ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

নির্বাচনের আগে এবং পরে

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

নির্বাচনের আগে এবং পরে

আমরা এক কথায় ঘরপোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলে, এমনকি না দেখলেও, অতীত অভিজ্ঞতা ‘ভার্চুয়াল’ সিঁদুরে মেঘ চোখের ওপর ভেসে ওঠে। নির্বাচন নিয়ে বিএনপি যতই ‘গণতন্ত্র রক্ষা, গণতন্ত্র রক্ষা’ বলে হাঁকডাক করুক, জনমানুষ প্রত্যেক দলকে তাদের অতীত কর্মকা- দেখে বিচার-বিশ্লেষণ করবে এবং তারই নিরিখে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাঙালী জাতির মঙ্গল ও কল্যাণ চিন্তা করে এবার ভোট দেবে বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু কথা হচ্ছে- মার্কিন নির্বাচনে হিলারিকে হারানো, ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার পেছনে যে ভার্চুয়াল ভোট প্রভাবিত করার কৌশলের বিষয়টি বার বার আলোচিত হচ্ছে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসীদের মনে সিঁদুরে মেঘ দেখা দিয়েছে অর্থাৎ যে ভোটটি যে যাকে দেবে তা যথার্থভাবে সেই প্রার্থীর নামে পড়বে কিনাÑ এ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭১-এ বাংলাদেশবিরোধী পাকিস্তানপন্থী জামায়াত সে সময় আলবদর, রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলশামস গঠন করে এক অকল্পনীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সেখানেই তাদের বাংলাদেশ বিরোধিতার কর্মকান্ড বন্ধ করেননি। বরং পরে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরীর নানা ধরনের ইসলামী নামের মৌলবাদী সহিংস ইসলাম কায়েমে বিশ্বাসী খুনী-জঙ্গীদের জন্ম দিয়েছিল যারা খালেদা-তারেকের বিএনপির দ্বারা সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করে স্থানে স্থানে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। এরা বাঙালীর হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির ওপর একের পর এক হামলা, আক্রমণ চালিয়েছে যার কয়েকটি হচ্ছে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, মুক্তিযোদ্ধা কাজী আরেফসহ কয়েকজনকে হত্যা, সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা, ছায়ানটের বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের মিছিলের ওপর গ্রেনেড হামলা, শাহ এএমএস কিবরিয়া ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা! এসব হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাঙালীর ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির ওপর টার্গেট করে আঘাতের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হয়েছিল জামায়াত দ্বারা গঠিত মৌলবাদী দলগুলোর উদ্যোগে যাদের পেছনে মূল আশ্রয়-প্রশ্রয় ও প্রশাসনিক-আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতাকারী হিসেবে খালেদা-তারেকের বিএনপিকে বড় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। সুতরাং, বিএনপি-জামায়াত আদর্শিকভাবে এক ও অভিন্ন বলে প্রমাণ হয়ে যায়। বিএনপি শুধু একবার নয়, ’৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড, জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ডের ওপর ভিত্তি করে জন্ম নেয়া দলটি জন্ম থেকে ২০১৪-এর নির্বাচনে গণতন্ত্রের নামে তামাশা ও ষড়যন্ত্র, আগুন সন্ত্রাস করেছে এ দলটি। তারা গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত, সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাসী নয় এবং সেটির অনুষ্ঠানে যত রকমভাবে সম্ভব বাধা সৃষ্টিই তাদের অতীত ইতিহাস। এই প্রেক্ষিতে দুই ধারার আক্রমণকে প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসীদের যথার্থ, উপযুক্ত, কার্যকর প্রস্তুতি নিতে হবে। আবারও আগামী সুযোগকে সদ্ব্যবহার করে কি কি করতে পারে এরা? ১. বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সংস্কৃতির মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে এরা এদের প্রথম টার্গেটটি, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আবারও টার্গেট করবে। ২. মুক্তিযুদ্ধপন্থী, মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক নেতাদের, স্থানীয় তরুণ জনপ্রিয় নেতা, কর্মীদের ওপর হামলা করতে পারে। ৩. ব্লগার, ধর্মনিরপেক্ষ, বুদ্ধিজীবী এদের টার্গেটেড কিলিংয়ের শিকার হতে পারে। ৪. হিন্দুপ্রধান গ্রাম, পাড়ায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যা হতে পারে। ৫. নির্বাচনের আগে বা পরে, জঙ্গী-মৌলবাদীদের দিয়ে খালেদা-তারেক, আইএসআই একটা মরণকামড় দিতে চাইবে, এজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ৬. মনে হচ্ছে, এবার ফেসবুক ইত্যাদি ‘ভাইরাল’ জগতে সরকারবিরোধী চরিত্র হননকারী ‘গুজব’ একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। জনগণকে রামু, নাসিরনগর, গাইবান্ধার প্রায় নিরক্ষর সংখ্যালঘুর নামে ফেসবুকে ইসলামবিরোধী মিথ্যা গুজবের পরিণতি, এমনকি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে চাঁদে দেখার মতো অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক প্রচারের ফল; অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা স্মরণ করে এসবের পুনরাবৃত্তি যাতে সূচনায় বন্ধ করা যায়, সে বিষয়ে যথাযোগ্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী তরুণ-তরুণীদের। ৭.কিছু বড় বড় নির্মীয়মাণ, নির্মিত স্থাপনা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা হতে পারে, পদ্ম সেতু, বড় বিদ্যুত কেন্দ্র, সংসদ ভবন, বিমানবন্দর এগুলোর পাহারা জোরদার করতে হবে। ৮.২০০৯-এর বিডিয়ার বিদ্রোহের যারা পরিকল্পনা করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী ৫৭ মেধাবী চৌকস সেনা-কর্মকর্তাকে বর্বরভাবে হত্যা করা হয়েছিল বর্তমান শেখ হাসিনার নতুন সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে; এ কথা স্মরণে রেখে সব রকম নিরাপত্তা বাহিনীর বিষয়ে নিয়মিত গোয়েন্দা তথ্য থাকা ও রাখা এবং কঠোর মনিটরিং করা জরুরী। ৯. আওয়ামী লীগে জামায়াত-বিএনপিপন্থী ছদ্মবেশী অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে দলের সবাইকে নিজ নিজ জেলার তথ্য জানা, এদের দল থেকে বাদ দিয়ে দলকে ত্যাগী, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসীদের দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই। যত কঠিনই হোক, দলকে অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তিমুক্ত করতে হবে। ১০. ২০০১-এর নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে ফল বদল করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে বিজয়ী করা হয়েছিল। সেদিন রাতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনে তারেক, চার সচিব ও যুক্তরাষ্ট্রের এক দ্বিতীয় সচিব মিলে ঐ ষড়যন্ত্রমূলক কাজটি করেছিল। এটি শাহ কিবরিয়া সাহেব সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করলেও জোট বিজয়ী হওয়ায় কোন সংবাদপত্র সে তথ্য ছাপেনি। অনেক পরে কিবরিয়া সাহেবের দ্বারা প্রকাশিত ‘মৃদুভাষণ’ ম্যাগাজিনে এসব তথ্য নিয়ে নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। তবে, সে সময়ের হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী নির্যাতনের যে ভয়াবহ চিত্র দেশে-বিদেশে প্রকাশ পেয়েছিল, তা আজও মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে । ঐ সময় প্রায় দুই লাখ হিন্দু দেশত্যাগ করেছিল! হাজার হাজার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। সেই মাগুরা, মিরপুর, ১৫ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরে ২০০১-এর নির্যাতনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরে ২০০৬-০৭-এ খালেদার নানামুখী নির্বাচনী ফল দখলের পদক্ষেপের কারণে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করেছিল যাতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে বিজয়ী হয়। এরপর আবার ২০১৪-এর নির্বাচন নিয়ে খালেদা জিয়া-তারেক কমনওয়েলথ প্রধান, জাতিসংঘের দূতÑ সবার সঙ্গে সংলাপের নামে এমন অসহযোগিতা করে যে সবার সব চেষ্টা, সব দল মিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা বিনষ্ট হয়ে যায় এবং গণতন্ত্রের নামে ষড়যন্ত্র করে বিএনপি ঐ নির্বাচন বর্জন করে। এরপর তো অগ্নিসন্ত্রাস, ভাঙচুর, রাজপথ ধ্বংস এবং হাজার হাজার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ,নেতা-কর্মী হত্যা করে বিএনপি জামায়াত জোট! ওই গণতন্ত্রের নামে ষড়যন্ত্রের যে নীলনক্সা প্রণয়ন করা হয়েছে তা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণ-তরুণীদের নিয়ে নির্বাচনে ভার্চুয়াল ফল, মিথ্যা ফল প্রচার, মিথ্যা হত্যার ঘটনা প্রচার বন্ধ করার জন্য এখুনি একটি দলকে প্রস্তুত করা দরকার; যারা নির্বাচন ও এর ফলকে প্রভাবিত করার কোন রকম উদ্যোগকে সূচনাতেই বানচাল করে দেবে। অর্থাৎ বাস্তব জগতেও যেমন নজর রাখতে হবে তেমনি ভার্চুয়াল জগতেও কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে নির্বাচনী ফল বেদখল হয়ে না যায়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×