ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরলোকে বীরাঙ্গনা ও সাহিত্যিক রমা চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

পরলোকে বীরাঙ্গনা ও সাহিত্যিক রমা চৌধুরী

চট্টগ্রাম অফিস/ বোয়ালখালী সংবাদদাতা ॥ ‘একাত্তরের জননী’ খ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও সাহিত্যিক রমা চৌধুরী আর নেই। সোমবার ভোর রাত ৪টা ৪০ মিনিটে তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তিনি ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন। এই বীরাঙ্গনার মৃত্যুতে চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনৈতিক এবং শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। দুপুরে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার শেষে বিকেলে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পোপাদিয়া গ্রামের নিজ বাড়ি এলাকায় সন্তানের সমাধির পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়। কারণ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাহ প্রক্রিয়াকে বাদ দেয়ার শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করে গেছেন তিনি। রমা চৌধুরী ১৯৭১ সালে সম্ভ্রম হারানো একজন বীরাঙ্গনা। তিনি সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়া বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে দুই সন্তানকে হারানোর পাশাপাশি নিজের সম্ভ্রমও হারান। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা রমা চৌধুরীর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তাঁর স্বামী ভারতে চলে গেলেও তিনি নিজ ভিটে বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। এরপর তিনি বাড়ি ছাড়া হন। বছরের পর বছর কেটে যায় অনাহারে-অর্ধাহারে। চরম কষ্টের মধ্যেও তিনি কারও করুণা চাননি। ১৯৩৬ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন রমা চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে বাংলায় ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর তাঁর জীবনের একটি বড় সময় কাটে শিক্ষকতায়। এর মধ্যে সর্বস্ব হারান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন তাদেরই অন্যতম রমা চৌধুরী। সাগর, টগর, দীপঙ্কর এবং জহর নামে তাঁর চার সন্তান ছিল। ১৯৭১ সালের ১৩ মে তাঁর বোয়ালখালীর বাড়িতে হানা দেয় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। রমা চৌধুরী সেদিন মা ও তিন শিশু সন্তান নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। স্বামী ছিলেন ভারতে। সেদিন তিনি মা ও দুই সন্তানের সামনেই ধর্ষিত হন। নির্যাতিত হয়ে এবং ঘরবাড়ি হারিয়ে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর অনাহারে-অর্ধহারে অসুস্থ হয়ে মারা যায় বড় ছেলে সাগর। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সন্তান টগর মারা যায়। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তৃতীয় সন্তান টুনু। নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী তিনি সন্তানদের দাহ না করে সমাহিত করেন। এরপর থেকে তাঁর দীর্ঘ সময় কেটেছে খালি পায়ে হেঁটে। এ বিষয়ে রমা চৌধুরীর বক্তব্য, ‘যে মাটির নিচে আমার সন্তানরা শুয়ে আছে, সে মাটির ওপরে আমি জুতা পায়ে চলি কিভাবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ডেকে নিয়েছিলেন সাহিত্যিক রমা চৌধুরীকে। এই বীরাঙ্গনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি আবেগে আপ্লুত হন, পরম ভক্তিতে সম্মান জানান। সরকারের তরফে কিছু সাহায্য সহযোগিতাও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রমা চৌধুরী কোন বৈষয়িক সহযোগিতা নিতে রাজি নন। তবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য নির্দেশনা ছিল প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। অসুস্থ হওয়ার পর রমা চৌধুরী দীর্ঘ সময় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা কেবিনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব রমা চৌধুরীকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধিত করে। রমা চৌধুরী প্রচ- দুঃখ কষ্টের মধ্যও কারও কাছে হাত পাতেননি। অর্থাৎ জীবন সংগ্রামে তিনি ছিলেন হার না মানা মহিয়সী নারী। জীবিকার তাগিদে এক পর্যায়ে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। লিখেছেন একে একে ১৯টি বই। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলো মধ্যে রয়েছে একাত্তরের জননী, ভাব বৈচিত্রে রবীন্দ্রনাথ, শহীদের জিজ্ঞাসা, স্বর্গে আমি যাবো না, নীল বেদনার খাম, যে ছিল মাটির, আগুনরাঙা আগুনঝরা অশ্রুভেজা একটি দিন, নির্বাচিত প্রবন্ধ এবং ১০০১ দিনের পদ্য। তবে ১৯৭১ সালে তাঁর বাড়ি ভস্মীভূত হলে আরও অনেক পা-ুলিপি পুড়ে যায়। সোমবার সকাল ১০টায় দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে, দুপুর ১টার দিকে বোয়ালখালী উপজেলা শহীদ মিনার চত্বরে ও পোপাদিয়ার গ্রামের বাড়িতে রমা চৌধুরীর প্রতি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রমা চৌধুরীর শেষ ইচ্ছানুযায়ী ধর্মীয় রীতি অনুসারে ছেলে দীপঙ্কর টুনুর সমাধির পাশে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়। এ সময় রমা চৌধুরীর বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলে জহর চৌধুরী, দীর্ঘদিনের সহচর ও তাঁর বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দীন খোকনসহ সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। আলাউদ্দীন খোকন বলেন, গত রোববার (২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার দিকে রমা চৌধুরীর শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। রাতেই তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। কিন্তু কোন চেষ্টাই কাজে আসেনি। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে সম্ভ্রম হারান রমা চৌধুরী। পুড়িয়ে দেয়া হয় মাথা গোঁজার ঠাঁই। বই বিক্রি করেই চলত তার সংসার। নিজের লেখা বই নিজেই হেঁটে বিক্রি করতেন তিনি। এছাড়া শিক্ষকতা পেশায়ও জড়িত ছিলেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে তাঁর চাওয়া পাওয়া বলতে তেমন কিছু ছিল না। তবে নিজ বাড়িতে একটি অনাথাশ্রম গড়ার স্বপ্ন ছিল। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি শারীরিক নানান ব্যাধি নিয়ে রমা চৌধুরী ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও বোয়ালখালীতে রমা চৌধুরীকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান, ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডাঃ শাহাদাত হোসেন, সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ান, উদীচীর চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি শহীদজায়া মুশতারি শফি ও সহ-সভাপতি ডাঃ চন্দন দাশ, মুক্তিযোদ্ধা জেলা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টির চট্টগ্রাম জেলা সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অশোক সাহা, ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান, বিএফইউজে’র সহ-সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী , চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, হাসান মুরাদ বিপ্লব, শৈবাল দাশ সুমন, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মী ও প্রতিনিধিরা।
×