ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৩১ আগস্ট ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পর্ব-১৬) আমি নিশ্চয় এই লেখার কোথাও উল্লেখ করেছি যে দেশের ভেতরে ঘুরে বেড়াতেই আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। আমার বাবার সরকারী চাকরির কল্যাণে প্রায়ই এদিক-সেদিক যেতে হয়েছে তাঁর সঙ্গে। আর বদলির সময়ে এক শহর থেকে অন্য শহর তো ছিল এক বিশাল দক্ষযজ্ঞের ব্যাপার। সব মালপত্র নিয়ে ট্রেনে-স্টিমারে ভ্রমণ বড় ভাল লাগত। আমি জানি যে বিষয়টি যত সহজে বলে ফেললাম তত সহজে সংঘটিত হতো না। আমাদের যাত্রাকে আরামদায়ক করার জন্য অনেকের মনোযোগ থাকত এর উপর। কিন্তু আমরা যারা তখন নেহায়েতই ছেলেমানুষ তাদের জন্য এ ছিল এক মজার ব্যাপার। একটি বিশেষ ভ্রমণের কথা উল্লেখ করতে হয় এখানে। আমি নিশ্চিত যে এই যাত্রা সম্বন্ধে আমার জীবন সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘সেই অরুণোদয় থেকে’ তে আমি এই বিষয়ে লিখেছি। কিন্তু ওই স্মৃতিটি এতই প্রগাঢ় এবং আনন্দদায়ক যে তা বার বার ঘুরে-ফিরে আসে। সেই বাল্যকালে বড় আনন্দদায়ক সময় আমার কেটেছে খুলনা শহরে। বাড়ির কাছেই রূপসা নদী। সেই নদীর ধারে কত বিকেল কেটেছে। সেই বাল্য বয়সেও নিঃসর্গের প্রতি এক দুর্মর আকর্ষণ তাড়া করে ফিরত আমায়। বিকেল বেলায় মাঝে মাঝে খুলনা জেলা স্কুলের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতাম আমরা। কোন সময় একটা বলের পেছনে আবার কখনও কোন কিছু ছাড়াই। খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে একটা ভাঙা বিমানের ভেতরে এবং বাইরেও নানা কৌতূহল নিয়ে আমরা খেলাধুলা করেছি। দেখতে দেখতে তিন বছর পার হয়ে গেল। বাবা বদলি হলেন খুলনা থেকে কুষ্টিয়ায়। বিশাল বহরের মালামাল নিয়ে কোন এক সকালে আমরা স্টিমারে চেপে বসলাম। খুলনা শহরকে বিদায় জানিয়ে। এই স্টিমারটি আমাদের বক্ষে ধারণ করে দুটো গাদা বোট সঙ্গে নিয়ে আমাদের পৌঁছে দেবে গোয়ালন্দ ঘাটে। তারপর সেখান থেকে ট্রেনে কুষ্টিয়া। এইটি ছিল আমার স্মরণ কালের সবচেয়ে লম্বা নদীপথে ভ্রমণ। স্টিমার খুবই ধীর গতিতে এগোত। আর আমরা তার বিশাল ডেক-এ বসে নদীর পাড়ের দৃশ্য দেখতাম কি ডেক-এর ওপরে এক্কা-দোক্কা খেলতাম। যেহেতু এটা কোন যাত্রীবাহী জাহাজ ছিল না, কোন কিছু সংগ্রহ করার জন্য নদীর ধারের কোন বাজারের কাছে যাত্রা বিরতি দেয়া হতো। তখন নৌকো বোঝাই করে বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র নিয়ে জাহাজের চারধারে এসে ভিড়ত নানা ব্যবসায়ী। কারও কাছ থেকে মিষ্টি কেনা হতো, কারও কাছ থেকে দুধ, আবার কোন জেলের কাছ থেকে রুপালি ইলিশ। এই সময় আমরা ডেক-এর ধারের রেলিং ধরে নৌকোর ভেতরে দেখার চেষ্টা করতাম। জাহাজের নিচে যাওয়ার অনুমতি ছিল না আমাদের। প্রথম দিনই সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে আমরা বরিশালের পথে এসেছিলাম। তখন বর্ষাকাল। মা গ্রীষ্ম-বর্ষার গরম সইতে পারতেন না। কাজেই স্টিমারের কেবিনে না ঘুমিয়ে আমরা ঘুমাতাম ডেক-এ বিছানা পেতে। শতরঞ্চির ওপরে ফকফকে সাদা চাদর বিছিয়ে বিছানা করা হতো। চলন্ত স্টিমারে নদী থেকে বয়ে আসা বাতাস আমাদের পরম শান্তিতে ঘুম পাড়িয়ে দিত। এই রকম তিনটি রাত আমরা ওই ডেক-এ কাটিয়েছিলাম। দিনের বেলা মুরগি কিংবা ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে পরম সুখে ভাত খাওয়া হতো। আমি সবসময় দেখেছি যে জাহাজের বাবুর্চিরা খুবই উপাদেয় পদ রান্না করতে পারে। আমি জানি না এই বয়সে এসে বাংলাদেশের নদীপথে এত লম্বা যাত্রা ওই রকম আকর্ষণীয় লাগবে কিনা? কিন্তু তখনকার সুখ স্মৃতি আমাকে এখনও স্বপ্নাবিষ্ট করে। কেননা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম মনোরঞ্জনকারী বিষয়াদি আমাদের মনের ভেতরে বাসা বেঁধে নেয়। আমরা অতি সহজ সুন্দর জিনিসগুলোর দ্বারা আর আকর্ষিত হই না। কথায় আছে, রঙিন কাঁচের চশমা পরলে সবকিছু রঙিন দেখা যায়। হবে হয়ত! আমরা চার ভাইবোন ওই যাত্রায় যেন অমৃতের সন্ধান পেয়েছিলাম। তিন দিন পরে এক সন্ধ্যায় জাহাজ যখন গোয়ালন্দে পৌঁছল তখন মন বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে ভাল হতো এই যাত্রা যদি অনাদিকাল পর্যন্ত চলতেই থাকত। ওই যে বাল্যকালের স্মৃতি এবং সুখের অনুভূতি সেটাই আমাকে নদী পথে যাত্রার প্রতি দুর্বল করে তুলেছে। এরপরে সুযোগ পেলেই আমি নদীপথে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। এই রকম অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছে এখনও। বস্তুতপক্ষে, সারা বিশ্ব উড়োজাহাজে ঘুরে ফিরেও আমার পক্ষপাতিত্ব রয়েছে বাংলাদেশের নদী পথে যাত্রার প্রতি। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমরা মাঝে মধ্যেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত আমার গ্রাম রতনপুরে যেতাম। সেই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মানিকনগর লঞ্চঘাট পর্যন্ত লঞ্চে যাওয়া হতো। তারপর নৌকোয় তিন মাইল পথ অতিক্রম। এই যাত্রার স্মৃতিও বড় সুখপ্রদ ছিল। অতি প্রত্যুষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণ ঘাটে লঞ্চে চেপে বসতাম। তিতাস নদী দিয়ে মেঘনা হয়ে মনিকনগরে পৌঁছতাম প্রায় দুপুর একটা-দেড়টায়। তারপর দাঁড় বাওয়া নৌকোয় গ্রামের পথে। দুপুরের খাবার নৌকোতেই খাওয়া হতো। সেই খাওয়ার স্বাদ কখনও ভুলব না। বলা হয়ে থাকে যে নদীর জলো হাওয়ায় মানুষ ক্ষুধার্ত হয়ে উঠে। এবং সে কারণেই অতি সাধারণ ঝোল-ভাতও মনে হয় যেন অমৃত। যাত্রা পথের আনন্দ একেক বয়সে একেক রকম। বাল্যকালে নদীর দৃশ্য, জেলের মাছ ধরা, নদীর তীরে কৃষকের হালচাষ এইগুলোই ছিল মূল আকর্ষণ। যৌবনে এসে এই দৃশ্যে খুঁজে বেড়াই রোমান্টিসিজমের ছোঁয়া। তখন কলসি কাঁখে গাঁয়ের বধূর দৃশ্য অনেক বেশি মন টানে। প্রাকৃতিক এবং গ্রামীণ দৃশ্য সবসময়ই যেন প্রেমের বার্তা বয়ে বেড়ায়। আবার, কী আশ্চর্য, পরিণত বয়সে যারা বিশ্বাসী তারা ঈশ্বরের সন্ধানে ব্যাপৃত হন। কিন্তু নিঃসর্গ তার নিজস্ব রূপ নিয়ে সেই একই রকম আকর্ষণীয় থাকে যুগের পর যুগ। এত যে ঝড়-ঝঞ্জা বয়ে যায় তার ওপর দিয়ে তাতেও সে সৌন্দর্য সুধা বিতরণে থাকে অকৃপণ। কতবার কত বছর ধরে একই নদী পথে যাতায়াত করেছি এবং প্রতিবারই একই দৃশ্য ভিন্নভাবে সম্মোহিত করেছে আমাকে। এবারের পর্বের শুরুতেই বলেছিলাম যে, দেশের ভেতরেই ঘুরে বেড়াতে আমি বেশি ভালবাসি। এটি কেবল দেশপ্রেম নয়, সত্যিকার অর্থেই দেশ ভ্রমণের আনন্দই একটু ভিন্ন স্বাদের। মনে পড়ে গেল একবার বাসে করে লন্ডন থেকে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা’তে যাচ্ছিলাম আমি এবং সারা। শহর ছাড়িয়ে গ্রামের পথ যখন ধরল আমাদের বাস তখন দুদিকের গ্রামের অপরূপ দৃশ্য আমাকে বিমোহিত করে তোলে। সুন্দর সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি, গমের ক্ষেত, মাঝে মধ্যে গীর্জার চুড়ো- এইভাবে এত সুন্দর গোছানো দৃশ্য আমি এর আগে কখনও দেখিনি। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি আর ভাল লাগল না আমার। আমি সারা’কে জিজ্ঞেস করলাম এত সুন্দর দৃশ্য অথচ ক্লান্ত লাগছে কেন? ও জবাবে বলেছিল যে, এইগুলো সবই স্থিরচিত্র। এখানে কোন গতিশীলতা নেই। হঠাৎ মনে পড়ল যে, আমাদের বাংলার গ্রামে একই দৃশ্য বার বার জীবন্ত হয়ে ওঠে মানুষের কর্মচাঞ্চল্যের উপস্থিতিতে এবং সরব জীবনের আহ্বানে। আমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভবিষ্যতে আমার পাঠকদের কাছে ফিরে ফিরে আসব সুযোগ পেলেই।
×