ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাধারণের নিবিড় গল্পাবলি

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৩১ আগস্ট ২০১৮

সাধারণের নিবিড় গল্পাবলি

প্রশান্ত মৃধার গল্পে নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের সরব উপস্থিতি পাওয়া যায়। তিনি চোখের সামনে থাকা অবহেলিত মানুষকে তাঁর গল্পে স্থান দেন পরম মমতায়। শুধু তাই নয়, এসব অতি সাধারণ মানুষের জীবনকে তিনি দেখেন সূক্ষ্ম চোখে এবং তাদের একজন হয়ে প্রত্যক্ষ করেন তাদের জীবনাচরণ, দুঃখ, দাহ ও স্বপ্নগুলো। তিনি চরিত্র নির্মাণে একটি থেকে অন্যটিকে পৃথক করে তোলেন সহজে। প্রশান্ত মৃধার লেখা সাধারণ মানুষের যাপনমাখা ‘সীমানার নিকট-দূর’ গ্রন্থটিও এসব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময়। আলোচ্য গ্রন্থে মাত্র ৯টি গল্প রয়েছে। গ্রন্থের উদ্বোধনী গল্পের নাম ‘একনজর’। গ্রাম-বাংলার অতি পরিচিত মুখ ফেরিওয়ালা। প্রশান্ত মৃধা ফেরিওয়ালা শ্রেণীর মানুষের দৈনন্দিনতা, বেদনাবোধ ও আকুতিগুলো বাস্তবিকভাবে এ গল্পে তুলে ধরেছেন। বিশেষত, তিনি যে গভীরতা নিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্র অজিয়রকে উপস্থাপন করেছেন তাকে অনবদ্য বললে অত্যুক্তি হবে না। একদিকে বেঁচে থাকার নির্মম লড়াই অন্যদিকে স্থূল রসবোধ গল্পটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। প্রকৃত অর্থে এভাবেই মানুষ বেঁচে থাকে। যে অজিয়র সারাদিন পেটের চিন্তায় বিভোর, সে অজিয়রই সকালে বলে, ‘মামু, তোমার আলতাফ ভাইগ্নারে ডাহোন চাইন। উনি কি খ্যাতার মদ্যি তোমার ভাইগ্না বউরে নিয়ে আইচে?’ আবার এই স্থূল অজিয়রই শাড়ি বিক্রি করতে গিয়ে কোন এক বৃষ্টির দিনে গদারবাজার গ্রামের গৃহস্থের ঘরে তার প্রেয়সী মরিয়মকে দেখতে পায়। হৃদয়াঘাতের ভয়ে অজিয়র আর কখনও গদারবাজারের দিকে যেতে চায় না। মাটির রুক্ষ পৃথিবীতে অজিয়রদের জীবন এভাবেই কেটে যায়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ালেও তাদের সংগ্রাম শেষ হয় না। মনভরা প্রেম, মায়া, স্বপ্ন নিয়ে তারা নিরন্তর ছুটতে থাকলেও এসবের নাগাল অজিয়রা পায় না। গ্রন্থের নাম রচনা ‘সীমানার নিকট-দূর’ এক নিঃশ^াসে পড়ে ফেলার মতো একটি গল্প। কয়েক মুহূর্তের অনুভূতি গল্পে বর্ণিত হলেও এর আড়ালে জমা থাকে জীবনের প্রাচীনতা। বেদেনী ফুলমতি ও অচেনা ফকির অথবা সন্ন্যাসীর কয়েকটি সংলাপ গল্পের পরিণতি ডেকে আনে। গল্পে রহস্যময় লোকটি ফুলমতির কাছে বার বার কী রান্না হয়েছে জানতে চায়। প্রথমে কয়েকবার জবাব না দিলেও শেষে ফুলমতি জানতে চায়, সে কি খেতে চায়? জবাবে লোকটি একপর্যায়ে বলে, পীর-ফকির সন্ন্যাসীদের কি ‘অঙ্গের বেদন’ নেই! একটু পরই লোকটি ফুলমতির ছাপড়া এসে ঢোকে। লেখকের ভাষায়, ‘তারপর লোকটা ছাপড়ার মুখে কুঁজো হয়ে বসতেই, চার্জারের আলোয় লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে ফুলমতির মনে হয়, লোকটার পেটে কোন খিদে নেই। তবু হামাগুড়ি দিয়ে সে ছাপড়ায় ঢুকছে।’ এখানে প্রশান্ত মৃধা আদিম প্রবৃত্তির দিকে গল্পের ¯্রােতকে নিয়ে গেলেও তিনি পাঠকদের অতৃপ্তির শূন্যতায় টানটান করে ঝুলিয়ে রাখতে ভোলেন না। ফলে হাতে মুঠোয় ধরে রাখা গল্পটিও রহস্যময় হয়ে গ-ির বাইরে ছড়িয়ে যায়। ফেরিওলা, বেদেনী, ফকির-সন্নাসীদের পাঠ শেষ করে ‘উলটো ¯্রােত’ গল্পে আমাদের ভিক্ষুক জোনাব আলীর সন্ধান দেন লেখক। গল্প বাড়লে আমরা দেখি জোনাব আলী প্রথমে ডাকপিয়নের কাজ করত। তারপর একদিন কালাজ¦রে পড়ল সে। হাসপাতাল থেকে যখন জোনাব আলী গ্রামে ফিরল তখন তার পা দুটি নেই। ফলে চাকরি হারিয়ে পথে বসতে দেরি হলো না তার। জীবন ধারণের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করত সে। গল্পকথক মমতা মেখে যখন জোনাব আলীর কথা সহযাত্রীদের কাছে জানতে চায়, তার তিন বছর আগেই জোনাব মারা গেছে। আবাহমান গ্রামবাংলার মানুষজন প্রয়াত কাউকে নিয়ে সম্ভাব্য নানারকম মন্তব্য করে থাকে। জোনাব আলীর বিষয়েও তেমনটি হয়েছে। জোনাব আলী সম্পর্কে গল্পকথক জানতে চাইলে যাত্রীদের একেকজন একেক রকম মন্তব্য করেছে। একরৈখিক এ গল্পে জোনাব আলীর পুত্র¯েœহ, মৃত মানুষকে নিয়ে মানুষের ভাবনা, মন্তব্য ছাড়াও গল্পকথকের অনুসন্ধিৎসু মনের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। প্রশান্ত মৃধা তাঁর গল্পে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা করতে ভালবাসেন। সে জন্য তাঁর গল্পে চমৎকার চিত্রকল্প পাওয়া যায়। আহমাদ মোস্তফা কামাল আলোচ্য গ্রন্থের ফ্লাপে তাঁর লেখকসত্তা নিয়ে লিখেছেন, ‘অভিনব ডিটেলিং থাকে তাঁর বর্ণনায় আর এর জন্য তিনি ব্যবহার করেন সূক্ষাতিসূক্ষ্ম দৃষ্টি।...মাইক্রোস্কোপ নামক যন্ত্রের নিচে যেমন বস্তুর অতি সূক্ষ্ম অন্তর্গঠন চোখে পড়ে, খালি চোখে যা কল্পনাতীত, প্রশান্তও তেমুুনই দেখে নিতে চান সবকিছু, সবকিছুই, কিছুই বাদ না দিয়ে। তাঁর এ বর্ণনার ভঙ্গিই বলে দেয়Ñ জীবনের একটি মুহূর্তও ফেলনা নয়, অবহেলা করার মতো নয়।’ আহমাদ মোস্তফা কামাল উপরোক্ত লাইন কটির মাধ্যমেই প্রশান্ত মৃধার গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্যটি ভালভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। প্রশান্ত মৃধার প্রতিটি গল্পেই এই বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। সাধারণের চোখে যা এড়িয়ে যায়, গল্পকার তা কুড়িয়ে নেন পরম মমতায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের বর্ণনাশেলীর অভিনবত্বের কারণে পাঠকও মনের চোখে গল্পের চরিত্রগুলোকে জীবন্ত দেখতে পান। যার কারণে চরিত্রের অভিব্যক্তির প্রভাব পাঠকের হৃদয়েও আছড়ে পড়ে। বর্ণনার মধ্য দিয়ে লেখক গল্পকে বাস্তবে রূপ দেন। ‘অচিন ধামাইল’ গল্পটি থেকে লেখকের বর্ণনাশৈলীর একটি উদাহরণ দেয়া যাক : ‘কখনও আসা-যাওয়ার পথে বাস-রাস্তা থেকে বেদের আবাস দেখেছি এক-দুটো। আজকাল নৌকায় তাদের চলাচল প্রায় নেই। হয়তো ভ্যানে করে কাছাকাছি কোথাও যায়। নৌকার ছইয়ের মতন দেখতে ছোট ছোট ঘর তোলে ফাঁকা কোন মাঠের প্রান্তে। আট দশটি অমন অস্থায়ী ঘর। মাঝখানে এক চিলতে উঠোন। সেখানে হামাগুড়ি দেয়া থেকে একটু বড় শিশুরা খেলা করে। দুই-একজন পুরুষ থাকে। নারীরা জীবিকায়।’ এমন বিপুল চাহনি পেতে নানা অনুষঙ্গ দেখার উদাহরণ তার প্রায় সবকটি গল্পেই রয়েছে। প্রশান্ত মৃধার গল্পের সমাপ্তি নিয়ে দুটি কথা বলা যাক। তিনি তাঁর গল্পটি পাঠককে ধন্দে ফেলে শেষ করতে চান। তাঁর গল্পের অধিকাংশ চরিত্র শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, অথবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই গল্পটি শেষ হয়ে যায়। তাই পাঠক গল্পের পরিণতি নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। ফলে গল্পটি ‘শেষ হইয়াও শেষ’ হয় না। পূর্বেই উল্লেখ করেছি বিস্তারিত বর্ণনা প্রশান্ত মৃধার গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ বর্ণনার কারণে তাঁর গল্পগুলো সাধারণত দীর্ঘ হয়। আবার কোথাও কোথাও বর্ণনার আধিক্যের কারণে পাঠককে খেই হারাতে হয় এবং এমনও মনে হয়Ñগল্পটি যেন একইস্থানে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে গল্পের নিরবচ্ছিন্ন পাঠে বিঘœ ঘটে। তবে একটু ধৈর্যধারণ করে গল্পগুলো পড়লে পাঠক যে সমৃদ্ধ হবেনÑএ কথা বলা যায়। বর্ণনার বিষয়ে লেখকের সচেতনতাও কম জরুরী নয়। ‘সীমানার নিকট-দূর’ গ্রন্থটি ২০১৮ সালের বইমেলায় প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী হাজরা। ১২৮ পৃষ্ঠা গ্রন্থের মূল্য রাখা হয়েছে- ২০০ টাকা।
×