ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শক্ত অবস্থানে নৌকা, কোণঠাসা বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 শক্ত অবস্থানে নৌকা, কোণঠাসা বিএনপি

কালিদাস রায়, নাটোর থেকে ॥ বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা, বনলতার শহর নাটোর। ঐতিহাসিক রানী ভবানীর উত্তরা গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় বাসভবনও এখানে অবস্থিত। ভৌগোলিকগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জেলা নাটরের চারটি আসনেই বইছে নির্বাচনের হাওয়া। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিটি দলের নেতাকর্মী ও ভোটাররা সরব হয়ে উঠেছেন। জেলার চারটি আসনই বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দখলে। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে চারটি আসনেই শক্ত সাংগঠনিক অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে আওয়ামী লীগ। অনেকটাই কোণঠাসা ও সাংগঠনিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়া বিএনপি আসনগুলো পুনরুদ্ধারে চালাচ্ছে গোপন তৎপরতা। চারটি আসন দখলে থাকলেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর ছড়াছড়ি। কার চেয়ে কে বেশি জনপ্রিয়, সেটা প্রমাণ করতে দৌড়ঝাপের যেন শেষ নেই। প্রার্থী বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ আসনেই বড় দুই দলের নেতাকর্মীদের মাঝে দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং, বিভেদ ও স্নায়ুযুদ্ধ দৃশ্যমান। গত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যরা হলেন- লালপুর বাগাতিপাড়া (আসন-১) থেকে আবুল কালাম আজাদ, নাটোর-নলডাঙ্গা (আসন-২) থেকে শফিকুল ইসলাম শিমুল, সিংড়া-৩ থেকে বর্তমান তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম (আসন-৩) থেকে আব্দুল কুদ্দুস। আগামী নির্বাচনে বিভেদ-দ্বন্দ্ব ভুলে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে আবারও এই চারটি আসনেই নৌকা বিজয় লাভ করবে বলে স্থানীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের অভিমত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বিভেদকে কাজে লাগিয়ে আসনগুলোতে ভাগ বসাতে মরিয়া বিএনপি। নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) ॥ ভারতের সীমান্তবর্তী এই আসনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে মরিয়া আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে একাধিক প্রার্থী হওয়ায় দ্বন্দ্ব, বিভেদ, নীরব স্নায়ুযুদ্ধ এখন তুঙ্গে। একাধিক প্রার্থী ভোটারদের কাছে গিয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করছেন। ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা তাদের। মিটিং, মোটরসাইকেল শোডাউন, উঠোন বৈঠকে ব্যস্ত সময় পার করছেন কমবেশি সকলেই। তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মধ্যে বিভেদ ও দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে চাইছে নড়বড়ে বিএনপি। এখানে বিএনপির শক্তিশালী কোন প্রার্থী না থাকলেও আওয়ামী লীগকে ছেড়ে কথা কথা বলবে না বিএনপি। বিএনপি প্রার্থীরা এখানে গোপনে জনসংযোগ করছেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বিজয়ী বর্তমান এমপি আবুল কালাম আজাদ এবারও মনোনয়ন প্রত্যাশী। এছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা শহিদুল ইসলাম বকুল, মুক্তিযোদ্ধা মাজেদুর রহমান চাঁদ, সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ মমতাজ উদ্দীন আহমেদের স্ত্রী ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেফালী মমতাজ, কৃষকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুল হক আতিক, কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহ-সম্পাদক সিলভিয়া পারভীন লেনী ও লে. কর্নেল (অব.) রমজান আলী সরকার, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও নাটোর জজ কোর্টের পিপি সিরাজুল ইসলাম। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের চাইতে জনসংযোগে বেশি ব্যস্ত সময় পার করছেন শহিদুল ইসলাম বকুল। ২০০১ সালে খালেদা-নিজামী জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে তাকে পরপর ৩ বার গ্রেফতার করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে তিনি নাটোরের সিংড়া উপজেলায় নেতাকর্মীদের নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে বিক্ষোভ করার সময় বিএনপি-জামায়াত জোটের দুষ্কৃতকারীদের হামলার শিকার হন। মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিশেষ সহায়তা নিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হন। তিনি নির্বাচনী এলাকার তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে হাইকমান্ড পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। মাঠ চষে বেড়ানো শহিদুল ইসলাম বকুলের জনপ্রিয়তাও চোখে পড়ার মতো। এদিকে জনসংযোগে মাঠে থাকা মাজেদুর রহমান চাঁদ স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, সাংগঠনিক অপকর্মের অভিযোগ এনে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন। অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী লে. কর্নেল (অব.) রমজান আলী সরকার অবসর গ্রহণের পর থেকেই এলাকায় জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন এবং ১৯৯৮ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিজয় কেতনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণে জড়িত থাকার কারণে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই এই সামরিক অফিসারকে কোন পদোন্নতি না দিয়ে উল্টো সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শাস্তিমূলক বদলি করে। তিনি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। অপরদিকে বিএনপি থেকে এ আসনে নতুন মুখ হিসেবে আসতে পারেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী মরহুম ফজলুর রহমান পটলের সহধর্মিণী অধ্যক্ষ কামরুন্নাহার শিরীন। এছাড়াও গোপালপুর পৌরসভার পরপর তিনবার নির্বাচিত সাবেক মেয়র মঞ্জুরুল ইসলাম বিমল, বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি তরিকুল ইসলাম টিটু। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য আবু তালহা ও জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান মনির। অন্য দলগুলোর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি পলিটব্যুরোর সদস্য আনছার আলী দুলাল, সাম্যবাদী দল কেন্দ্রীয় নেতা এ্যাডভোকেট বীরেন সাহা, ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খলিলও মনোনয়ন প্রত্যাশী। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক তাসনিম আলম আগামী নির্বাচনে এ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খলিল ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তৃণমূল মানুষের সঙ্গে তার বেশ সখ্য রয়েছে। তৃণমূলের ভোটারাই তার মূল টার্গেট। উত্তরবঙ্গ চিনিকল আখচাষী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এই কৃষক নেতা ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের মজদুর পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। গত ২০১৬-১৭ আখ মাড়াই মৌসুমে আখচাষীদের নিয়ে তীব্র আন্দোলনে নামার মধ্য দিয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) ॥ জেলা সদর হওয়ায় এই আসনটি প্রতিটি দলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আসনে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। নির্বাচনে নানা সমীকরণ মেলাতে হয় প্রার্থীদের। এই আসনেই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। নাটোরের রাজনীতিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একজন সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে এ আসনে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে আবারও মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল। জেলার রাজনীতিতে তরুণ এই রাজনৈতিক নেতার উত্থান কিছুটা নাটকীয়। চারদলীয় জোটের শাসনামলে উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদারের পেশিশক্তির রাজনীতির জবাবে নাটোরের রাজপথে আওয়ামী লীগের যে কয়েকজন তরুণ নেতার উত্থান ঘটে, তাদেরই একজন বর্তমান এমপি শিমুল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। ২০১৩ সালে নাটোরের প্রাণকেন্দ্র কানাইখালি মোড়ে মোহাম্মদ নাসিমসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে জনসভার মঞ্চে সদর আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়ে বিতর্কিত হন। এ ঘটনার পরই মূলত রাজনীতির লাইমলাইটে চলে আসেন শিমুল। ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে আহাদ আলী সকারের। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন শফিকুল ইসলাম শিমুল। নির্বাচনে জিতে আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েন তিনি। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকারের সঙ্গে এমপির পুরনো দ্বন্দ্ব তো ছিলই। ক্ষমতায় থাকাকালে নানা কারণেই জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য হেভিওয়েট নেতা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান, পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলি এবং জেলা যুবলীগের সভাপতি বাসিরুর রহমান খান চৌধুরী এহিয়ার সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন বর্তমান সংসদ সদস্য। তবে তিনি নির্বাচনকে সামনে রেখে এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ছাড়াও আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইবেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান, সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ও পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি, জেলা যুবলীগের সভাপতি সভাপতি বাসিরুর রহমান খান এহিয়া চৌধুরী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মালেক শেখ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান। বর্তমান এমপি বিভিন্ন সময় বিতর্কিত হলেও শরিফুল ইসলাম রমজানের রয়েছে একদম ক্লিন ইমেজ। জনপ্রিয়তা কিংবা পেশিশক্তিতে এমপি শিমুলের সঙ্গে নাটোর শহরে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিতে পারেন এই রমজানই। আর শিমুল বিরোধী বলয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রও তিনি। শিমুলকে হটিয়ে সামনের নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারেও জোর আশাবাদী তীক্ষèবুদ্ধির অধিকারী এই নেতা। সম্প্রতি তিনি বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারে বাধাদানের অভিযোগ করেন। নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেলে নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারেও পুরোপুরি আশাবাদী তিনি। অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক উপমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার সম্পর্কে শহরের অনেকেই বলেন, ব্যক্তিগতভাবে সজ্জন এই রাজনীতিবিদের ভুল ছিলো মন্ত্রী থাকাকালে ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। তাকে ডুবিয়েছে নিজের দুই ছেলে। কিছুটা কোণঠাসা হলেও জেলার রাজনীতিতে এখনও নিজের বলয় ধরে রাখতে পেরেছেন ক্ষমতার গদি থেকে ছিটকে পড়া এই রাজনীতিবিদ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন লাভের দৌড়ে শিমুলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আহাদ আলী সরকার। এ আসনে আরেকজন মনোনয়ন প্রত্যাশী পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি। রাজনীতিতে নবাগত হলেও তার পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের শেকড়টা অনেক গভীরে প্রোথিত। তার বাবা প্রয়াত শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচরদের একজন। ছিলেন নাটোর আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ। প্রায় ২২ বছর আগে মারা গেলেও এখনও শহরের আপামর মানুষ সবাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এই মানুষটিকে। তাঁরই মেয়ে উমা চৌধুরী জলি। পৌর নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। তাই উমা চৌধুরী জলিকে ঘিরেও রয়েছে আওয়ামী রাজনীতির একটি বলয়। নৌকা প্রতীক পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী তিনিও। এছাড়া বাসিরুর রহমান খান চৌধুরী এহিয়াও মনোনয়ন চাইবেন। শহরের প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের সন্তান তিনি। বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের সঙ্গে একসময় তার গলায় গলায় মিল থাকলেও এখন তারা চরম প্রতিদ্বন্দ্বী। নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন প্রত্যাশী অপর আওয়ামী লীগ নেতা মালেক শেখ বসে নেই। তিনিও বিভিন্ন স্থানে প্রচার ও জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড ও নিজের ইমেজকে কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর তিনি। আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী থাকলেও এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী একজনই। নাটোরে বিএনপির কারিগর হিসেবে পরিচিত সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু এই আসনে প্রার্থী হচ্ছেন এটা নিশ্চিত। স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী এই নেতা কোন কারণে প্রার্থী হতে না পারলে অবশ্য তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ছবি এবারও বিএনপির প্রার্থী হবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিভিন্ন মামলা জটিলতায় ২০০৯ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতা দুলু অংশ নিতে পারেননি। এবারও তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে নাটোরে বিএনপির ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তায় পড়বে বিএনপি। বিএনপিতে দুলুবিরোধী একটি বলয় অপ্রকাশ্যে থাকলেও জাতীয় পার্টিতে প্রার্থী নিয়ে কোন বিরোধ নেই। বাম দলগুলোর মধ্যে থেকে সাবেক সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান সেন্টু ও ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সভাপতি এ্যাডভোকেট লোকমান হোসেন বাদলের নাম শোনা যাচ্ছে। নাটোর-৩ (সিংড়া) ॥ চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া নাটোরের একটি বৃহৎ উপজেলা। এ আসনে উভয় জোটের প্রায় দেড় ডজন প্রার্থী রয়েছে, যারা ইতোমধ্যে উপজেলা ব্যাপী নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন। এ আসনটি দীর্ঘ ৩৭ বছর আওয়ামী লীগের বেদখলে ছিল। ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো নবম সংসদ নির্বাচনে বর্তমান এমপি জুনাইদ আহমেদ পলক বিজয়ের মাধ্যমে আসনটি বিএনপি জোটের হাতছাড়া হয়। গত ২০০৮ সালের নির্বাচনে এলাকার সন্তান হিসেবে সবার মণিকোঠায় জায়গা করে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন সাবেক ভিপি, চৌকস বক্তা এবং তৎকালীন সময়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জুনাইদ আহমেদ পলক। নবম সংসদের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সংসদ সদস্য ও সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে এলাকার ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। আওয়ামী লীগের সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান মোতাবেক ৩৭ বছরের তুলনায় বিগত সাড়ে ৮ বছরে সিংড়ায় সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। তাছাড়া এ আসনে স্বাধীনতার পর প্রথম মন্ত্রী পেয়েছে চলনবিলের মানুষ। বর্তমানে নিজ এলাকায় তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। বলা হচ্ছে, সিংড়ার একচ্ছত্র অধিপতি তিনি। জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়াও এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইতে পারেন সিংড়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিক। শফিক ১৯৯৬ সালে গোল-ই আফরোজ সরকারী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ১৯৯৮ সালে একই কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগে ২০০৯ সালে তিনি সিংড়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এলাকায় নম্র ও ভদ্র নেতা হিসেবে পরিচিত শফিক। আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মনজুর আলম হাসু। এদিকে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি থেকে মহাজোটের মনোনয়ন চাইবেন উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি প্রকৌশলী আনিসুর রহমান। ওয়ার্কাস পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান পুরোদমে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। সিংড়া উপজেলায় বসবাসরত পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকজনের কাছে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে তার রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা। অন্যদিকে, এ আসনে বিএনপির প্রার্থী তালিকায় রয়েছে প্রায় এক ডজন মনোনয়ন প্রত্যাশী। সবাই ছুটছেন হাইকমান্ডের কাছে। নির্বাচনে সবাই দলীয় মনোনয়নে আশাবাদী। তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ এ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবেন। বর্তমানে তিনি জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কাজী গোলাম মোর্শেদ ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। উপজেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট মজিবর রহমান মন্টু, উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে পৌর বিএনপির সভাপতি দাউদার মাহমুদ, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শামীম হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল কাফি, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দলের কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট এম ইউসুফ আলী, সিংড়া পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম আনু এবং উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ডাঃ নজরুল ইসলাম রয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায়। নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) ॥ আসনটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরেই এ আসনটি রয়েছে আওয়ামী লীগের কব্জায়। এখান থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে এরই মধ্যে এলাকায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন এলাকায় এমপিবিরোধী বলে পরিচিত। তারা বর্তমান সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ তুলে মাঠে সরব হয়ে উঠেছেন। এই আসনে আব্দুল কুদ্দুস এমপি ছাড়াও নৌকার প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন আব্দুল কুদ্দুস এমপির মেয়ে এবং যুব মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী কুহেলি কুদ্দুস মুক্তি, বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডাঃ সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারি, গুরুদাসপুর পৌরসভার মেয়র শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও নাটোর জজ কোর্টের পিপি সিরাজুল ইসলাম, নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ সম্পাদক রতন সাহা। এই আসনটি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের দখলে। এই আসন থেকে পরপর চারবার নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছেন আব্দুল কুদ্দুস। তিনি এবারও মনোনয়ন পেতে চান। এমপি পরিবারের বাইরে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেতে দলটির শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত দৌড়ঝাপ করছেন বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ডাঃ সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারি। বর্তমানে এই আসনে আওয়ামী লীগের অন্যসব নেতার চাইতে তার রয়েছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা। উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরে অদ্যাবধি তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। ক্লিন ইমেজ রয়েছে তার। সকল ভোটারদের কাছে গিয়ে বেশ শক্ত জায়গা করে নিয়েছেন জনপ্রিয় এই নেতা। সবার মধ্যে ঐক্য থাকলে তিনি বিপুল ভোটে নৌকা প্রতীকে জয়লাভ করবেন বলে তার সমর্থকরা জানান। প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা ও ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সিরাজুল ইসলামও মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়ে মাঠে রয়েছেন। ১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং ১৯৯৮ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়ে অদ্যাবধি তিনি একই পদে আসীন রয়েছেন। এছাড়া ২০০১ ও ২০০৪ সালসহ বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতির স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, নিয়োগ বাণিজ্য, তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনে দলের বাইরে বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীদের সমর্থন করার অভিযোগ আনেন তিনি। এছাড়া এই আসনে আব্দুল কুদ্দুস এমপিকে দলবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করে এবং তাকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে গুরুদাসপুর পৌর মেয়র শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা ও বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ডাঃ সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশ। অন্যদিকে এ আসনে সাংগঠনিক শক্তি ও যোগ্য প্রার্থীর অভাবে ভুগছে বিএনপি। বড়াইগ্রাম উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি একরামুল আলমের মৃত্যু এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নুর বাবু সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়ার পর উপজেলায় দলটির শক্তিশালী নেতৃত্বে ধস নামে। সাবেক সংসদ সদস্য মোজাম্মেল হক এলাকায় থাকেন না। সে কারণে বিএনপিতে এক ধরনের শূন্যতা রয়েছে। যদিও দলটির কয়েকজন নেতা মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। যদিও বিএনপির কোন নেতাই এখন প্রকাশ্যে সেভাবে জনসংযোগে নামেননি। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও চেম্বার সভাপতি আমিনুল হক, সাবেক এমপি মোজাম্মেল হক, গুরুদাসপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল আজিজ, সাবেক বড়াইগ্রাম পৌর মেয়র ইসাহাক আলী, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক জন গোমেজ, বড়াইগ্রাম উপজেলা বিএনপি সভাপতি আব্দুল কাদের মিয়া মনোনয়ন চাইবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া এই আসনে মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টি আসন চাইতে পারে। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি আবুল কাসেম সরকার জনসংযোগ করছেন।
×