ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিরাপদ অভিবাসন সময়ের দাবি

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 নিরাপদ অভিবাসন  সময়ের দাবি

বিপুল জনসংখ্যার দেশ বলে বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থানের একটি স্বীকৃত সেক্টর ‘অভিবাসন’। এ সেক্টর থেকে বৈধপথে রেমিটেন্স আহরণ যেমন দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেমনি এই আয় অভিবাসী কর্মী ও তার পরিবার-পরিজনের জীবনমান উন্নয়নেরও একটি দৃশ্যমান চিত্র। বর্তমানে পৃথিবীর ১৬৫ দেশে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ বাংলাদেশী দক্ষ, স্বল্পদক্ষ এবং অদক্ষ অভিবাসী কর্মী রয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রায়শই প্রশ্ন ওঠে এ সকল অভিবাসী কর্মী নিরাপদে আছেন কি-না? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজকের এই লেখার অবতারণা। ডিজিটাল মিডিয়ার গুণে আজকাল দ্রুত গতিতে যে কোন খবর পৌঁছে যায় পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে। একইভাবে বাংলাদেশের অভিবাসী কর্মীরা কে কোথায় এবং কোন্ দেশে অনিয়মিতভাবে বা আনডকুমেন্টেড হয়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তা আর অজানা থাকে না। এক সময়ের জনপ্রিয় উবংঃরহধঃরড়হ মধ্যপ্রাচ্য এখন আর শেষ লক্ষ্য নয় বরং এদেরই কোন কোন দেশ অনিয়মিত কর্মীদের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে বলে শোনা যায়। যারা ইউরোপগামী (ইতালি, গ্রীস প্রভৃতি দেশ) হতে চান তারা অনেকেই ব্যবহার করেন দুবাই-ইরান-তুরস্ক রুট। অপরদিকে যারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যেতে চান তাদের অধিকাংশই ব্যবহার করেন লিবিয়া, সুদান, মিসর রুট। লিবিয়ার সঙ্কট সঙ্কুল পরিবেশে যেখানে নামমাত্র আইনশৃঙ্খলা বিরাজমান সেখানে বিভিন্ন দেশের অনিয়মিত অভিবাসীরা লিবিয়ার সঙ্কটকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন। জানা যায়, এই মুহূর্তে লিবিয়ার ডিপোর্টেশন সেন্টারে আটক ২ শতাধিক বাংলাদেশী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। খাদ্য, পানীয়ের ন্যায় মৌলিক জীবন উপাদানের অভাবে তারা এক অনিশ্চিত জীবনের সম্মুখীন। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। কিন্তু প্রশ্নও রয়েছে যে তারা কি আসলেই বাংলাদেশী না রোহিঙ্গা? তারা কি কোন সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন নাকি ইউরোপগামী ছিলেন? এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি যারা তাদের জন্য নিরাপদ অভিবাসন সত্যিই এক সোনার হরিণ! আর যারা কোনভাবে ইতালি, গ্রীস প্রভৃতি দেশে ঢুকতে পেরেছেন তাদের প্রায় সকলেই স্বেচ্ছায় পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে হয়েছেন অনিয়মিত এবং তাদের অনেকেই কৃষি শ্রমিক হিসেবে জীবনযাপন করছেন। তারা কাজ করেন ক্ষেতখামারে এবং একই সঙ্গে লুকিয়ে থাকেন সুদূর গ্রামে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতে পুলিশের হাতে ধরা না পড়েন। এমন অনেক অনিয়মিত/আনডকুমেন্টেড অভিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা কেউ কেউ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রয়েছেন প্রবাসে। বৈধ কাগজপত্র/পাসপোর্টের অভাবে অথবা দেশে গমণ করলে পুনরায় সে দেশে আসতে পারবেন না ভেবে দেশে আসেন না। এমন অনিরাপদ অভিবাসন কোনভাবেই কাম্য নয়। অনেকে বৈধপন্থায় বিদেশ গিয়েও পরবর্তীতে আনডকুমেন্টেড হয়ে পড়ছেন এবং তাদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। আমরা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি সংযুক্ত আরব আমিরাতে অসহবংঃু’র সুযোগ দেয়া হয়েছে, মালয়েশিয়াতে দেয়া হয়েছে জব-Hiring-এর সুযোগ। এসব বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়েছে তাদের যারা ছিলেন অনিয়মিত বা আনডকুমেন্টেড। ভিসা এবং চুক্তির মেয়াদের পরও যারা সেসব দেশে অবস্থান করেছেন, ট্যুরিস্ট/ছাত্র ভিসায় গিয়ে যারা অন্যায়ভাবে থেকে গিয়ে অনিয়মিত/আনডকুমেন্টেড হয়েছেন তারাই এখন সুযোগ নিচ্ছেন কিভাবে নিয়মিত হওয়া যায়। আবার অনেকেই বিভিন্ন দালাল ও প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সুযোগ নিচ্ছেন না বলে শোনা যায়। এ ধরনের আচরণ এদেশের ভাবমূর্তিকে বহির্বিশ্বে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। চুক্তির মেয়াদ ভঙ্গ করে কোম্পানি বা মালিক পরিবর্তন বা পলায়নের মাধ্যমে আমাদের অভিবাসী কর্মীরা হচ্ছে অনিয়মিত এবং আনডকুমেন্টেড। এ ধরনের অভিবাসী কর্মীদের ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি। এসব কর্মী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে জঙ্গলে/দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করতেও বাধ্য হচ্ছেন। আবার ‘ফ্রি ভিসা’ নামক ফাঁদে পড়ে অভিবাসী কর্মীরা সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। তাদের নেই কোন কোম্পানি বা মালিকের কাজ। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মরুভূমিতে লুকিয়ে থাকাসহ ভিক্ষাবৃত্তির উদাহরণও আজ আর কম নয়। ইদানীং প্রায়ই শোনা যায় উভয়পক্ষের রিক্রুটিং এজেন্সির লেনদেন চাহিদা মতো না হওয়ায় অনেকসময় বৈধ অভিবাসী কর্মীকেও নিয়োগকারী কোম্পানির প্রতিনিধি এয়ারপোর্টে গ্রহণ করেন না, ফলে তাকে আটক রাখা হয় বা ফেরত পাঠানো হয়। এমন অজ্ঞতা অপরদিকে রিক্রুটিং এজেন্সির দায়িত্বহীনতার কারণে নিরাপত্তাহীন ও অসহায় হয়ে পড়েন অভিবাসী কর্মীটি এবং তার পরিবার। অভিবাসী নারী কর্মীর নিরাপত্তাহীনতাও আজ বহুল আলোচিত। বিশেষভাবে গৃহকর্মী পেশায় গমনকারী নারী কর্মীদের ঝুঁকির বিষয় আমলে না নিয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে যেনতেনভাবে কম বয়সী/বয়স্ক, অক্ষরজ্ঞানহীন এবং Destination দেশের ভাষাজ্ঞানহীন মেয়েদের অজানা/অচেনা দেশে ও পরিবেশে পাঠিয়ে তাদের চরম নিরাপত্তাহীনতা ও ঝুঁকিতে ফেলে দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে দালাল নামীয় মধ্যস্বত্বভোগীর সরব উপস্থিতি অভিবাসী কর্মীকে নিরাপত্তাহীন করে তোলে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দালাল এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে ৮০.৬, রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ১৪.৪ এবং সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন মাত্র ৪.৩ শতাংশ অভিবাসী কর্মী। কিন্তু কেন এই দালাল নির্ভরতা? কারণ, এরা কর্মীটির এলাকার লোক অথবা নিকটতম আত্মীয়। তারা সরকার/রিক্রুটিং এজেন্সির চাইতে তাই বেশি নির্ভরযোগ্য অভিবাসী কর্মী ও তার পরিবারের কাছে। অধিকাংশ সময় দেখা যায় বিপদগ্রস্ত হলে সরকার তথা দূতাবাসের সহায়তা না নিয়ে তথ্য গোপন করে স্বল্প শিক্ষিত/অশিক্ষিত অভিবাসী কর্মীরা বিদেশে আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন এবং অনেক ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন। এতে তারা হয়ে পড়েন অনিয়মিত। পলাতক কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলে তারা হয়ে পড়েন ফেরার, দেশে ফেরত আসা নির্ভর করে ওই দেশের আদালতের সিদ্ধান্ত/মামলা নিষ্পত্তির ওপর। তবে সব রিক্রুটিং এজেন্সি এক নয়। তারা অনেকেই বিদেশী কোম্পানি থেকে কাজের চাহিদা মতো দূতাবাসের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে কর্মীটিকে অভিবাসনে সাহায্য করে থাকেন। অভিবাসী কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিসমূহের দায় অপরিসীম। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩ অনুযায়ী কর্মীটির আইনী অধিকার, নিয়োগকর্তা সম্পর্কে তথ্যাদি, পক্ষদ্বয়ের মধ্যকার চুক্তি সম্পাদন, জরুরী কাগজপত্র সংগ্রহ, ছাড়পত্র গ্রহণ এবং বিদেশে সমস্যা হলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ এর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির। এই আইনে রিক্রুটিং এজেন্সিসের জবাবদিহিতার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে লাইসেন্স নিলে বা অভিবাসী কর্মীকে প্রতারিত করলে বা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন কর্মীর থেকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অর্থগ্রহণ, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া বিদেশে প্রেরণ, অননুমোদিতভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার ইত্যাদি গর্হিত অপরাধ প্রমাণিত হলে বিভিন্ন শাস্তিমূলক বিধান রয়েছে। তবে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দরিদ্র অভিযোগকারী/অভিবাসী কর্মী তার অভিযোগ প্রত্যাহার/মীমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করেন। উল্লিখিত সব কার্যক্রম দ্বারাই একজন অভিবাসী কর্মীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়ে থাকে এবং রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন থাকে। বিভিন্ন দেশের জন্য অভিবাসী কর্মীদের সর্বোচ্চ অভিবাসন ব্যয় সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো সরকার নির্ধারিত ব্যয় অপেক্ষা অধিক অর্থ গ্রহণ এ সময়ের সবচেয়ে বড় অভিযোগ। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩ এর ৪৩ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক এই অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণসহ লাইসেন্স বাতিল বা বিভিন্ন প্রতিকারমূলক বিধান থাকলেও তা প্রমাণিত না হওয়ায় সতর্কীকরণ ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে কোন উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। প্রায়শই সরকারকে অভিযুক্ত করা হয় অভিবাসী কর্মীর নিরাপত্তাহীনতায়। তবে এ কথা আজ মানতেই হবে যে, সরকারের যথাসময়ে হস্তক্ষেপেই বেশিরভাগ কর্মীর জীবন নিরাপদ হয়েছে, বিদেশে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে এবং তারা দেশে ফেরত আসতে পারছেন। আজ এই ক্ষুদ্র পরিসরে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে সরকারী ব্যবস্থাপনার একটি চিত্র তুলে ধরা হলো- সরকার নানা উপায়ে একজন অভিবাসী কর্মীর জীবন সুষ্ঠু ও নিরাপদ করার পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিএমইটির ডাটাবেজে নাম নিবন্ধন, ডাটাবেজ থেকে বিদেশ যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হওয়া, নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় প্রদান, রিক্রুটিং এজেন্সির সহায়তায় নিয়োগকারীর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন যেখানে কর্মীর বেতন, চুক্তির মেয়াদ, আবাসিক সুবিধা ইত্যাদির সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকবে। চুক্তির কপি বিদেশে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে প্রেরণ এবং এই কর্মী ও তার পরিবারের জন্য আর্থিক ও কল্যাণমূলক কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে সরকার কর্মী প্রেরণ নিশ্চিত করতে চায়। বিভিন্ন দেশে চাকরির সুযোগ অনুসন্ধান ছাড়াও বিপদগ্রস্ত কর্মীকে দূতাবাসের মাধ্যমে উদ্ধার করা এ মন্ত্রণালয়ের একটি নিয়মিত কাজ। প্রতিটি অভিবাসী কর্মীর নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, বৈধপথে রেমিটেন্স প্রেরণ এবং দেশ ও তার পরিবারের টেকসই উন্নয়নে অংশগ্রহণই সরকারের মূল লক্ষ্য। নিরাপদ, নিয়মিত, সুষ্ঠু এবং সুশৃঙ্খল অভিবাসন তাই আজ সময়ের দাবি। লেখক : সচিব প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
×