ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী উদ্বোধন

শিল্পের নান্দনিকতা- আবেদন সীমাহীন, চিরন্তন ॥ রাষ্ট্রপতি

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শিল্পের নান্দনিকতা- আবেদন  সীমাহীন, চিরন্তন ॥ রাষ্ট্রপতি

মোরসালিন মিজান ॥ শিল্প সংস্কৃতি চর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, এ চর্চা দেশ ও জাতিকে গৌরব দিতে পারে। বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই শিল্পমনা ও সংস্কৃতিমনা। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে এ দেশের শিল্পীসমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছেন। দেশ কাল সংস্কৃতিভেদে শিল্পীর স্বরূপ ও কর্মকান্ড ভিন্নতর হতে পারে। তবে শিল্পের নান্দনিকতা ও আবেদন সীমাহীন ও চিরন্তন। শনিবার দেশের সবচেয়ে বড় এবং আন্তর্জাতিক আয়োজন দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সংস্কৃতি সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। থাইল্যান্ডের সংস্কৃতি উপমন্ত্রী ও জাপান থেকে আগত জুরি বোর্ড সদস্য তেতসুইয়া নোদা অনুষ্ঠানে নিজেদের অনুভূতির কথা জানান। বহির্বিশ্বের সঙ্গে শিল্প ভাবনা বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম ‘দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ।’ ৩৭ বছর ধরে ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগ এ আয়োজনকে ধারাবাহিকভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে আসছে। ক্রমে আয়োজনটির পরিসর ও মান বৃদ্ধি করা হয়েছে। এবার বসল ১৮তম আসর। এতে যোগ দিয়েছেন বিশ্বের প্রায় ৭০ দেশের চারুশিল্পী। দেশী-বিদেশী ৪৬৫ শিল্পীর ৫৮৩ শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হবে। থাকছে পেইন্টিং, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, প্রাচ্যকলা, প্রিন্ট মেকিং, ভিডিও আর্ট, মৃৎশিল্প, পারফর্মেন্স আর্ট, নিউ মিডিয়া এবং স্থাপনা শিল্প। সব মিলিয়ে আনন্দঘন মিলনমেলা। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ আয়োজনের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান মানসম্পন্ন চারুকলা ভাস্কর্য ও স্থাপনা শিল্পের প্রদর্শনী হিসেবে স্বীকৃত। এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও উল্লেখযোগ্য আয়োজন। আন্তর্জাতিক এ আয়োজন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উজ্জ্বলভাবে তুল ধরতে অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। রাষ্ট্রপতি বলেন, শিল্পী তার নিজস্ব চেতনা, পারিপার্শ্বিকতা তথা স্থান কাল পাত্রকে ধারণ করে তা ফুটিয়ে তোলেন শিল্পকর্মে। তাই দেশ কাল সংস্কৃতিভেদে শিল্পীর স্বরূপ ও কর্মকান্ড ভিন্নতর হতে পারে। তবে শিল্পের নান্দনিকতা ও আবেদন সীমাহীন ও চিরন্তন। প্রতিটি শিল্পকর্মে ফুটে ওঠে শিল্পীর নিজস্ব চিন্তা-চেতনার পাশাপাশি জাতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। তাই শিল্পকর্ম ও শৈল্পিক ভাবনা ব্যক্তিশিল্পীর হলেও তার সৃষ্টিশীল কর্মের ব্যাপ্তি সর্বত্র ও সর্বজনীন। বাংলাদেশ চারুকলা চর্চার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সুজলা সুফলা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশ। ঐতিহ্যগতভাবেই এ দেশের মানুষ শিল্পমনা ও সংস্কৃতিমনা। এ দেশের কবি, গায়ক ও শিল্পীর অনেকেই দীক্ষা লাভ করেছেন বাংলার অপরূপ প্রকৃতি ও উদার সাংস্কৃতিক চেতনা থেকে। শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা। দেশের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে বাঙালী সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। শিল্প সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব বিষয়ে বর্ণনা করেন রাষ্ট্রপতি। বলেন, জ্ঞানভিত্তিক ও ও প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার শিল্প-সংস্কৃতি। দেশে দেশে, মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধন ও সম্পর্কের উন্নয়নে শিল্পকলার অবদান ব্যাপক। শিল্পকলা একটি দেশ ও জাতিকে গৌরব ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারে। তরুণ ও যুব সমাজের মাঝে শৃঙ্খলা, জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেমের চেতনার বিকাশসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য জাগিয়ে তুলতে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিকর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করেন রাষ্ট্রপতি। তাদের অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, জাতি গঠনে শিল্প-সংস্কৃতির ভূমিকা অপরিসীম। বাঙালী জাতির অর্জনের পেছনে শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের রয়েছে অসামান্য অবদান। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের পথ ধরে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে এ দেশের শিল্পীসমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শিল্পীসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। জাতির যে কোন প্রয়োজনে, যে কোন সঙ্কটময় মুহূর্তে সংস্কৃতিকর্মীরা সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেছে জানিয়ে কৃতজ্ঞতা জানান। বলেন, তারা দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেছে। বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যখন মানবিক সঙ্কট মোকাবেলা করা বড় চ্যালেঞ্জ, সে রকম একটি সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। মহান নেতার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে সংস্কৃতি চর্চা ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেই ধারবাহিকতায় এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজন। এবার আয়োজনটি আরও বড়। অতীতের সব আয়োজনকে ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, এ ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে আমরা আমাদের সামর্থ্যকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুলে ধরতে পারছি। একটি উন্নত সংস্কৃতির আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছি। শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের নতুন নতুন বৈচিত্র্যময় কাজ ও ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ঋদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পীরা। এত বড় এবং সফল আয়োজনের নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক সহযোগিতা ছিল জানিয়ে মন্ত্রী সরকারপ্রধানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জুরি বোর্ডের সভাপতি বরেণ্য শিল্পী শাহাবুদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর কথা বলে বক্তৃতা শুরু করেন তিনি। বলেন, এই শিল্পকলা, যদি বঙ্গবন্ধু না থাকতেন, হতো কিনা সন্দেহ। তার কারণে হয়েছে। অনেক কিছুর স্ক্ষাী আমি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে শিল্প-সাহিত্য- নাটকের ক্ষেত্রে এক ধরনের রেনেসাঁ সৃষ্টি হয়েছিল। এবং সুযোগ করে দিয়েছিলেন জাতির জনক। শিল্পের প্রতি উনার (বঙ্গবন্ধু) এত দরদ ছিল, যা অকল্পনীয়। স্মৃতি চারণ করে তিনি বলেন, এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি হিসেবে পাওয়ার আবেদন নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি তখন খুব ব্যস্ত। সময় করতে পারেননি। তবে টেলিফোন করে রাষ্ট্রপতিকে যেতে বলে দিয়েছিলেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতির কাছেও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা আশা করেন তিনি। এবারের আয়োজনে ২৬৬ বিদেশী শিল্পীর মধ্যে ২২৩ শিল্পী প্রতিযোগিতায় শিল্পকর্ম জমা দিয়েছেন। ২৯ বিদেশী শিল্পী বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নিচ্ছেন। ১৪ পারফর্মেন্স আর্টিস্ট এবার তাদের শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শন করবেন। এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করছেন ১৯৯ বাংলাদেশী শিল্পী। দেশীয় প্রদর্শনীতে শিল্পীদের ২০৩টি আর্টওয়ার্কের এক বিরাট শিল্পযজ্ঞ পরিবেশিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে ১০৭ শিল্পী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। ১৩ মাস্টার পেইন্টারের বিশেষ প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নিচ্ছেন ৬৩ শিল্পী। ১৬ দেশীয় পারফর্মেন্স আর্টিস্ট তাদের শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শন করবেন। এবারের আয়োজনে থাকছে দেশী-বিদেশী শিল্পীদের মোট ৩৬৮টি পেইন্টিং, প্রিন্ট ও ফটোগ্রাফি। ৩৩টি ভাস্কর্য। ৫২টি ইনস্টলেশন আর্ট। মোট ৩০ পারফর্মেন্স আর্টিস্টের শিল্পনৈপুণ্য প্রদর্শনী। আরও থাকছে ‘ইয়াং আর্ট প্রজেক্ট’। রয়েছে আন্তর্জাতিক সেমিনার। বিশেষ সংযোজন হিসেবে রয়েছে কারুপণ্য মেলা, ফুড কোর্ট, আর্ট ক্যাফে, শিশু কর্নার, আর্ট ক্যাম্প, পারফর্মেন্স আর্ট ওয়ার্কশপ। যুক্ত হয়েছে ভাস্কর্য উদ্যানও। মাসজুড়ে প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
×