ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বই ॥ নজরুল জীবন ॥ বৈচিত্রময় নজরুল

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ৩১ আগস্ট ২০১৮

বই ॥ নজরুল জীবন ॥ বৈচিত্রময় নজরুল

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওপর লিখিত জীবনালেখ্য ‘নজরুল জীবন’ প্রকাশপায় ২০১৮। সালের ভাষার মাসে। গ্রন্থটির রূপকার শাহীনুর রেজা। কণ্ঠশিল্পী শাহীনুর রেজা নজরুল সঙ্গীতের একজন নিবেদিত সাধক। বইটি প্রকাশের দায়িত্বে ছিল অনন্যা। প্রচ্ছদ আঁকেন ধ্রুব এষ। নজরুলের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোকে বিবেচনায় এনে লেখক বিদ্রোহী কবির ওপর যে পরিচ্ছন্ন অভিব্যক্তি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন তা সত্যিই এক অভাবনীয় রচনাশৈলী। বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় যৌক্তিক আর বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে নজরুলের মূল্যবান জীবন ও সাহিত্য যেভাবে লেখক পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছেন তা অনেক বিভ্রান্ত তথ্যভা-ারকে যথোচিত জবাব দেবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। এই সমৃদ্ধ গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে আগের কয়েক বিশিষ্ট নজরুল জীবনিকারদের। বইটি শুরু করার আগে লেখক নিজেই তার যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্যের অবতারণা করেন। বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে এমন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যার তুলনা তিনি নিজেই তাঁকে নিয়ে হরেক রকম টানাপোড়েন, সঙ্কীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে জড়ানোর মতো নানা ফন্দি ফিকির করা হয়েছে এবং সেটা তাঁর জীবদ্দশাতেই। তার পরেও দৃঢ় প্রত্যয়ী, অকুতোভয়, মানবতার সেবক নজরুলকে কোনভাবেই তাঁর শক্ত আসন থেকে চুল পরিমাণও সরানো সম্ভব হয়নি। অবিচলিত চিত্তে, কঠিন সঙ্কল্পে, মানবিক মূল্যবোধে যেভাবে জীবন ও সাহিত্যকে দাপটের সঙ্গে অবারিত আর উন্মুক্ত করেছেন তা যেমন বিস্ময়কর একইভাবে অতুলনীয়ও। গ্রন্থের রচয়িতা কবির আবাল্য জীবন প্রবাহকে তুলে আনতে গিয়ে সংগ্রামী বৈতরণী পার হওয়ার কঠিন সময়কেও স্পষ্টভাবে মূর্ত করেছেন। ‘বাল্য জীবন’ অধ্যয়ে মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতৃহীন নজরুলের যে লড়াকু অভিযাত্রার দুঃসহ কাহিনী বর্ণিত আছে তাতে তার নাম যে এক সময় দুখু মিয়া ছিল সেটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। শুধু তাই নয় মা জাহেদা খাতুনের সঙ্গে সম্পর্কের শৈথিল্যতায় গৃহত্যাগের মতো অবর্ণনীয় দুর্যোগেরও মুখোমুখি হতে হয়। এর পরের জীবন ছিল নিরন্তর লড়াইয়ের এক উ™£ান্ত দিশাহীনতা, জীবনযুদ্ধের এই পালাক্রমে লেখাপড়ার পাঠ চুকাতে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামায় অবিভক্ত ভারত তথা সারা দুনিয়া যখন উন্মত্ত হয়ে ওঠে। পরের ঘটনাপ্রবাহ ১৯১৭ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্র নজরুলের করাচী সেনানিবাসে চলে যাওয়া। লেখক অত্যন্ত পর্যায়ক্রমিকভাবে বিদ্রোহী কবির বৈচিত্র্যিক জীবনে ঘটে যাওয়া হরেকরকম ঘটনাপঞ্জির একটি সুসংবদ্ধ আলোচনা সন্নিবেশিত করেন। ১৯১৮ সালে যুদ্ধের উন্মত্ততা খানিকটা স্তিমিত হলেও নজরুল করাচী থেকে কলকাতায় ফেরেন ১৯২০ সালে। লেখক এই কথা স্মরণ করতে ভোলেননি কিভাবে সৈনিক নজরুল লেখক হিসেবে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ দিয়ে শুরু করা সৃষ্টিশীল জীবন পরবর্তী বছরগুলোতে কিভাবে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় এক বলিষ্ঠ ব্যতিক্রমী ধারায় নিজের আসন শক্ত করতে হয়েছে, সে আলোচনাও লেখকের সচেতন মননের অনুষঙ্গ হয়েছে। কবির স্বল্প সময়ের সৃজনশীল জগত তাঁকে কোন সুবিশাল শৈল্পিক সুষমায় অধিষ্ঠিত করায় তাও গ্রন্থাকারের সুচিন্তিত অভিব্যক্তিতে পাঠক সমাজকে মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যায়। অসাধারণ এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী নজরুল যেভাবে তাঁর আপন ভুবনে সদর্পে বিচরণ করেছেন লেখকও সেই মাত্রায় কবির বিরল প্রতিভার প্রতি নির্বিষ্ট থেকে তাঁকে হৃদয়ের সমস্ত অর্ঘ সমর্পণ করেন। অভিনন্দন গ্রন্থের রূপকারকে অতুলনীয় নজরুলকে তাঁর যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টির মহিমায় কবির চিরায়ত ভাবসম্পদকে অবিস্মরণীয় করার জন্য। নতুন প্রজন্মের নজরুলকে সঠিকভাবে জানা আজ সময়ের দাবি। কোন ধরনের বিতর্কের সুযোগ তৈরি না করে নজরুলকে তাঁর সৃষ্টি সম্ভার দিয়ে বিচার করাত্ত অত্যন্ত জরুরী। লেখক সেই ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা পালন করে অসংখ্য নজরুল অনুরাগীকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছেন। গ্রন্থটির পাঠক সমাজে আদৃত হবে। এর বহুল প্রচারেরও অন্যথা হবে না- এই আশা ব্যক্ত করাই যায়।
×