ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিল্পকর্ম দেখার বিষয় নয়, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির

প্রকাশিত: ০৫:০০, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 শিল্পকর্ম দেখার বিষয় নয়, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির

মনোয়ার হোসেন ॥ বিশ্বখ্যাত জাপানী চিত্রকর তেতসুইয়া নোদা। বর্তমানে জাপানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক চারুকলা আঙিনায় বরেণ্য ছাপচিত্রীদের অন্যতম। তার ‘ডায়েরি’ সিরিজটি জয় করে নিয়েছে অগণন শিল্পরসিকের মন। জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস এ্যান্ড মিউজিকের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক বর্তমানে অবস্থান করছেন ঢাকায়। অতিথি ও পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশ নিচ্ছেন শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আঠারোতম আসরে। শনিবার বিকেলে প্রদর্শনী উদ্বোধনীতে রেখেছেন সম্মানিত অতিথির বক্তৃতা। এর আগে শরত সকালে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলের লবিতে তিনি কথা বলেন প্রতিনিধির সঙ্গে। সে আলাপচারিতায় উঠে আসে তাঁর নিজস্ব চিত্রকর্ম, বাংলাদেশের চিত্রকলা কিংবা শিল্পকলার বাজারসহ বহুমাত্রিক বিষয়। বলেছেন, অংক করার ভয় থেকে কেমন করে ধাবিত হলেন চিত্রশিল্পের পথে। কথা প্রসঙ্গে তার কণ্ঠে উচ্চারিত শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয় এদেশে ছাপচিত্রের পথিকৃৎ শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার নামটি। নিজের আঁকাআঁকি বিষয়ে তেতসুইয়া নোদা বলেন, যাপিত জীবনের মাঝেই খুঁজে পাই চিত্রকর্মের রসদ। নিত্যদিনের জীবনের ভেতরই হাজির হয় নানা বিষয়। চলার পথে আমরা অনেক কিছু দেখলেও সেটা সঠিকভাবে অনুভব করতে পারি না। সেই অনুভূতির জগতটাকেই চিত্রপটে মেলে ধরার চেষ্টা করি। চারুশিক্ষার সূচনালগ্নে নগ্ন মডেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকার বিষয়টি উপভোগ করলেও চিত্রকর্মে নিজেকে খুঁজে না পাওয়ার বেদনা ছিল এই শিল্পীর মধ্যে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চিত্রকর্মে অন্যের অবয়বটি মেলে ধরতে পারলেও সেখানে নিজের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সামগ্রিক শিল্পকর্ম সম্পর্কে শিল্পীর বলাটি ছিল এরকম অনেকেই কোন একটি ছবি বা ভাস্কর্য দেখে মন্তব্য করেন তিনি সেটা বোঝেননি। কিন্তু শিল্পকর্ম শুধু দৃষ্টি দিয়ে দেখার বিষয় নয়, শিল্পকর্ম মূলত হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির। আলাপচারিতার শুরুতেই তেতসুইয়া নোদা জানান, দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর সুবাদে প্রথমবারের মতো এসেছেন বাংলাদেশে। ব্যক্ত করেন শহর ঢাকা ঘুরে দেখার আকাক্সক্ষা। বাংলাদেশের চিত্রকলা সম্পর্কে বলেন, এদেশের শিল্পীরা ভাল কাজ করেন। অনেকের কাজই তিনি দেখেছেন। তবে এবারের এ প্রদর্শনীতে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাংলাদেশী শিল্পীদের কাজ দেখবেন বলেও জানালেন। এদেশের প্রখ্যাত ছাপচিত্র শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রতি রয়েছে নোদার বিশেষ ভাললাগা। সেই ভাললাগার কথাটি জানিয়ে বলেন, কিবরিয়া যখন শিক্ষক হিসেবে জাপানে চারুশিক্ষা পড়াতেন তখন আমি তার ছাত্র ছিলাম। তার অনেক কাজ দেখার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ছোট-বড় সব ধরনের ছবিই তিনি আঁকতেন। তবে তার কাজের ক্ষেত্রে ভাবনাটি ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। সেটাই মুগ্ধ করেছে আমাকে। ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে শিল্পকর্মের বিশাল বিশ্ব বাজার। এ প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, যে কোন শিল্পকর্ম তার নিজ গুণেই বাজার তৈরি করবে। তার মানে এই নয় যে, বাজারের কথা মাথায় রেখেই শিল্পকর্ম তৈরি করতে হবে। সৃজনের মাঝে একজন শিল্পীর অভিজ্ঞতা ও চিন্তার প্রকাশের পাশাপাশি বাড়তে থাকে শিল্পের মানও। তখন আর বাজার তৈরির জন্য আর বেগ পেতে হয় না শিল্পীকে। ছাপচিত্রের জন্য বিশ্বখ্যাত নোদা। বলেন, এখনও সারাবিশ্বে ছাপচিত্রে পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখা হয়েছে। নিঃসন্দেহে ডিজিটাল পদ্ধতি ছাপচিত্রের কাজকে সহজ করে তুলেছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ছাপচিত্রের কথা বলতে হলে, পুরনো পদ্ধতির দিকে ফিরে যেতে হবে। আমি নিজেও ডিজিটাল পদ্ধতির বদলে পুরনো পদ্ধতিতেই কাজ করে থাকি। সেটা অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী। দীর্ঘদিন ধরেই চারুশিক্ষার্থীদের চিত্রকলা বিষয়ে পড়াচ্ছেন নোদা। সেই সূত্র ধরে শিক্ষার্থীদের কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, শিল্পকর্মের ধারাটা আগের মতোই রয়েছে। কিন্তু সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় চিন্তার পরিবর্তন এসেছে। নতুন আঙ্গিক উপস্থাপিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাজে। ‘ডায়েরি’ শিরোনামে ধারাবাহিক শিল্পকর্মে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছেন তেতসুইয়া নোদা। অর্ধশতাব্দীকাল ধরে এই সিরিজের পাঁচ শতাধিক ছাপচিত্র এঁকেছেন। একবার তার আঁকা সিগারেটে উপচে পড়া ছাইদানি দেখে তার ছেলে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিলেন। আলাপচারিতায় উঠে আসে সেই প্রসঙ্গও। বলেন, সিরিজটি আসলে কবে শেষ হবে, সে বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেইনি। যতদিন ভাল লাগবে ততদিন আঁকব। তেতসুইয়া নোদা জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন শিল্পী হিদিও নোদার ভাইয়ের ছেলে। পারিবারিক এ বন্ধন তার শিল্পী হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছে কি-না জানতে চাইলে বলেন, অবশ্যই। আমার জন্মের এক বছর আগেই মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ছোটবেলা থেকেই বাসায় তার নাম শুনেছি। সেই সঙ্গে তার কাজের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছি। কথা প্রসঙ্গে নোদা বলেন, একসময় আমার অংকে ভীতি ছিল। সেই ভয় থেকেই অংক শেখার পরিবর্তে ধাবিত হয়েছি শিল্পের ভুবনে। ১৯৪০ সালের ৫ মার্চ জাপানের উকিতে জন্মগ্রহণ করেন তেতসুইয়া নোদা। ১৯৫৯ সালে জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস এ্যান্ড মিউজিকে তেলচিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ঝুঁকে পড়েন ছাপচিত্রের প্রতি। ১৯৭৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৯০ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। পৃথিবীর প্রায় সব বড় জাদুঘরের সংগৃহীত রয়েছে তেতসুইয়া নোদার চিত্রকর্ম। তিনি ১৯৬৮ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ইন্টারন্যাশনাল বিয়েনাল এক্সিবিশন অব প্রিন্টেসে ইন্টারন্যাশনাল গ্রান্ড প্রাইজ এবং ১৯৭৭ সালে বিয়েনাল অব গ্রাফিক আর্ট লিজুবালিয়ানায় গ্রান্ড প্রাইজ জয় করেন।
×