ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মিথ্যাচার, ভুয়া ছবিতে বিভ্রান্তির জাল

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মিথ্যাচার, ভুয়া ছবিতে বিভ্রান্তির জাল

বিডিনিউজ ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কটের ‘আসল সত্য’ প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রকাশিত নতুন একটি বইয়ে পুরনো সাদা-কালো একটি ঝাপসা ছবি প্রকাশিত হয়েছে; যেখানে দেখা যাচ্ছে, এক লোক কৃষিকাজে ব্যবহৃত নিড়ানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই লাশের পাশে। ক্যাপশনে বলা হয়েছে- ‘স্থানীয়দের নির্মমভাবে হত্যা করেছে বাঙালীরা’। ছবিটি প্রকাশ করা হয়েছে ওই বইয়ে ১৯৪০ এর দশকে মিয়ানমারের দাঙ্গার অধ্যায়ে। ছবির বিবরণে বর্মী ভাষায় বোঝানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের হাতে বৌদ্ধ হত্যার ছবি। বইটিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনের মুসলিম রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করেছে ‘বাঙালী অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে। কিন্তু খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেছে, ওই ছবি আসলে তোলা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, যখন লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। গত জুলাইয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ‘ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক রিলেশন্স এ্যান্ড সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’ থেকে প্রকাশিত ওই বইয়ে এ রকম তিনটি ভুয়া ছবি পাওয়া গেছে যেগুলো রাখাইন অঞ্চলের আর্কাইভ ছবি বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই তিনটি ছবির মধ্যে দুটি তোলা হয়েছে বাংলাদেশ ও তাঞ্জানিয়ায়। মিয়ানমার ছেড়ে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের আরেকটি ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। এসব ছবির বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ হাতোই বা সেনাবাহিনীর মুখপাত্রের বক্তব্য সাংবাদিকরা জানতে পারেননি। মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব উ মায়ো মিন্ট মং মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, ওই বই তিনি পড়ে দেখেননি। ‘মিয়ানমারের রাজনীতি ও সেনাবাহিনী: প্রথম পর্ব’ নামে ১১৭ পৃষ্ঠার ওই বইয়ে গত বছরের আগস্টের পর শুরু হওয়া সামরিক অভিযান নিয়ে সেনাবাহিনীর ভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর হিসাবে, সেনাবাহিনীর ওই অভিযানে পাইকারী হত্যা, ধর্ষণ আর জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। বইটিতে প্রকাশিত বেশিরভাগ তথ্যের উৎস হিসেবে সেনাবাহিনীর ‘ট্রু নিউজ’ ইউনিটের কথা বলা হয়েছে। গত বছর সঙ্কটের শুরু থেকেই ওই ইউনিট সেনা প্রেক্ষিত থেকে ঘটনাপ্রবাহের ‘সংবাদ’ দিয়ে আসছে ফেসবুকে। মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াংগুনের সব বইয়ের দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে সেনাবাহিনী প্রকাশিত বইটি। শহরের অন্যতম বড় বইয়ের দোকান ইনবার এক কর্মী জানান, তারা ৫০ কপির অর্ডার দিয়েছিলেন, সেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। বইটি নতুন করে আনার কোন পরিকল্পনা তাদের আপাতত নেই। কারণ, খুব বেশি মানুষ ওই বই নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। গত সোমবার জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ থেকেই রাখাইনের অভিযানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ কয়েক জেনারেলকে বিচারের মুখোমুখি করতে বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। একই দিনে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানায়, বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধানসহ শীর্ষ জেনারেলদের ১৮টি এ্যাকাউন্ট ও ৫২টি পৃষ্ঠা তারা বন্ধ করে দিয়েছে। ‘মিয়ানমারের রাজনীতি ও সেনাবাহিনী : প্রথম পর্ব’ বইয়ে রাখাইনের অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, বর্তমান সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে ‘বাঙালী সন্ত্রাসীদের’ কারণে, তাদের উদ্দেশ্য ‘আরকিস্তান’ নামে রোহিঙ্গা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েক ডজন নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার জবাবে সেনাবাহিনী ওই নির্মম দমন অভিযান শুরু করে। জাতিসংঘ বলছে, সেনাবাহিনীর ওই অভিযানে এ পর্যন্ত দশ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ওই হামলার জন্য ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ নামের এক সংগঠনকে দায়ী করে আসছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তবে সংগঠনটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করে আসছে। বর্মী সেনাদের বইয়ে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস খোঁজারও একটি চেষ্টা করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা নিজেদের রাখাইনের স্থানীয় বাসিন্দা বলে দাবি করে এলেও ওই বইয়ে তাদের দেখানো হয়েছে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে। বইয়ের মুখবন্ধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চিয়াও চিয়াও লিখেছেন, রাখাইনে ‘বাঙালীদের ইতিহাস প্রকাশ্যে আনতেই’ তারা ‘প্রামাণ্য ছবিসহ’ এই সংকলনটি করা হয়েছে। দেখা গেছে, যখনই মিয়ানমারে কোন রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে বা কোন ধরনের জাতিগত সহিংসতা হয়েছে, ওই বাঙালীরা ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে। ওই বইয়ে ভুয়া ছবি ব্যবহারের বিষয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চিয়াও চিয়াওর বক্তব্য সাংবাদিকরা জানতে পারেননি। ছবিগুলো পরীক্ষা করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে গুগলের রিভার্স ইমেজ এবং টিনআইয়ের মতো সাধারণ পদ্ধতি, যা ছবির উৎস যাচাইয়ের জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো প্রায়ই ব্যবহার করে থাকে। ওই বইয়ে থাকা ৮০টি ছবির মধ্যে বেশিরভাগই সাম্প্রতিক ছবি। বেশিরভাগ ছবিই মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। আর কিছু ছবি নেয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’র পোস্ট করা ভিডিও থেকে। যে আটটি ছবিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, তার মধ্যে তিনটি ছবি পরীক্ষায় ভুয়া প্রমাণিত। বাকি ছবিগুলোর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ঝাপসা হয়ে আসা একটি সাদা-কালো ছবিতে দেখা যায়, অসংখ্য মানুষ গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে পাহাড়ী পথ ধরে কোথাও যাচ্ছে। তার ক্যাপশনে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি মিয়ানমারের দক্ষিণ অংশ দখল করে নেয়ার পর বাঙালীরা এ দেশে প্রবেশ করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বোঝাতে চেয়েছে, ওই ছবি ১৯৪৮ সালের আগের, মিয়ানমারের কোন এলাকার। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে রুয়ান্ডায় তোলা একটি রঙিন ছবিকে বিকৃত করেই সেনাবাহিনীর বইয়ের ওই ছবি তৈরি হয়েছে। রুয়ান্ডায় সহিংসতার পর হুতু শরণার্থীদের দেশত্যাগের ওই ছবি তুলে পিটসবার্গ পোস্ট- গেজেটের আলোকচিত্রী মার্থা রিয়াল পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। ওই ছবি ব্যবহারের জন্য মিয়ারমারের সেনাবাহিনী অনুমতি নিয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে পিটসবার্গ পোস্ট-গেজেটের বক্তব্য জানা যায়নি। সাদা-কালো আরেকটি ছবিতে দেখা যায় বেহাল চেহারার একটি নৌকা বোঝাই মানুষ। তাতে ক্যাপশন- ‘সাগরপথে মিয়ানমারে ঢুকছে বাঙালীরা।’ আসলে ওই ছবিটি তোলা হয় ২০১৫ সালে ইয়াঙ্গুনে। ওই সময় লাখ লাখ মানুষ নৌকায় করে সাগরপথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছিলেন। বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের বহনকারী এ রকমই একটি নৌকা সে সময় মিয়ানমারের নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। আসল ছবিটি উল্টে দিয়ে সেটি সাদা-কালো আর ঝাপসা করে ব্যবহার করা হয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বইয়ে, যাতে ছবিটি অনেক পুরনো মনে হয়।
×