ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণে বছরে ব্যয় ২ হাজার কোটি

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণে বছরে  ব্যয় ২ হাজার কোটি

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ জুলাই মাসে নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে আশ্রিত অর্থাৎ অনুপ্রবেশকারী ও শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬। সরকারী নিবন্ধনে এদের নাম দেয়া হয়েছে মিয়ানমারের নাগরিক। ভিনদেশী কিন্তু আশ্রিত এসব বিশাল জনগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারী-বেসরকারী এবং বিদেশী সাহায্য নিয়ে যে সহায়তা দেয়া হচ্ছে তার বিপরীতে ব্যয়িত অর্থের একেবারে সঠিক হিসাব মূল্যায়ন করা দুরূহ। এরপরও বিভিন্ন সংস্থার হিসেব অনুযায়ী এসব রোহিঙ্গার জন্য প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬ কোটি টাকা যোগান দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। সে হিসাবে এই অর্থের পরিমাণ মাসে ১৮০ কোটি টাকা। বছরে দাঁড়ায় ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ যোগান শুধু যাচ্ছে খাদ্য সহায়তায়। এর বাইরে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরও বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয়। তবে রোহিঙ্গা আগমনের এক বছর শেষে প্রথম দফায় ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ বর্তমান টাকার অঙ্কের চেয়ে বহু বেশি। সরকার চলতি বছরের বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য এককভাবে ৪শ’ কোটি টাকার অর্থ বরাদ্দ রেখেছে। বিদেশী বিভিন্ন দেশের এবং সাহায্য সংস্থার আর্থিক অনুদানের যে ঘোষণা রয়েছে তা এখনও পাইপ লাইনে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এগারটি দেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের পরিমাণ খুব বেশি নয়। বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব বরাবরে প্রেরিত একটি রিপোর্টে এসব রোহিঙ্গার জন্য ত্রাণ ভা-ারে এ পর্যন্ত যে সহায়তা পাওয়া গেছে তার একটি চিত্র মিলেছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রোহিঙ্গা সেল উখিয়া, টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মিয়ানমার নাগরিকদের মাঝে চলমান ত্রাণ কার্যক্রম মানবিক সহায়তা ও আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নতুন রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬ লাখ ৯৩ হাজার ১৪ জন। পুরনোসহ নিবন্ধিত মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। এরমধ্যে ইতোপূর্বে এসে আশ্রয় গ্রহণকারী যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থীর মর্যাদা পেয়েছে এ সংখ্যা ৩৩ হাজার ১৩১ জন। এসব রোহিঙ্গার থাকার ব্যবস্থা করতে গিয়ে সরকার ভূমি বরাদ্দ করেছে ৬ হাজার একর। ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১৪টি। গেল শীত মৌওসুমে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে ১০ লাখ ৮৬ হাজার ৭৩টি। মেডিক্যাল ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ২১৯টি। যার মধ্যে সরকারী ৫০ ও বেসরকারী ১৬৯। পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থেকে গর্ভবতী ১ লাখ ৬ হাজার ৩৭৩ জনকে, ৩ হাজার ১১৭ জনকে প্রসবকালীন, ১৬ হাজার ১৩৫ জনকে প্রসব পরবর্তী, ৯৭ হাজার ৩৯৭ শিশুকে, ২ লাখ ৫৬ হাজার ১২৫ সাধারণ রোগী, ৬০ হাজার ৪৫০ জনকে প্রজনন সেবা প্রদান করা হয়েছে। স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির জন্য নলকূপ ৮ হাজার ১৭০, টয়লেট ৫০ হাজার ৫০৮, গোসল খানা ১১ হাজার ১৯০, বিশুদ্ধ পানি ১ লাখ ১৮ হাজার লিটার, ১২২ ড্রাম ব্লিচিং পাউডার, ১০ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিদ্যুত লাইন স্থাপন, ৪টি মোবাইল চার্জিং পয়েন্ট, ৫০টি স্ট্রিট লাইট, ১০টি ফ্লাডলাইট, ১ হাজার ৪০টি সৌরবাতি স্থাপন করা হয়েছে। সংযোগ সড়ক নির্মাণ হয়েছে ৩০ কিলোমিটার। কুতুপালং ও বালুখালিসহ অন্যান্য ক্যাম্প এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার। এর মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার ৯২৬টি ঘরের উন্নয়ন করা হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত শনাক্তকৃত ৩৯ হাজার ৮৪১ অনাথ শিশুকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে, যার মধ্যে ১৯ হাজার ৬৯ ছেলে এবং ২০ হাজার ৭৮২ জন মেয়ে। আবার ৮ হাজার ৩৯১ শিশুর কারও বাবা-মা নেই। প্রেরিত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, কক্সবাজার সদর জিলংজা খাদ্য গুদাম ও উখিয়া কলেজ মাঠে চার অস্থায়ী গুদাম থেকে ৭ হাজার ৯২৪ টন ডাল, ৭৫ হাজার ৮২৬ লিটার ভোজ্যতেল, ১৮০ টন লবণ, ১ হাজার ৪৩৪ টন চিনি, ২ হাজার ৩০ বস্তা দুধ, ১৯৪ বস্তা শুঁটকিসহ আনুষাঙ্গিক আরও ত্রাণ সহায়তা সরবরাহ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার সোনালী ব্যাংকের রোহিঙ্গাদের জন্য বর্তমানে নগদ জমা রযেছে ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪৬১ টাকা। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের পক্ষে দেয়া এবং সেনা সংস্থার কাছে জমা রয়েছে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। লাখ লাখ রোহিঙ্গার জন্য সরকারী পর্যায় ছাড়াও ১২২টি এনজিও নানামুখী সেবা ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ কার্যক্রমে ৭৮৭ কোটি ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৪৬৬ টাকা অনুমোদন দিয়েছে এনজিও এ্যাফেয়ার্স ব্যুরো। প্রতিবেদনে আরও তুলে ধরা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনার পর থেকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ৯ হাজার ৭৯২ ট্রাক বোঝাই ৪৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৩৭ ত্রাণ প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। যাতে ছিল চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবণ, চা পাতাসহ নানা সামগ্রী। এছাড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতিদিন ১২ হাজার রোহিঙ্গাকে রান্না করা উন্নত খাবারও সংগ্রহ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ১১ দেশ থেকে এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে ২ হাজার ৪১৯ দশমিক ৩৯ টন চাল, ৬৯ হাজার ৮০৩ টন ডাল, ৯৯ হাজার ৪শ লিটার ভোজ্য তেল, ৬৪ হাজার ৫৩৪ টন লবণ। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের প্রেরিত তথ্য অনুযায়ী, সরকারী-বেসরকারী পর্যায় মিলে নিবন্ধিত ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ রোহিঙ্গার জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থের ত্রাণ সহায়তা সরবরাহ হচ্ছে। নিবন্ধনের বাইরে আরও বহু রোহিঙ্গা রয়ে গেছে। কারণ, নিবন্ধিত হলে এদেরকে মিয়ানমারে চলে যেতে হবে এমন একটি ধারণা বিভিন্ন মহল থেকে দেয়ার পর তারা নিবন্ধন কেন্দ্রে যায়নি। ফলে গত জুলাই মাসে সরকারী উদ্যোগে চলমান নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি বন্ধ রয়েছে। যেসব রোহিঙ্গা নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে তারা বেসরকারী পর্যায় ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কাছ থেকে ত্রাণ সহায়তা নিচ্ছে। সরকারী প্রক্রিয়ায় লাল কার্ড ও ফুড কার্ড এর মাধ্যমে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
×