ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দূরপাল্লার যাত্রীদের অবশ্যই সিটবেল্ট বাঁধতে হবে

সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পাঁচ নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পাঁচ নির্দেশ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় হস্তক্ষেপ করেছে। গঠন করা হয়েছে একটি বিশেষ কমিটি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে এসব বিষয়ে দেয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা, সেইসঙ্গে সঙ্কট সমাধানে প্রস্তাবও নেয়া হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে। তৎপরতা শুরু হয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়েরও। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে উপদেষ্টা কমিটির নেয়া ২০ দফা সুপারিশ কার্যকর করতে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা রয়েছে। কাজও শুরু করেছে হাইওয়ে পুলিশও। তবুও থামছে না সড়ক দুর্ঘটনা। প্রশ্ন হলো এত কিছুর পরও দুর্ঘটনা সহনীয় মাত্রায় না নামার কারণ নিয়ে। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস, সুষ্ঠু সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পাঁচ দফা নির্দেশ বিআরটিএর মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কাছে। পুলিশসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকদের বেপরোয়া গতির মানসিকতা কোন অবস্থাতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। গত ২৫ আগস্ট নাটোরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি লেগুনা চালকের বেপরোয়া গতিকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রবিবার রংপুরের সড়ক দুর্ঘটনাও বেপরোয়া গতির কারণে হয়েছে। একই দিনে ঢাকায় বাসচাপায় পুলিশের এসআই উত্তম কুমার নিহতের ঘটনাকে চালকের বেপরোয়া মানসিকতাকে দায়ী করা হচ্ছে। পাশাপাশি মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল ও তদরকির অভাব, অদক্ষ চালক ও পথচারীদের সচেতনতার অভাবই সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ বলা হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধান সম্ভব হলে দুর্ঘটনার মহামারি কবে আসবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনাসমূহের মধ্যে রয়েছে, চলমান অবস্থায় গাড়ির দরজা বন্ধ রাখা, স্টপেজ ছাড়া গাড়ি না থামানো, পরিবহনের দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও সহকারীর ছবিসহ নাম মোবাইল নম্বর প্রদর্শন এবং দূরপাল্লার বাসে চালক ও যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে বলে জানান বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী। কেন দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, বিআরটিএর মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনা আমাদের হাতে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা সবকিছু গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে নির্দেশনা বাস্তবায়ন শুরু করেছি। আশাকরি আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এজন্য তিনি পথচারীসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। ফিরতি পথে মনিটরিং নেই ॥ পরিবহন সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদে নিরাপদ ঘরে ফেরা উপলক্ষে সরকারী পর্যায়ে নানা রকম প্রস্তুতি থাকে। এবারের ঈদেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী থেকে শুরু করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমন্বয়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করে সড়কে তদারকি করা হয়। পরিবহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতেও দেখা গেছে। কিন্তু ঈদ শেষ করে আসার পথে সড়কে কোন মনিটরিং নেই। সড়কে পুলিশ নেই। রেকার নেই। নেই গতি নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার। রাস্তা ফাঁকা। চালকরা বেপরোয়া। ইচ্ছামতো গাড়ি চালাচ্ছেন তারা। তাই দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ হলো বেপরোয়া গতি। এছাড়াও ইচ্ছামতো পণ্যবাহী পরিবহনের চলাচল, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন অবাধে চলছে। সেই সঙ্গে চালকদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, সড়কে মনিটরিং না থাকায় দুর্ঘটনার পরিমাণ আরও বেড়েছে। যা সত্যিই আতঙ্কের কারণ। তিনি সড়কে দ্রুত মনিটরিং জোরদার করার দাবি জানিয়ে বলেন, যানবাহনের গতি যে কোন মূল্যে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সরকারী পদক্ষেপ ॥ গত ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গবর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিটের সভায় ‘ঢাকা শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক বৈঠকে কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়। জানা গেছে, নির্ধারিত স্থানে যাত্রী উঠা-নামা, চলন্ত অবস্থায় দরজা বন্ধ রাখাসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গতিশীল করতে আরও ডজনখানেক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ২০ আগস্টের মধ্যে এসব কিছুর বাস্তবায়ন শুরুর কথা ছিল। এ জন্য বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এবং ঢাকা মহানগর পুলিশকে (ডিএমপি), রাজউক, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, দুই সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান থেকে পরিকল্পনা আহ্বান করার পর তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত হচ্ছে: ১. চলন্ত অবস্থায় সব গণপরিবহনের দরজা বন্ধ রাখতে হবে, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া যাত্রী উঠানামা করা যাবে না। ২. গণপরিবহনের দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম এবং চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মোবাইল নম্বর প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দুটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ডিএমপি ও বিআরটিএ দায়িত্ব পালন করবে। ৩. সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে (সর্বোচ্চ দুইজন আরোহী) বাধ্যতামূলক হেলমেট এবং সিগন্যাল আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে ডিএমপি। ৪. সব মহাসড়কে বিশেষত মহাসড়কে চলমান সব পরিবহনে (দূরপাল্লার বাস) চালক এবং যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহার এবং পরিবহনসমূহকে সিটবেল্ট সংযোজনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিআরটিএ এবং বাংলাদেশ পুলিশকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ চারটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার কথা ছিল ২০ আগস্টের মধ্যে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় ৯টি সিদ্ধান্ত এবং পরিবহনের ফিটনেস এবং লাইসেন্সের জন্য চারটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সর্বাত্মক প্রচার ও গণমাধ্যমে প্রচারণা, সভা আয়োজনের পাশাপাশি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া সড়ক ব্যবস্থাপনায় ৯ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আধুনিক, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সড়ক পরিবহন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসমর্থনকারী হিসেবে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা বর্তমানের অর্ধেকে নামিয়ে আনতে চায়। এ লক্ষ্যে প্রকৌশল, শিক্ষা ও আইন প্রয়োগ এই তিন ‘ই’ বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা বলছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ॥ ঈদ-উল আজহার যাত্রা শুরুর দিন (১৬ আগস্ট) থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা (২৮ আগস্ট) পর্যন্ত বিগত ১৩ দিনে মহাসড়কে ২৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫৯ জন নিহত ও ৯৬০ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। বাসে দুর্ঘটনার প্রবণতা বেশি ॥ পুলিশের হিসাব অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনার ৩১ দশমিক ৮৭ ভাগই ঘটছে বাসে, ২৯ দশমিক ৬৮ ভাগ ট্রাকে। বাকি প্রায় ৩৮ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে প্রাইভেটকার, জিপ, ট্যাক্সি ও মোটরসাইকেলে। গত বছরের শেষ তিন মাসে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে পুলিশ সদর দফতর এ তথ্য পেয়েছে। অবশ্য বেসরকারী সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৭ সালে সারাদেশে মোট চার হাজার ৯৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৩৯৭ জন প্রাণ হারান। ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হন। দুর্ঘটনা রোধে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু ॥ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেয়া কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সর্বশেষ সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে অন্তত ২০টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যার বেশিরভাগই আগে নেয়া ছিল। যা সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায় ফের সেসব সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ আসে উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক থেকে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২২ গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে নিষিদ্ধ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বন্ধে আরও কঠোর হওয়াসহ ৮০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে কোন অবস্থাতেই গাড়ি চালাতে না চলানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেপরোয়া গতিতে চলা যানবাহন নিয়ন্ত্রণে স্পিড গান কেনারও সুপারিশ করা হয়েছে বৈঠক থেকে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর পরই সিদ্ধান্তের চিঠি পাঠানো হয় সকল জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, হাইওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। টঙ্গি থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা যেতে আগে যেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগত সেখানে ২০ মিনিটের কম সময়ে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল ইতোমধ্যে বন্ধ করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
×