ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথ্বীশ চক্রবর্তি

সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার ছড়ার বই

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ৩১ আগস্ট ২০১৮

সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার ছড়ার বই

সিলেটী আঞ্চলিক ভাষায় ছড়া লিখে কেউ যদি কালের যাত্রায় টিকে থাকেন তাহলে হাতেগোনা যে ক’জনের নাম আসে কবি ও ছড়াকার আবদুল বাসিত মোহাম্মদ তাঁদের অন্যতম। আলোচ্য ছড়াগ্রন্থ ‘কিড়িমিড়ি’সহ তাঁর আরও দুটি সিলেটী ছড়ার বই রয়েছে; ‘সিলোটী ছড়া’ ও ‘ছড়ার ছন্দে সিলেট রানী’। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্র-পত্রিকায় ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় রয়েছে তঁাঁর আরও অনেক সিলোটী ছড়া। এক কথায় সিলেটী ছড়ার রাজা তাঁকে বলা যায়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ নাগরী প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বিচিত্রা সাইজের ৩২ পৃষ্ঠার এই চমৎকার ছড়া গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন এন্টনি ফিরিঙ্গি এবং অলংকরণ করেছেন টিটনকান্তি দাশ। ছড়াশিল্পী তাঁর নাতিনদ্বয় মাফরোজা বিন শরিফ ও ফারিহা রশিদকে বইটি উৎসর্গ করেছেন। তাঁর ‘কিড়িমিড়ি’ ছড়াগ্রন্থ থেকে কয়েকটি ছড়ার কয়েকটি লাইন উপস্থাপন করতে চাই। ‘হাজমা ছড়া’য় লিখেছেনÑ ‘হাজমা ছড়া গান্ধা অয় না/আজার বছর তাজা/আইজকু আছে সাদা সিপাই/একদিন অইবো রাজা।...’ এখানে অবশ্য চতুর্থ পঙ্ক্তিতে ‘একদিন না লিখে ‘কাইলকু’ লিখলে মনে হয় শ্রুতিমধুর হতো। ‘বুধাই’ ছড়ার কয়েকটি লাইন এখানে তুলে ধরলাম: ‘যার-যির হাতে সাড়ে তিনহাত/ কেউ-কেউরে মানে না/ সবউ আবার প-িত বুলে/ কেউ কুন্তা জানে না।/কিতা করতাম পড়িয়া-হুনিয়া/আগোর এরা বুধাই/বড়-বড় কিতাব লেখছইন/ বেকার জানিও হুদাই।/ আমরা এখন কম্পিটারও/সারা দুনিয়া ঘুরি/তাঁরা আগে জান্তা কিতা?/খাইতা ছাউলের মুড়ি।...’ ছড়াকার তাঁর ‘দাঁড়কিনা’ ছড়ায় লিখেছেনÑ ‘চ্যাঙে উজায় ব্যাঙে উজায়/আরও উজায় দাঁড়কিনা/ মাগুর বেটা, কৈ, খইয়ায় কয়/আস্তা আওর তার কিনা।/খালি দৌড়ে ফালায় নাচে/চুকুম্বুদাইর ফাল/তারার কথা হুনে বা কে!/নিজোর গতরো জাল।...’ ‘নিমরা বিলাই’ ছড়াটির কয়েকটি লাইন: ‘হর খাইতে খাইতে পাগল অইছে/বুড়াকালো খাইছো তুমি ধরা/মজায় তোমারে বেহুশ করছে/দেখাইরায় এখন তুমি মরা।...’ তাঁর আরেকটি ছড়া ‘ইন্দুর’। তিনি তাতে লিখেছেনÑ ‘বাঘ নাই বনো হিয়াল রাজা/বিলাই নাই ঘরো ইন্দুর/মানুষ নাই দেশো সবাই রাজা/দামির দাম নাই এক বিন্দুর।/বুদ্ধি নাই বেটার চুক বেশি/ টেকা নাই বেটার ফুটানি/শিক্ষা নাই বেটার ভক্ত বেশি/খালি চিনোইন তাইন লোটানি।/আছা কথা একথান/আল্লায় রাখোইন মানির মান।’ ‘বড়াই ছড়ায় লিখেছেনÑ ‘আঘাটে ঘাট অইবো/ আপথে পথ/অমানুষ মানুষ অইবো/গুণীজনোর মতো।/নিজোর বড়াই নিজে করবো/চাইবো অইতো বড়/নিজোর গালো নিজোর আতে/খাইবো টেকর চড়ও।/ কিয়ামতোর আলামত/দেউকা সবে মতামত।’ ‘বালিগড়া’য় লিখেছেনÑ ‘বালিগড়া প্যাকোর রাজা/ আলসিকুরোর বাদা/সব মাছে কয় বড়াবেটা/তুমি হকলোর দাদা।/তুমি অইলায় চেঙোর লাখান/ পানির ভিজা বিলাই/ তোমার বুদ্ধি মোড়ে মোড়ে/এর লাগি তো কিলাই।...’ তাঁর ‘তেলচোরা’ ছড়াটি এ রকম: তেলচোরা তো তেলচোরা/তেলোর বোতল কই?/ নাকের ভেতরে হামাইয়া হে/ মগজো থাকে বই।...’ ‘ভইছাল’ ছড়ায় লিখেছেনÑ ‘ভইছাল আইলে আল্লা আল্লা/ তুফান দিলে আজান/ পেটোর ভুকো মাইজি কইগো/ পাল্টুন কিনতে বাজান।...’ তাঁর ‘পেটলা’ ছড়ার কয়েকটি লাইন তুলে ধরলাম: ‘মেঘে আর পানিয়ে/ কাপড় অইছে গিল্লা/ আমার বাড়ির চাইরো বায়দি/ চা বাগানোর টিল্লা।/ঠা-ায় আর পানিয়ে/ মনটা অইছে থেতলা/ ভালা লাগে না তো আমার/ যদি অয় হে পেটলা।...’ এই বইয়ের সর্বশেষ ছড়া ‘কিড়িমিড়ি’তে তিনি বলেছেনÑ ‘দূর থাকি দেখে আর কিড়িমিড়ি খায়/জিব্রা দিয়া লাড়িছাড়ি ডুগডুগি বাজায়।/... থাবা চোরা, হিঙগাইল চোরা, পকেট চোরা এক/কিড়িমিড়ি খাইয়া আটে দেখ রে সবে দেখ।’ ২৫টি ছড়ার এই বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৩০ টাকা। যারা সিলেটী কথাবার্তা পছন্দ করেন তাদের জন্য এই ছড়াগ্রন্থটি দারুণ উপভোগ্য হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আলোচ্য ছড়াগ্রন্থ ‘কিড়িমিড়ি’র সবগুলো ছড়া আমি বার বার পড়েছি। যতবার পড়েছি ততবারই ভাল লেগেছে। তাঁর ছড়াগুলো রসাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক, বিদ্রƒপাত্মক ও কটাক্ষপূর্ণ। সিলেটী আঞ্চলিক ভাষার ছড়ারাজ আবদুল বাসিত মোহাম্মদ আমাদের চারদিকের সামাজিক অসঙ্গতিগুলো গ্রন্থটিতে তুলে ধরেছেন। এর ফলে পাঠকের একদিকে যেমন পড়তে ভাল লাগবে অপরদিকে পাবে নীতি, নৈতিকতা ও শিক্ষণীয় বিষয়াবলী।
×