ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে অনুপ্রবেশ করা লাখ লাখ রোহিঙ্গার কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ এবং জলবায়ুর ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির তৈরির জন্য ধ্বংস করা হয়েছে অন্তত সাড়ে সাত শ’ কোটি টাকার গাছপালা। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের জায়গা করে দিতে উখিয়া টেকনাফে নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে অসংখ্য পাহাড়-টিলা। রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি ও এনজিওগুলোর স্থাপনা নির্মাণে সমতল করে ফেলা প্রাকৃতিক ওসব পাহাড় আর কখনও বানানো যাবে না। উখিয়া টেকনাফে ৬ হাজার একর জমিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প তৈরির ফলে গোটা এলাকার বন উজাড় হয়ে গেছে। কেটে ফেলা হয়েছে সব গাছপালা। উখিয়া টেকনাফে অর্ধশতাধিক সবুজ পাহাড় বর্তমানে ন্যাড়া হয়ে গেছে। এতে প্রায় ৭৪১ কোটি ৩১ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। রাখাইন রাজ্য থেকে অনুপ্রবেশকরা ওইসব রোহিঙ্গার আশ্রয়ে বাংলাদেশকে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা দেশের অর্থনীতি ও সার্বিক নিরাপত্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ এবং জলবায়ুর ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বন, পাহাড় ও কৃষিজমি ধ্বংস হওয়ায় মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ। পাশাপাশি রয়েছে সংক্রামক ব্যাধি ও নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা। শুধু উখিয়া টেকনাফে নয়, ১২ লাখ রোহিঙ্গার বিরূপ প্রভাব পড়েছে কক্সবাজার জেলার জনগোষ্ঠী ও জনপদের ওপর। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে পরিবেশ ও জনপদের ওপর। বন উজাড়, পাহাড় কাটা, পরিবেশ বিপর্যয় ও সংক্রমণ ব্যাধির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে উখিয়া ও টেকনাফ। রোহিঙ্গাদের কারণে গত এক বছরে ৬ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে শুধু তাই নয়, স্থানীয়দের ১শ’ একরের বেশি কৃষি জমি বেদখল হয়ে রয়েছে। ওই কৃষি জমিগুলোতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করত স্থানীয় কৃষকরা। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম যতই বিলম্ব হচ্ছে, তত বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা। ছিনতাই, ডাকাতি এমনকি খুনের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আলী কবির বলেন, শুধু বন উজাড় নয়, গাছের শিকড় পর্যন্ত উপড়ে ফেলা হয়েছে। এতে পরিবেশের ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সচেতন মহল বলেন, দেশী-বিদেশী অনেক সংস্থা ও সংগঠনের কাছে বর্তমানে ত্রাণ বিতরণ ও রোহিঙ্গা সেবা প্রদান একটি রমরমা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে ওসব মহল প্রত্যাবাসন বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একটি মানবিক সাড়াপ্রদান নিয়ে বাণিজ্য অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষকরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলা শুধু বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া চলবে না। রাখাইনে যখন সহিংসতা চলছিল, তখন বাংলাদেশে আশ্রয় না দিলে হয়ত সেখানে মারা যেত লাখ লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ মানবতা দেখিয়েছে বলেই পুরো রোহিঙ্গা সঙ্কটের দায়ভার বাংলাদেশকে চাপিয়ে দিলে চলবে না। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের নিজ গৃহে ফিরে যাওয়ার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করতে হবে মিয়ানমারকে। এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার দায় বাংলাদেশ একা নিতে পারবে না। কারণ এর জন্য কোনভাবেই দায়ী নয় বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সঙ্কট মিয়ানমারের। সমাধানও করতে হবে মিয়ানমারকে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন তারা। অভিজ্ঞজনরা বলেন, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার সময় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় না দিলে রাখাইন রাজ্যে মারা যেত বহু মানুষ। জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া ছাড়া ওইসময় বাংলাদেশের কোন বিকল্প ছিল না। মানবিক কারণে সীমান্ত খুলে দিলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে প্রাণে রক্ষা পায়। পরবর্তীতে ওসব রোহিঙ্গাকে পুঁজি করে জঙ্গী সংগঠনের নেতারা ও কিছু এনজিও ত্রাণ বাণিজ্যে মরিয়া হয়ে উঠে। ত্রাণ বিতরণের নামে ক্যাম্পে প্রবেশ করে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে না ফেরার ইন্ধন দেয় তারা। মানবতার সুযোগ নিয়ে পুরনো রোহিঙ্গা নেতা (জঙ্গী) ও কিছু এনজিও সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের পথে নামিয়ে সড়ক অবরোধ করে মিছিল সমাবেশ করার দুসাহস কোথায় পেয়েছে? ২৫ আগস্ট পালন উপলক্ষে রোহিঙ্গাদের ডিজিটাল ব্যানার ও হাজার হাজার টি-শার্ট সরবরাহ করেছে কারা? রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের দোহাই তুলে বিদেশ থেকে অর্থ এনে কিছুটা বিলিবণ্টনের ভিডিও এবং ছবি ইন্টারনেটে বিদেশে পাঠিয়ে সিংহভাগ অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে কারা? এসব বিষয়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেন স্থানীয়রা। দ্রুত প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করার দাবি জানিয়ে তারা বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া ছাড়াও বাংলাদেশের জন্য তত বেশি সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেন, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বর্তমানে বিভিন্ন ব্যবসা ও শ্রম কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এতে প্রায় বেকার হয়ে পড়ছে স্থানীয় দিনমজুররা। স্বল্পমূল্যে খাটানো যায় বলে এনজিও কর্মীরা রোহিঙ্গাদের দিনমজুর হিসেবে কাজ করাচ্ছে প্রতিদিন। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে দোকান বসিয়ে ক্যাম্প অভ্যন্তরে পণ্য বিকিকিনি করছে। অথচ আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুসারে আশ্রিত ব্যক্তিরা আশ্রয় শিবিরে বসবাস করবে, কোন ধরনের বাড়তি আয়-রোজগার করতে পারে না। এমনকি যে দেশে আশ্রিত, ওই দেশের মুদ্রাও তারা রাখতে পারে না। ৮ রোহিঙ্গা নারী-পরুষ অনেকে মাসিক বেতনে চাকরিও করছে বিভিন্ন এনজিও সংস্থায়। উখিয়া টেকনাফ এলাকার ৩০ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের কাছে রয়েছে অন্তত ৪ লক্ষাধিক সিম, ল্যাপটপ ও দামী মোবাইল সেট।
×