এই আসন থেকে জামায়াতের মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী ২০০১ সালে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। নবম নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি। এবারও ফরিদ প্রার্থী হবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। জোটের প্রার্থীকে ছেড়ে দেয়ায় গত দুটি নির্বাচনে এ আসনে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। কিন্তু একাদশ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে পাল্টে যেতে পারে হিসেব। জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল কাহির চৌধুরী, জকিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আশিক চৌধুরী মনোনয়ন পেতে জোর চেষ্টা করছেন। এছাড়া কানাইঘাট উপজেলা বিএনপির সভাপতি মামুনুর রশীদও বিএনপির মনোনয়ন পেতে মাঠে কাজ করছেন। জাতীয় পার্টি থেকে পার্টি চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা বর্তমান সাংসদ ও বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ সেলিম উদ্দিন আবারও নির্বাচনে অংশ নেবেন। এছাড়া জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করতে তৎপর রয়েছেন পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক ও জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাব্বীর আহমদ ও জাপার কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মতিন চৌধুরী। এই আসনে আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মাসুক উদ্দিনের ভাল সম্পর্ক রয়েছে। এলাকার সামাজিক পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিতে মাসুক উদ্দিনের সম্পৃক্ততা সবার কাছে অলোচিত। সৎ মানুষ হিসেবে জনসাধারণের কাছে মাসুক উদ্দিনের গ্রহণ যোগ্যতা রয়েছে। এই আসনে বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের সাংসদ ছিলেন হাফিজ মজুমদার। সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) ॥ এ আসনে আগামী নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপিও আসন পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে একাধিকবার নির্বাচিত প্রভাবশালী এমপি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। আগামী নির্বাচনেও তিনিই নৌকার মনোনয়ন পাবেন এটা প্রায় নিশ্চিত। মনোনয়নের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ এবং তার অনুসারী নেতাকর্মীরা যথেষ্ট নির্ভর। দীর্ঘদিন মন্ত্রী থাকায় তিনি এলাকায় যে উন্নয়ন করেছেন, তার মূল্যায়ন করবেন জনগণ- এমন বিশ্বাস দলীয় নেতাকর্মীদের। তাছাড়া তিনি ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেছেন। তার ওপর দলের হাইকমান্ডের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। এছাড়া পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে এলাকায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের রয়েছে আলাদা ইমেজ। তবে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার জন্য লবিং করছেন কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোঃ সারওয়ার হোসেন ও লন্ডন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আফছার খান সাদেক। গত বন্যায় তাদের পক্ষ থেকে দুর্গত মানুষকে ব্যাপক ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে। মানুষ আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তন চায়, এমন দাবি এই দুই মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতার অনুসারীদের। মনোনয়ন প্রত্যাশী এসব নেতা বিভিন্নভাবে তাদের নির্বাচনী আসনে পৃথক বলয় তৈরি করে কাজ করছেন। গত নির্বাচনেও আফছার খান মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তখন দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, আসন হাতছাড়া হওয়ার মতো কাউকে মনোনয়ন দেবে না আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। তাই এবারও আফছার খান দলের মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। এদিকে পিছিয়ে নেই সাবেক বিরোধী দল বিএনপিও। এ আসনে বিএনপি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত। তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামীও সাংগঠনিকভাবে এ আসনে বেশ মজবুত অবস্থানে। বিএনপি-জামায়াত ভোটের হিসাব যোগ করলে জাতীয় নির্বাচনের ফল অন্য ঘরে যাবে না বলে জোট নেতাদের অভিমত। ২০০৮ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের মহাবিপর্যয়ের সময়ও বিএনপি-জামায়াতের ভোট ভাগাভাগি না হলে ফলাফল অন্য কিছু হতে পারত বলে মনে করেন জোটের নেতাকর্মীরা। এছাড়াও বিএনপির হয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী জাসাস কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক হেলাল খান, জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট রশীদ আহমদ, জেলা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক ফয়ছল আহমদ চৌধুরী, জাতীয় পার্টি থেকে যোগদানকারী আলহাজ কুনু মিয়া। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী থেকে মাওলানা হাবীবুর রহমান, ঢাকা মহানগরী জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা সেলিম উদ্দিন ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব-এর নাম প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আসছে। এ আসনটি এক সময়ে জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। এখান থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মকবুল হোসেন লিচু মিয়াও ইতিপূর্বে দুইবার সাংসদ নির্বাচিত হন। বর্তমান সাংসদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকায় তার একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না এলে এবং দলীয়ভাবে ঐক্য অবস্থান ধরে রাখলে এই আসনে আওয়ামী লীগের পুনরায় বিজয় অর্জন কঠিন হবে না। ইসলামী ঐক্যজোট থেকে নেজামে ইসলামী বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা এ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব এই আসনে ঐক্যজোট থেকে প্রার্থী হওয়ার জন্য জোটের কাছে দাবি জানিয়েছেন। তিনি এই আসনে অতীতে দলের প্রার্থী হয়ে এককভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বর্তমানে জোটের হয়ে বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে নেজামে ইসলামী বাংলাদেশ। অন্তত এই একটি আসন তাদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হবে এমন প্রত্যশা দলটির সকলের।
×