ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোকেয়া হলে ‘৭ মার্চ’ জাদুঘর

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের তথ্যসমৃদ্ধ উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের তথ্যসমৃদ্ধ উপস্থাপনা

মোরসালিন মিজান ॥ সেই কবে যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! এরপর দীর্ঘ পথচলা। শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ একইসঙ্গে গৌরবোজ্জ্বল বহু ইতিহাসের সাক্ষী। কিছু ইতিহাসের অংশ। কিছু ইতিহাসের আবার জন্ম দিয়েছে। এছাড়াও ক্যাম্পাস জুড়ে আছে প্রাচীন স্থাপনা। দুর্লভ স্মৃতি নিদর্শন। আরও কত কী! কিন্তু এসবের সচেতন উপস্থাপনা, বিশেষ প্রদর্শনী তেমন চোখে পড়ে না। সমন্বিত উদ্যোগ নেই। এ অবস্থায় সম্প্রতি রোকেয়া হলে প্রতিষ্ঠা করা হলো একটি জাদুঘর। ‘৭ মার্চ জাদুঘর’ নামে আজ শনিবার এর উদ্বোধন করা হবে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসছেন তার প্রিয় ক্যাম্পাসে। জাদুঘর ঘুরে দেখবেন তিনি। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝেও কৌতূহলের শেষ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য নির্মিত প্রথম আবাসিক হলটিই রোকেয়া হল। ১৯৩৮ সালে চামেলি হাউস নামে যাত্রা শুরু করেছিল। ১৯৬৪ সালে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে নামকরণ করা হয়। ছাত্রীদের থাকার জন্য এখানে আছে একাধিক ভবন। সম্প্রতি আরও একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সুদৃশ্য বহুতল ভবনের নাম ‘৭ মার্চ ভবন’। ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি বড় কক্ষে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জাদুঘর। হ্যাঁ, নামকরণ থেকেই জাদুঘরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এখানে বাঙালীর মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের উজ্জ্বল স্মৃতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। উঠে এসেছে আগের এবং পরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীও। এভাবে ছোট্ট পরিসরে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশকে, যতটুকু সম্ভব, দৃশ্যমান করা হয়েছে। বাঙালীর অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি দারুণভাবে একাত্ম হয়েছিলেন নারীরা। তাদের বীরগাথা ছাত্রীদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। রোকেয়া হলের জীবন, সোনালি অতীত এবং একাল সেকাল সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যায়। ভবনের মূল অংশে প্রবেশের আগেই জাদুঘর। বাম পাশের সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতে উঠতে নিজের ভেতরে বিশেষ একটা অনুভূতি তৈরি হতে থাকে। একাধিক ফ্রেমে দৃশ্যমান হন ৭ মার্চের মহানায়ক। উত্তাল রেসকোর্স ময়দানের ঢেউ যেন বুকে এসে আছড়ে পড়তে থাকে। এর পরই কাঠের চৌকাঠ। বার্নিশ করা দরজা। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চকচকে ঝকঝকে জাদুঘর। চার দেয়ালের সবকটি আলোকচিত্র, গুরুত্বপূর্ণ দলিল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। মাঝখানে দুই সারিতে ৭টি গ্লাস শোকেস স্থাপন করা হয়েছে। শোকেসগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে ৬টি ফ্লোর প্যানেল। এভাবে দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনা। জাদুঘরটিতে মূলত আলোকচিত্রের ভাষায় ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। বাম পাশের দেয়ালে ৭ মার্চের ছবি। এসব ছবিতে দীর্ঘদেহী শেখ মুজিব। তর্জনী উচিয়ে বক্তৃতা করছেন। স্থিরচিত্রের পাশাপাশি ডিজিটাল সাইনাজে দেখানো হচ্ছে ভাষণের ভিডিওচিত্র। ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকেদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দিবে...।’ কত যে দেখা, কত যে শোনা এই ভাষণ! তবু লুমকূপ জেগে ওঠে। পাকিস্থানের ভীত কাঁপিয়ে দেয়া ভাষণের পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে দেয়ালে। চাইলে সহজেই পড়ে নেয়া যায়। ৭ মার্চের ভাষণের খবর পরদিন ৮ মার্চ দেশী-বিদেশী পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। নমুনা হিসেবে রাখা হয়েছে ‘ইত্তেফাক’ ‘পূর্বদেশ’র ফটোকপি। অবিসংবাদিত নেতার কালজয়ী ভাষণ বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের মন জয় করেছিল। তারই স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ইউনেস্কো। ইউনেস্কোর সার্টিফিকেট, এ সংক্রান্ত সংবাদের উপস্থাপনা এখানে দেখা যায়। আরও খুঁটিনাটি জানতে জাদুঘরে স্থাপন করা হয়েছে একটি কিয়স্ক। টাচস্ক্রিন কিয়স্ক থেকে ৭ মার্চের বিস্তারিত জানার সুযোগ রাখা হয়েছে। জাদুঘরে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এসেছে ২৫ মার্চের কালরাত। গণহত্যার ভয়াল ছবি। পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তার পরপরই মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ীর বেশে ফিরতে দেখা যায় আলোকচিত্রে। ডান পাশের দেয়ালে তারও আগের ইতিহাস। এখানে ভাষা আন্দোলনের উপস্থাপনা। ’৫২ ও ’৫৩ সালের বেশকিছু আলোকচিত্র। ১৯৪৮ সালের কিছু ছবি আছে। সেখানে ভাষার দাবিতে রাজপথে আন্দোলনরত শেখ মুজিবকে আবিষ্কার করা যায়। আর ১৯৬৬ কিংবা ১৯৬৯ সালে তো তিনি বাঙালীর একমাত্র নেতা। আলোকচিত্রে সেভাবেই দেখানো হয়েছে সময়টিকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাঙালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি ছিলেন নারীরাও। সাহসী নারীদের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জাদুঘর। ১৯৫২ সালের ছবিতে দেখা যায়, রাজপথে প্ল্যাকার্ড হাতে ভাষার দাবি তুলছেন ছাত্রীরা। ১৯৬৬ সালে তারা জানাচ্ছেন স্বায়ত্তশাসনের দাবি। এমনকি অস্ত্র হাতে যুদ্ধে লড়েছেন নারী। কাকন বিবি, তারামন বিবির মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। ভীষণ গর্ব হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, জাহানারা ইমামের আত্মত্যাগের কথা উঠে এসেছে। আছে প্রীতিলতা ও ইলামিত্রের মতো বীর কন্যাদের প্রতিকৃতি। মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলা লড়াকু নারীদের দিকে তাকালে আজকের ছাত্রীরা নিশ্চয়ই আন্দোলিত হবেন। অনুপ্রাণিত হবেন। ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ছবির দিকে তাকালেও অবাক হতে হয়। অতি সাধারণ চেহারার অসাধারণ মানুষটি সারাজীবন আগলে রেখেছেন স্বামী শেখ মুজিবকে। ছাত্রীরা তাঁর কাছ থেকেও শিখতে পারেন অনেক কিছু। এসবের পাশাপাশি জাদুঘরে সীমিত আকারে বেগম রোকেয়া হলের ফেলে আসা দিন, সোনালি অতীতের কথা তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। ছাত্রীদের যাপিত জীবনের খ-চিত্র বিগত দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ষাটের দশকের আলোকচিত্রে ছাত্রীদের পোশাক নির্বাচনে উন্নত রুচি, শিল্প-সংস্কৃতির তীক্ষè বোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৬১-৬২ সালের আলোকচিত্রে দেখা যায়, হলের ছাত্রীরা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছেন। চলছে খেলাধুলা। প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভাবতে ভাল লাগে, অনেক আগে এ হলের মেয়েরা নিজের মতো করে বাঁচতে শিখেছিল। জাদুঘরে এখনও তেমন কোন নিদর্শন রাখা হয়নি। যা আছে তার প্রায় সবই ছবি। ফলে আপাতত গ্যালারি ঘুরে আলোকচিত্র প্রদর্শনী বলে মতো মনে হতে পারে। তবে জাদুঘরের সীমাবদ্ধতা কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দেয় এর ইন্টেরিওর ডিজাইন। এ জায়গায় সুন্দর কাজ হয়েছে। সাজানোর এ কাজটি করেছেন নাজনীন হক মিমি। জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, অনেক দিন ধরেই জাদুঘরের কাজ চলছিল। বিভিন্ন পর্যায়ে এ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ছাত্রী নিবাসের অভ্যন্তরে হলেও, জাদুঘরটিকে সব দিক দিয়ে ভাল করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার মতে, রোকেয়া হলের জাদুঘরটিকে শুরু ধরলে পরবর্তীতে আরও ভাল কাজ ভবিষ্যতে হতে পারে। অবশ্য ৭ মার্চ জাদুঘর প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান তেমন কিছু বলতে রাজি হননি। জনকণ্ঠকে ছোট্ট করে তিনি বলেন, জাদুঘরের প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। তবে একে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ আছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটি সূত্র জানায়, আরও অনেক কিছুর মতো জাদুঘরের সময়সূচি এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে অচিরেই এটি খুলে দেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে ৭ মার্চ জাদুঘর।
×