ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ডিজিটাল জয়যাত্রা

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 বাংলাদেশের ডিজিটাল জয়যাত্রা

(গতকালের পর) স্বাস্থ্য সেবায় ডিজিটাল বিপ্লব প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে গেছে স্বাস্থ্য সেবার সনাতন পদ্ধতি। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় তাল মিলিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে আরও সহজ করে তুলতে গবেষণার অন্ত নেই। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রান্তিক জনগণের স্বাস্থ্য সেবায় এগিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানকে অর্থ বরাদ্দসহ যাবতীয় সহযোগিতা করছে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি রিজিওনাল হেলথ ইনফরমেটিকস কনফারেন্স এর সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে দেশে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্যভান্ডার’ ও ১০ বছর মেয়াদী ‘হেলথ কার্ড চালু করার পরিকল্পনার কথা জানান। ইতোমধ্যে বাজারে এসেছে নানা এ্যাপ যা স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ্যাপস ও স্মার্ট ডিভাইসসমূহের মধ্যে সিমেড স্মার্ট হেলথ ডিভাইস, অগমেডিক্স, ‘জলপাই’ আইফোন হেলথ এ্যাপ, স্মার্টওয়াচ হেলথ এ্যাপ, ডাক্তারভাই এ্যাপ, টনিক হেলথ এ্যাপ, মেডিটর হেলথ এ্যাপ, মায়া এ্যাপ, মেডিক্যাল রোবট, আপনজন’ কর্মসূচী, স্বাস্থ্য বাতায়নের মতো কিছু এ্যাপস কিংবা ডিভাইস জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অংশ হিসেবে চিকিৎসাসেবায় প্রযুক্তির সাহায্যে টেলিমেডিসিন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকার বড় বড় হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে পারছে। এছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মোবাইল ফোন ও ই-মেইলের মাধ্যমেও এসব রোগীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে। টেলিমেডিসিন সেন্টারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিতে অতিরিক্ত কোন ফি রোগীকে দিতে হয় না। টেলিমেডিসিন সেন্টারে রোগী দেখানোর আউটডোর চার্জ ১০টাকা। বাকি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চিকিৎসকরা বিনামূল্যে করে দেন। তারা ঢাকার চিকিসৎকদের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্টের ও ব্যবস্থা করে দেন। আর যদি ওই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি সরকারী হাসপাতালে না থাকে, তবে তারা প্রাইভেট ক্লিনিক বা ল্যাবরেটরি থেকে করে নিয়ে আসেন। এ সেবার আওতায় মেডিসিন, সার্জারি, অবস অ্যান্ড গাইনি, কার্ডিওলজি, চক্ষু ও নাক-কান-গলার রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতালের নিয়মিত চিকিৎসকরা কর্তৃপক্ষের দেয়া রোস্টার অনুযায়ী প্রতিদিন এ টেলিমেডিসিন পরামর্শ ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। এছাড়া সাপ্লাই চেইন ওয়েবপোর্টালের মতো নানা ধরনের ওয়েবপোর্টাল তৈরি করে গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সেবাদানের পদ্ধতিকে ডিজিটালাইজেশন করা হচ্ছে। প্রসূতি ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু বিলম্বের কারণে জীবনের ঝুঁকি বাড়ে। এর মধ্যে রয়েছে হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যাতায়াত ও স্বাস্থ্যকর্মীর প্রস্তুত হওয়ার বিলম্ব। তথ্যপ্রযুক্তি এসব বিলম্ব ও সমস্যা অনায়াসেই দূর করতে পারছে। গুরুতর অসুস্থ রোগী পরিবহনে মোবাইল থেকে ১৬২৬৩ নম্বরে একটি কল দিলেই এ্যাম্বুলেন্স সেবা পাওয়া যাচ্ছে। মানুষ চব্বিশ ঘণ্টা যাতে এ্যাম্বুলেন্স সেবা পায় সে লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার জন্য ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ নামে কল সেন্টার চালু করা হয়েছে। ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ বা এ্যাপনিয়া রোধে কাজ করছে নিওজিয়া। এর তৈরি ‘মসিও এইচডব্লিউ’ নামের বিশেষ পরিধানযোগ্য স্মার্ট ডিভাইস যা সমস্যা চিহ্নিত করে ঘুমকে স্বাভাবিক করবে। ‘টেম্পট্রাক’ এক ধরনের স্মার্ট সমাধান নিয়ে এসেছে যা শিশুর অভ্যন্তরীণ অবস্থা ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করবে এবং সব ডাটা মোবাইলে প্রেরণ করবে। কার্ডিওকোর এফডিএর অনুমোদন নিয়ে তারও কোন ধরনের প্যাঁচ ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিশেষ ধরনের বুকের বেল্ট বাজারে নামানোর ঘোষণা দিয়েছে। এটির কাজ হবে ইসিজি, হার্টরেট, হার্টরেটের কমবেশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার, ত্বকের তাপমাত্রা নিরীক্ষা এবং ডাটা সংরক্ষণ, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ্যাপের মাধ্যমে পাওয়া যাবে ও মেডিকেল স্পেশালিস্টদের কাছে পাঠানো যাবে। ব্যক্তিগত ফিটনেস ট্র্যাকার ব্যক্তি বিশেষে ঘুম, হাঁটা, ক্যালরি একেক ধরনের প্রয়োজন। প্রতিদিন ঘুম, ক্যালরি কমানো, হাঁটার পরিমাণ, হার্টরেট ইত্যাদি সংরক্ষণ করে এসব ঠিক কতটুক দরকার তা জানিয়ে দেবে ‘মিওস্লাইস’। হাতে পরিধানযোগ্য এই ডিভাইসটি হতে পারে ব্যক্তিগত ফিটনেস ট্র্যাকার। ট্রুব্রেথ ঘুমের জন্য ডিভাইস ও এ্যাপসের সমন্বয়ে স্বয়ংক্রিয় সমাধান নিয়ে এসেছে। হাতে পরিধানযোগ্য ডিভাইসটি ব্লুটুথের মাধ্যমে এ্যাপসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। ব্যবহারকারীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ধারা পর্যবেক্ষণ করে ডিভাইসটি এ্যাপসে ডাটা প্রেরণ করবে। এর পরে সেই ডাটা অনুযায়ী উপযোগী মেলোডি পরিবেশ তৈরি করবে, যা মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে সহজেই ঘুম এনে দেবে। ঘুম নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না ভুক্তভোগীদের এমনকি ভিন্ন কোন কসরতও করতে হবে না আর। হাসপাতালে দীর্ঘ লাইন ও টেস্ট প্রতি অতিরিক্ত খরচ বাঁচাতে জনপ্রিয় হচ্ছে হেলথ টুলস। এর মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ায় আগেই স্বাস্থ্যঝুঁকি পরিমাপ করে অনেকক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। স্মার্ট টুলস ও মোবাইল এ্যাপসের সমন্বয়ে ব্লাড পেসার, পালস, ব্লাড অক্সিজেন স্যাচুরেশন, শরীরের তাপমাত্রা, ওজন ও উচ্চতা অনুযায়ী ওবিসিটি পরীক্ষাসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে অনেকেই। চিকিৎসক ও নার্সের সঙ্কট মেটাতে মেডিকেল রোবটকে ডাক্তার বা নার্সের পরিপূরক হিসেবে কাজে লাগাতে স্বয়ংক্রিয় মেডিকেল রোবট তৈরি করেছেন বাংলাদেশের একদল গবেষক। রোবটটির নাম দেয়া হয়েছে ‘ডক্টোবোট’। নতুন রোবট ‘ডক্টোবোট’ রোগীর হার্টবিট মেপে আউটপুট ডিসপ্লেতে শো করবে, যা রোগীকে দেখাবে। শুধু রোগীকেই নয়, বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে রোগীর চিকিৎসক ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেখতে পারবেন। ২০০৯ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রদান কার্যক্রম শুরু করা হয়। বর্তমানে দেশের সবকটি ইউনিয়ন ও তথ্যসেবা কেন্দ্রে এ সেবা দেয়া হচ্ছে। জেলা-উপজেলার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে এ সেবা। কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানও ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু শিশু ও মাতৃ মৃত্যু হ্রাসে জাতিসংঘের পুরস্কারও লাভ করেছে বাংলাদেশ। দেশ বিদেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত এসব এ্যাপস ও স্মার্ট ডিভাইসের সাহায্যে আক্রান্ত হওয়ার আগেই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া ন্যানো প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রে যুগান্তর আসছে। এতে করে উন্নত ইমেজিং প্রযুক্তি, দক্ষ ড্রাগ-ডেলিভারি ও ডায়াগনোস্টিক প্রক্রিয়ার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে ক্যান্সারাক্রান্ত ব্যক্তিকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×