ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার তাল

বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ফল- বানানো হয় পিঠা বড়া, সুস্বাদু খাবার

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ফল- বানানো হয় পিঠা বড়া, সুস্বাদু খাবার

সমুদ্র হক ॥ শরতকাল পড়েছে আর তাল পড়বে না, তা কি হয়! এ কি যেমন তেমন তাল! বাঙালীর সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ফল তাল। তালের কত রূপ। তাল খুর (মে মাসের দিকে ওঠা তালের শাস) আহা কি সুস্বাদু। আর ভাদ্র আশ্বিন মাসের তাল! কত পদের যে পিঠা আর সুস্বাদের খাবার তৈরি হয় এই তাল দিয়ে! তালের পিঠা, তালের বড়া, তালের পায়েস, ফিরনী, তালের ক্ষির, এই ক্ষির দিয়ে পাটিসাপটা পিঠা...আরও যে কত কি! হালে তাল দিয়ে নানা খাবারের রেসিপি তৈরি হচ্ছে। তালকে নিয়ে অনেক কথাও আছে। বাংলার বাগবিধিতে আছে, পিঠে তাল পড়ার কথা। সঙ্গীতে আছে সুরের তাল। কেউ উলটপালট কথা বললে, আনন্দে ও কোন কারণে ধৈর্যচ্যুতি হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করলে বলা হয় -গ্যাছে বেতাল হয়ে। বেসুরো গান, তবলার বোল কেটে গেলে বলা হয়- তাল কেটে বেতাল হয়েছে। এলোমেলো কিছু করলে বলা হয়- তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। এক শ্রেণীর মানুষ কারও কাছে ভাল সেজে থাকতে, স্তুতি ও স্তাবকতায়, মোসাহেবি করতে তাল মিলিয়ে কথা বলেন। হিপোক্র্যাটরা এই কাজটি খুব নিখুঁতভাবে করতে পারেন। ভিলেজ পলিটিকস, চাকরি জীবনে তাল মিলিয়ে চললে ওপরে ওঠা কঠিন নয়। প্রেমে মন পেতেও তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তা না হলে দুঃখ আছে। ভাদ্র মাসের গরমে তাপের মাত্রা বেড়ে গেলে বলা হয়, তাল পাকানোর গরম। প্রকৃতিই পিন্ডাকৃতির সুপক্ব ফলটি পাকিয়ে ঘন লালচে রঙের করে দিতে তাপ বাড়িয়ে দেয়। এই তালপাতার পাখা গরমে স্বস্তির উপকরণ। এক সময় তালপাতায় লেখা হতো। ছিপছিপে গড়নের কোন লম্বা মানুষকে দেখলে আজও বলা হয় তালগাছ। প্রকৃতির আর্কিটেক্ট বাবুই পাখি বাসা বাঁধে এই তাল গাছে। এই তাল গাছ ওদের পছন্দ। সরু ডগায় খড়কুটা দিয়ে যে বাসা বানায় তা চিরকালের ক্লাসিক শিল্পকর্ম হয়ে আছে। বিজ্ঞানীরা আজও গবেষণা করেন বাবুই পাখির শৈল্পিক এই বাসা নিয়ে। শরতে ও হেমন্তে তালের মৌসুমে ঘরে তাল পিঠা, তালের ফিরনি পায়েস ক্ষির-বড়া না খেলে আজও মুরুব্বীগণ মনে কষ্ট পান। সামজিক বিশ্লেষণ হলো, মৌসুমের ফল ফলান্তি খেতে হয়। তবে তালের রস নিয়ে কথা আছে- গাছ চুইয়ে সংগ্রহ করা টাটকা রসের দ্রব্যগুণ আছে, যা শরীরে ফিল্টারের কাজ করে। বিপাকে পড়তে হয় সংগৃহীত রস বিলম্বে পান করলে- তখন বেতালই নয় সমতল ভূমিকেও চোখে অসমতল দেখা যায়। গ্রামের সুন্দর দৃশ্য আঁকতে তাল গাছ জুড়ে না দিলেই নয়। একটা সময় লম্বা ঋজু একহারা চেহারার তালগাছ নেই এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যেত না। দূর থেকে দেখা যায় এমন তাল গাছ ছিল গাঁয়ের কোন বাড়ি চেনার দিক নির্দেশক। গেল শতকের মধ্যভাগের পর গ্রামে তালগাছ কমে যাওয়া শুরু হয়। অন্যতম কারণ ছিল, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে খন্ডিত পরিবার শুরু হওয়া। বাড়ির ধারের তালগাছ কাটা শুরু হয়। তবে একবিংশ শতকে এই তাল গাছ বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমাতে বড় ভূমিকা পালন করছে। ফের তাল গাছ রোপন শুরু হয়েছে। এখন শুধু বাড়ির আঙ্গিনায় নয়, রাস্তার দুই ধারে তাল গাছ রোপন করা হচ্ছে। আমাদের কাব্যে সাহিত্যে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে তালগাছ। বনফুল তার ‘নুড়ি ও তালগাছ’ নামের গল্পটিতে যা সৃষ্টি করছেন তা অমর হয়ে আছে। সাহিত্যানুরাগীদের কাছে বনফুল মানে বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন। এই গল্পের বর্ণনায়- বিশাল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ এক তালগাছ। তলায় পাথরের ছোট্ট নুড়ি। ঘাসই তার ভুবন। উঁচু তালগাছ তার কাছে বিস্ময়। নুড়ি গাছকে জিজ্ঞাসা করে- কে আপনি? অত উঁচুতে কী দেখেন। এভাবেই গল্পের গতি নিপুণ ছন্দ নিয়ে এগিয়ে যায়। তালপাতার পুঁথি ও তালপাতার সেপাইয়ের কথা কে না জানে। কেচ্ছা ও শিশু সাহিত্যেও তালগাছকে নিয়ে অনেক মজা আছে। বিশাল পাথারে এক তালগাছ তাতে মামদো ভুতর বাস। কেচ্ছায় ভরদুপুরে বিলের ধারে, সন্ধ্যায়, ভোর রাতে, গভীর রাতে তালগাছের নিচ দিয়ে যেতে কে কখন ভয়ে দাঁত লেগে পড়ে গেছে এ নিয়ে কতই না গপ্প গ্রামে ছড়িয়েছে দূর অতীতে। তাল গাছে ভুতপেত্নি না থাক পিঠে তাল পড়লে ক্যাঁক্যু করতে হতে পারে। চিরচেনা তালগাছের আদি নিবাস আফ্রিকায়। বহুকাল আগে এই দেশে তার আগমন। বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন বোরাসুস ফ্লাবেলিয়ার। খুবই ধীরে বাড়ে। বসন্তের শেষে ফুল ধরে ফল পাকে শরতে। পোক্ত কান্ডের গাছ ঘরের শক্ত খুঁটি হিসেবে ব্যবহার হয়। তালের আঁশ দিয়ে হস্তশিল্পের নানা কিছু তৈরি হচ্ছে। কুটির শিল্পে পরিণত হয়ে রফতানি হচ্ছে। আফ্রিকার তাল তাল মিলিয়ে দাপটেই আছে....। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে-ই কবে ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে....’ এমন কবিতায় তালের ছন্দ এনে দিয়েছেন। সেই ছন্দ চিরন্তন হয়ে আছে।
×