ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্ছৃঙ্খলতা নয় ॥ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা সমুন্নত রাখুন

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

উচ্ছৃঙ্খলতা নয় ॥ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা সমুন্নত রাখুন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, উচ্ছৃঙ্খলতা কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে চলতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনে সে রকম আচরণ করতে হবে। সেটাই আমরা আশা করি, জাতিও আশা করে। আমরা চাই, আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবনমান সবদিক থেকে উন্নত হোক। তারা এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাক। আমাদের বয়স হয়ে গেছে। আর কতদিন। কিন্তু এর পরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যারা আসবে তারা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে তুলে জাতির পিতার যে স্বপ্ন; ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা, সেই স্বপ্ন পূরণ করে যেন এগিয়ে নিয়ে যায়। শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হল এলাকায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে স্মরণীয় করে রাখতে নবনির্মিত ‘৭ মার্চ ভবন’ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষায় অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম খরচের কথা শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরে বলেন, শিক্ষায় আমরা যা খরচ করি, এটাকে কখনও আমরা খরচ হিসেবে মনে করি না। আমি মনে করি, এটা আমরা বিনিয়োগ করছি, যা আমাদের দেশ গঠনের কাজে লাগবে। আমাদের দেশের মানুষ উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। সাধারণ ক্ষেত্রে বলা যায়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের উপার্জনে চলবে। আমাদের এখানে যারা শিক্ষার্থী তাদের ভাবা উচিত, পৃথিবীর মধ্যে মনে হয় সব থেকে কম খরচে উচ্চশিক্ষা বাংলাদেশে দেয়া হয়ে থাকে। শতভাগ খরচ কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে, এটা কিন্তু পৃথিবীর কোন দেশে আছে বলে জানি না। আমরা অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তো খোঁজখবর রাখি। কিন্তু আমরা বাংলাদেশে সেটা করি না। কাজেই এর মর্যাদাও শিক্ষার্থীদের দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিক আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দীন, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জিনাত হুদা বক্তব্য রাখেন। এর আগে রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী লিপি আক্তার এবং শ্রাবণী ইসলাম প্রধানমন্ত্রীকে ‘উত্তরীয়’ পরিয়ে দেন। সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী নবনির্মিত ৭ মার্চ ভবনের ফলক উন্মোচন করেন। তিনি ওই ভবনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতি ও ৭ মার্চ জাদুঘরও পরিদর্শন করেন এবং সেখানে রাখা বইয়ে স্বাক্ষর করেন। প্রায় ৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ভবনটিতে প্রশাসনিক এবং সার্ভিস ব্লক নামে আরও দুটি ব্লক রয়েছে। ৭ মার্চ জাদুঘরে বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের দুর্লভ আলোকচিত্র এবং তথ্যাদি সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমত উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সমস্যা সমাধানে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২টি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন ও উদ্বোধন করেছিলেন। ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল রোকেয়া হলের ‘৭ মার্চ ভবন’। ১১ তলাবিশিষ্ট এ ভবনে প্রায় এক হাজার ছাত্রী আবাসন সুবিধা পাবেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, জাতীয় অধ্যাপকবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে কোন ম্যাজিক নেই। ম্যাজিক একটাই, সেটা হলো আমরা একটা আদর্শ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করি। আমার কাছে ক্ষমতা ভোগের বস্তু নয়। আমার কাছে ক্ষমতা হচ্ছে জনগণের জন্য দায়িত্ব পালন করা। তিনি বলেন, আমি যখন যেখানেই যাই, ওই একটা প্রশ্নই অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা এত দ্রুত কিভাবে অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারেন? কোন কোন রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান তো জিজ্ঞাসা করেন, ম্যাজিকটা কি? আমি শুধু তাদের একটা কথাই বলি, এখানে কোন ম্যাজিক নেই। ম্যাজিক একটাই, সেটা হলো, একটা আদর্শ নিয়ে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করি। জনগণের জন্য কি করতে পারলাম, কতটুকু করতে পারলাম, সেটাই বিবেচনা করি। সেটাই হিসাব কষি। সেটাই আমরা দেখি। প্রতিটি মুহূর্তে এটাই চিন্তা থাকে, কি কাজটা করলে দেশের মানুষের কল্যাণ হবে, মানুষ একটু ভাল থাকবে, ভালভাবে বাঁচবে, মানুষের জীবনটা উন্নত হবে। মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসবে এবং মানুষের জীবনটা উন্নত হবে। জনগণের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত কর্মসূচীর কথাগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০২০ সালে আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করব। কাজেই এই সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই কিন্তু আমরা উদযাপন করতে যাচ্ছি। বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নের রোল মডেল উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতির পিতার যে নির্দেশিত পথ, সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি বলেই এত দ্রুত আমরা দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। ইনশাল্লাহ, এই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতা তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। তাই বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে ভবিষ্যতেও পারবে না। দেশকে যেন আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি সেজন্য সকলের সহযোগিতাও কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করায় বিএনপি সরকারের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের প্রত্যেকটা জেলাকে নিরক্ষরতামুক্ত জেলা হিসেবে গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক সেবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি এসব বন্ধ করে দেয়। সে সময় দেশে সাক্ষরতার হারও কমে যায়। যাই হোক, এখন আমরা আবার কাজ করছি। দেশে সাক্ষরতার হারও আবার বাড়ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। জাতি গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫২ সালের মাতৃভাষার সংগ্রাম থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, সর্বক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। সে কারণেই এই বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা গুরুত্ব বহন করে। ছয় দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে যত সংগ্রাম-আন্দোলন হয়েছে, সব আন্দোলনের সুতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতার প্রতিটি আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনেক। মাস্টার্স সম্পন্ন না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর আক্ষেপ ॥ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর মাস্টার্স সম্পন্ন করতে না পারার আপেক্ষও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, একটু দুঃখ আছে মনে। আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) পড়াশোনা শেষ করতে পারেন নাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আর আমার ভাগ্যেও জুটেছিল এটা। ১৯৭৫ সালে যখন জার্মানিতে চলে যাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে তখন মতিন সাহেব ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। আমি মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলাম, তা আর সমাপ্ত করতে পারি নাই। আমার সেই শিক্ষা অধরাই থেকে গেল। এই দুঃখটা সব সময় আমার মনে আছে, মনে থাকবে। তবে সম্মানসূচক ‘অনারারি ডিগ্রী’ দেয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। আমার ভাই শেখ কামাল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। এভাবে আমাদের পরিবারের প্রায় সকল সদস্যই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শেখ ফজলুল হক মনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শেখ ফজলুল করিম সেলিম সেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরা সবাই প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলাম। আর রোকেয়া হল তো আমারই হল। সেই হলেই এই ভবনটি নির্মিত হলো। আমি সত্যিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে গর্ববোধ করি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী নবনির্মিত এই হলটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছাত্রীদের যতœবান হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, এই ভবনটা যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, অবশ্যই তাদের এই নজরটা দিতে হবে। আমাদের বাঙালীদের একটা বদভ্যাস হচ্ছে: খেয়েটেয়ে ঠাস করে ছুড়ে ফেলে দেয়া। এই বদভ্যাসটা পরিহার করতে হবে। আজকে বিদ্যুত আছে বলে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা, এটা যাতে না হয়। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী দেশকে যেন আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন সেজন্য সকলের সহযোগিতাও কামনা করেন।
×