ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইথিওপিয়ার মাদক ঢাকা হয়ে যাচ্ছে পাশ্চাত্যে

এনপিএস-ইয়াবার চেয়েও ভয়ঙ্কর মাদক!

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

এনপিএস-ইয়াবার চেয়েও ভয়ঙ্কর মাদক!

আজাদ সুলায়মান ॥ নেশার জগতে সর্বশেষ যোগ হয়েছে নতুন উপাদান ‘এনপিএস’। ইয়াবার চেয়েও ভয়ঙ্কর এ মাদকটি ‘খাট’ নামে পরিচিত। আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে আসছে আকাশপথে। ঢাকা হয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে। ইয়াবার চেয়েও দামী এই মাদকের বেশ কয়েকটি চালান ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হওয়ার পর শুক্রবার একটি চালান ধরা পড়ে। পোস্টাল অর্ডারে আনা চালানের সঙ্গে এক মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়ায় তোলপাড় চলছে। গ্রীন টি নামে বিমানবন্দর দিয়ে পাচার করা হচ্ছে খাট। বিমানবন্দরের একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সহযোগিতায় খাট পাচার করা হতো বলে জানিয়েছেন মাদক গোয়েন্দার সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান। তিনি জানান, ধৃত আসামি নাজিমকে রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। গত তিন মাসে কত চালানে কি পরিমাণ খাট শাহজালাল দিয়ে পাচার করা হয়েছে। এর আগেও বেশ কয়েকটি চালানে বিপুল খাট ঢাকা থেকে বিদেশে পাঠানোর কথা স্বীকার করেছে ধৃত নাজিম। এনপিএস সম্পর্কে মাাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার বলেন, এক ধরনের গাছ থেকে এনপিএস তৈরি হয়। অধিদফতরের ‘খ’ ক্যাটাগরির এ নতুন মাদক অনেকটা চায়ের পাতার গুঁড়োর মতো। পানির সঙ্গে মিশিয়ে তরল করে সেবন করা হয়। সেবনের পর মানবদেহে এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি করে। অনেকটা ইয়াবার মতো প্রতিক্রিয়া হয়। এনপিএস ইয়াবার মতো কাজ করলেও গ্রীন টির মতো প্যাকেটে আনা হয়। দেশে আবার নতুন করে প্যাকেট করে বাইরে পাঠানো হয়। মাদক বিভাগ জানিয়েছে, ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার নাগরিক জিয়াদ বাংলাদেশে এই চালান পাঠায়। সেগুলো ঢাকা থেকে রিপ্যাকিং হয়ে গ্রীন টির প্যাকেট হিসেবে পাচার করা হতো। ধৃত নাজিম নিজেকে এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ার হিসেবে দাবি করছে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিটি চালান পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেই তাকে পারিশ্রমিক দেয়া হতো ৮শ’ ডলার হিসেবে। এখন তদন্ত করা হচ্ছে, সে নিজে ক্যারিয়ার নাকি ব্যবসায়ী! বিমানবন্দরের কার্গো হাউস সূত্রে জানা যায়, গত তিন মাসে গ্রীন টি রফতানির মাধ্যমে কমপক্ষে ৭ হাজার কেজি এনপিএস পাঠানো হয়েছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে। এগুলোকে কার্গো আইটেম হিসেবে পাঠানো হয়েছে। কাস্টমস, বিমান, সিভিল এভিয়েশন ও পোস্টাল বিভাগের একটি সিন্ডিকেটের যোগসাজশে এসব চালান পাঠানো হয়। এ বিষয়ে সব্জি রফতানিকারক বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে সাধারণত গ্রীন টি রফতানি করা হয় না। যখন চায়ের কার্টনগুলো একের পর এক কার্গো হিসেবে পাঠানো হয়েছে, তখন কারও মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক না হওয়াটাই তো বড় রহস্য। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ এনপিএস পাচার সম্পর্কে বলেন, অনেক আগে থেকেই এ ধরনের তথ্য ছিল। এর ভিত্তিতেই আমাদের গোয়েন্দারা নজরদারি করছিল। শেষ পর্যন্ত তারা এর একটি চালান হাতেনাতে ধরে ফেলায় এখন বেরিয়ে আসছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস নতুন এ মাদক ব্যবসার জন্যও একটি সুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে দেশের ভেতরে ও বাইরে। এ অবস্থায় জাতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে শুক্রবার অভিযান চালানো হয় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে। মাদকদ্রব্য বিভাগের সদস্যরা প্রথমে শান্তিনগর থেকে নাজিম নামে এক ব্যবসায়ীকে আটক করে। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তারা নিশ্চিত হন, শাহজালালের কার্গোতে একটি চালান যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির অপেক্ষায় রয়েছে। পরে তাকে নিয়েই সেখানে হানা দেয়া হয়। মাদক বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদারের নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান, সহকারী পরিচালক মোঃ খোরশিদ আলম, পরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, পরিদর্শক কামরুল ইসলাম ও পরিচালক শামসুল কবির ও অন্যান্য গোয়েন্দা সদস্যরা অভিযান চালান কার্গো হাউসে। এ সময় কার্গো পণ্য হিসেবে রফতানির অপেক্ষায় থাকা গ্রীন টি লেবেল লাগানো সবগুলো কার্টন শনাক্ত করা হয়। মেহেদী হাসান জানান, বিমানবন্দরে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ইএমএস শাখার অফিস কক্ষ থেকে এসব কার্টন জব্দ করা হয়। প্রতি কার্টনে সোয়া ২০ কেজি করে মোট ৪৬৬ কেজি খাট পাওয়া যায়। ওখানে দাঁড়িয়েই নাজিম স্বীকার করে, তার বাসা ১২৪/৭/এ, শান্তিনগর প্লাজার দোতলার নওশিন এন্টারপ্রাইজে আরও এনপিএস রয়েছে। তাকে নিয়ে সেগুলো জব্দের পর দেখা যায় এখানেও ৩১ কার্টনে মোট ৩৯৪ কেজি খাট রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার নাগরিক জিয়াদ মোহাম্মাদ ইউসুফ এনপিএসের চালানটি পাঠিয়েছেন। তার সঙ্গে বছর কয়েক আগে দুবাইয়ে পরিচয় ঘটে নাজিমের। সেই বিশ্বাসেই নওয়াহিন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে চালানটি পাঠানো হয়। পর পর তিনটে চালান ঢাকায় পাঠায় জিয়াদ। আগের দুটো পাঠিয়ে দেয়া হয় আমেরিকায়। তৃতীয় চালানটি ঢাকায় আনার পর আমেরিকায় পাঠানোর অপেক্ষাই ধরা পড়ে যায়। এ সম্পর্কে সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, এ চালানটি এসেছে পোস্টাল অর্ডার হিসেবে সিঙ্গাপুর থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারের কার্গোতে। সেজন্য সেটি বিমানবন্দর পোস্টাল অফিসেই খালাসের অপেক্ষায় ছিল। এটি পরে জিপিওতে পাঠানো হতো, সেখান থেকে খালাস করে নিত নাজিম। এর আগেও একই প্রক্রিয়ায় নাজিম দুটো চালান গ্রহণ করে। সেগুলো নিজ বাসায় বসে এক কেজির গ্রীন টির প্যাকেট করে বিশেষ কায়দায় কার্টনে ভরে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতো সে। মেহেদী বলেন, নাজিম স্বীকারোক্তিতে জানায়, ইথিওপিয়া থেকে প্রথমে ঢাকায় এনে পরে শাহজালাল দিয়ে গ্রীন টি হিসেবে রফতানি করা হতো। এর আগেও একটি চালান আসার তথ্য ছিল এমিরেটস এয়ারলাইন্সে। কিন্তু সে তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ওরা ভিন্ন কৌশল নেয়। মূলত ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোই ছিল নাজিমের কাজ। এ জন্য সে প্রতি চালানে ১৫শ’ ডলার পারিশ্রমিক পেতো। জব্দকৃত এনপিএসের মূল্য আনুমানিক সোয়া কোটি টাকা। এনপিএস কি ধরনের মাদক জানতে চাইলে পরিদর্শক কামরুল ইসলাম বলেন, এনপিএস (নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস)। এটি খাট নামেও পরিচিত। এর দুটো চালানই গ্রীন টি প্যাকেটের আড়ালে আকাশপথে আসে। আসলে এটা অপব্যবহারের পদার্থ, যা ১৯৬১ সালের প্রচলিত মাদক আইন অথবা ১৯৭১ সালের ওষুধ আইনে নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। কিন্তু এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যা আইনের মধ্যে পড়ে না বা যা নিয়ে আইন তৈরিও হয়নি। এতে মাদক বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসনও হিমশিম খাচ্ছে। পণ্যটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ এর ‘খ’ তফসিলে ২ নং ক্রমিকভুক্ত যা একই আইনের ১৯ (১) টেবিলের ১০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বিশেষ করে সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরুর দিকে এনপিএস জাতীয় মাদক ক্যাপটাগনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। এ উচ্চমাত্রার মাদক নিয়ে ’১৫ সালের ২০ নবেম্বর ওয়াশিংটন পোস্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ’১২ সালে এনপিএস নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ইউএনওডিসির এক রিপোর্টে বলা হয়, এনপিএস আসক্ত ব্যক্তি মানসিক বৈকল্যে ভোগে। সামাজিকভাবে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে। কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে। বেঁচে থাকা অপ্রয়োজনীয় মনে হয় তার। এক সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অনেক দেশ স্থায়ীভাবে এনপিএস নিয়ন্ত্রণ করছে অথবা অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়, বিশ্ব একটি ভীতিকর নতুন মাদক সমস্যা প্রত্যক্ষ করছে। এনপিএস তৈরির উপাদানগুলো বৈধ। এসব উপাদান গবেষণাগারে, বাথ সল্ট হিসেবে বিক্রি করা যায়। এনপিএসের ব্যবহার ব্যাপকমাত্রা পেলে যুবসমাজ ধ্বংসের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হবে। জনস্বাস্থ্য পুরোপুরি হুমকির মুখে পড়বে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাজিম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জানায়, বিক্রির পাশাপাশি বাংলাদেশকে পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল নাজিম। চায়ের প্যাকেটের আড়ালেই এটি অন্য দেশে পাঠিয়ে আসছে নাজিম। মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, ধৃত নাজিমকে আজ রবিবার রিমান্ডে আনার জন্য আদালতে পাঠানো হবে। তার বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। এক সময় নাজিম দুবাই থাকত। সেখানে একটি দোকানে কাজ করার সময় পাশের অপর একটি দোকানের কর্মচারী ইথিওপিয়া থেকে এই এনপিএস ব্যবসা করার বুদ্ধি দেয় তাকে এবং ওই দোকানির মাধ্যমেই জিয়াদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে নাজিমের। তার কাছ থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায়ের জন্যই রিমান্ডে আনা হবে।
×