ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দিরাজুর রহমান খান

গল্প ॥ রোহিঙ্গা কন্যা

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৩১ আগস্ট ২০১৮

গল্প ॥ রোহিঙ্গা কন্যা

হানিফ ডিলাক্স পরিবহনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কোচটি কমলাপুর বাস স্টপেজ থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। হেমন্তের শেষে পৌষালী ঘনকুয়াশার চাদর ভেদ করে। খুব ভোরে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে প্রায় অন্ধকার থেকে আলোর পথে। আমি সেই গাড়ির একজন হতভাগ্য যাত্রী। গাড়ি চলছে দুর্নীরিক্ষেত এক অস্পষ্ট আলোর সন্ধানে। সংশয়াকীর্ণ হৃদয় কেবলি বলছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে আমার হেলায় ফেলে আসা শামসুন্নাহারের সন্ধান কী পাব না শুধুই কেবল মরীচিকা। ২৫ আগস্টের পর থেকে সংবাদপত্রের শিরোনামায় আর টিভির হেডলাইনে ‘রাখাইনে গণহত্যা’ প্রতিরাতে গোলাগুলির শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে রাখাইন’ ‘অশ্রু-রক্তে ভেজা রাখাইন ’ রাখাইনে রোহিঙ্গারা গণহত্যা ধর্ষণসহ বীভৎস নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের শিকার’ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। মৃত্যু আতঙ্কে ভয়ার্ত লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ আবালবৃদ্ধবনিতা। একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, প্রাণ বাঁচাবার জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। আমি ইতিহাসের ছাত্র বলেই রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিক অবস্থানটি খুঁজে দেখার চেষ্টা করছি। হযরত ওমরের আমলে মুসলমানদের বিজয়াভিযান শুরু হয়। অষ্টম শতাব্দীতে আরবীয় বণিকরা প্রথম চট্টগ্রামে আসে। বাংলায় মুঘল সুবদার শায়েস্তা খান ও মীর জুমলা প্রমুখ বাংলা থেকে মগদের বিতাড়নের চেষ্টা করে। বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে সরিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে। কী আশ্চর্য। এত বছর পরেও সেই দুর্বৃত্ত মগদের অত্যাচার থেকে আরাকানী মুসলমানরা আজও নিস্তার পেল না। ব্রিটিশরা লর্ড ডালহোসির নেতৃত্বে ব্রহ্মযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ইংরেজদের লাভ নয় বরং আর্থিক ক্ষতিই হয়েছিল। ১৮২৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বার্মা ইংরেজ শাসনাধীনে ছিল। কিন্তু ইংরেজরা ১৯৪৮ সালে বার্মাকে স্বাধীনতা দিলেও অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে আরাকানের রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত ভাগ্য বিড়¤¦নার মধ্যে রেখে গেল। মনে পড়ে দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে ড. এনামুল হকের আরকানী রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের কথা পড়েছি। আনুমানিক ১৬৫২ খ্রি. থেকে ১৬৮৪ খ্রি. পর্যন্ত আরাকান রোসাঙ্গা রাজারা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন কবিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। মহাকবি আলাওলের পদ্মাবর্তীর কথা কে না জানে? সেই পদ্মাবর্তীর দেশ মিয়ানমারের সামরিক সরকারের পৃষ্ঠপোষিত স্টেট কাউন্সিল প্রধান তথাকথিত শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী আউং সান সুচি রাখাইনের মাটি ভস্মীভূত করল। সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ফলে রাখাইন রাজ্য আজ শ্মশানে পরিণত হয়েছে। আমি কি এই পোড়া নি®প্রাণ ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাব? শামসুন্নাহারকে খুঁজে পাব? দুর্বৃত্ত মগরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হেন অপকর্ম নেই যা তারা করে চলেছে, গত ২৫ আগস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনাক্যাম্পে তথাকথিত রোহিঙ্গাদের হামলার অজুহাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্য আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। গণহত্যাকালে তারা জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু করল। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ শিশু সেই নিধনযজ্ঞে নির্মম বলি হলো। মানবতার নৈতিক মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হলো। ঘর থেকে তরুণীদের চুলের ঝুটি ধরে বাইরে দিবালোকে প্রকাশ্যে গণধর্ষণ করল। কারও কারও যৌনাঙ্গে বন্দকের নল ঢুকিয়ে দিয়ে নির্মম পৈচাশিকতার চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ ঘটাল। সেই শ্বাপদ বিকৃত উল্লাসে মানবতার কণ্ঠ হারিয়ে গেল। আর হারিয়ে গেল নারী-শিশুর আর্তনাদ আর পুরুষের প্রাণঘাতী হাহাকার। হানিফ পরিবহনের কোচটি এতক্ষণ মেঘনার ওপর দিয়ে ব্রিজ অতিক্রম করেছে। শীতের মেঘনা নদী আদিগন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন। ধূসর স্মৃতির পাতায় যেন বিষণœ শিশির পড়ছে। আমি কানে হেডফোন বাঁধলাম। চিত্রাসিংয়ের গান হচ্ছে। ‘স্মৃতির মণি মালা সবার চেয়ে দামী কিছু তো ভুলিনি আমি’ মনে পড়ছে সেই মিয়ানমারের আকিয়াব নৌবন্দরের কথা। আমি সামছুদ্দিন বয়স চল্লিশোর্ধ বাড়ি সাভার। বর্তমানে আমি বিপতœীক। স্ত্রী মারা গেছে বেশ কয়েক বছর হলো। আর বিয়েথা করা হয়নি। আমার সংসারে কেবল আমার বৃদ্ধ মা আছেন। এক সময় আমি কাঠের ব্যবসা করতাম। শুনেছি আমার পূর্বপুরুষরাও কাঠের ব্যবসা করতেন। আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে পাসকোর্সে এমএ পাস করি। বর্তমানে সাভার বাজার রোডে আমার একটি কাঠের ফার্নিচারের দোকান আছে। আমার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন বন্ধু জগদীশচন্দ্র দাস। আমি আর জগদীশ ব্যবসা উপলক্ষে বেশ কয়েকবার মিয়ানমার গিয়েছি। আগে ফরাশগঞ্জের কাঠ পট্টিতে আমাদের যৌথভাবে কাঠের ব্যবসা ছিল। এখন জগদীশ একাই ব্যবসা করে। ওর দোকানের নাম জগদীশ টি¤¦ার মার্ট। ও রেঙ্গুন থেকে বার্মাটিক অর্থাৎ সেগুন কাঠ আমদানি করে। ওর দোকানের বার্মাটিক এই ফরাশগঞ্জ বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন অংশে পাইকারিভাবে চালান দেয়া হয়। আমি জগদীশের সঙ্গে০ কয়েকবার মিয়ানমারে আরাকান আকিয়াফসহ বেশ কয়েকটি পর্যটন স্পটে গিয়েছি। বার্মা মুল্লুককে আমার অনেক কাছের মনে হয়। আমার পূর্বপুরুষরাও কলকাতা খিদিরপুর ডকইয়ার্ড থেকে রকেট স্টিমার করে রেঙ্গুন যেতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আমি একজন একনিষ্ঠ পাঠক। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’ বেশ কয়েকবার পড়েছি। সেই থেকে শ্রীকান্তের মতো বার্মা মুল্লুকে ভ্রমণ করার একটা ইচ্ছা আমার বরাবরই ছিল। শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক উপন্যাসের খলনায়ক দুর্বৃত্ত রমজানের কথা মনে আছে। সেই রমজান চরিত্রে আমি মগজলদস্যুদের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই। আমি আর জগদীশ আকিয়াবের বেশ ধনী কাঠের ব্যবসায়ী আব্দুল কারিমের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্কে গড়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, আমাদের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ হৃদ্যিক বন্ধনও গড়ে ওঠে। সে মিয়ানমারে আমাদের বিশেষ পারিবারিক বন্ধুত্বের স্থান দখল করে নিল। করিম আকিয়াবে নিজের সুরম্য দ্বিতল বাড়িতে স্ত্রী রহিমা খাতুন আর এক কন্যা মরিয়মকে নিয়ে বেশ সুখে শান্তিতেই বাস করত। করিমের গ্রামের বাড়ি আকিয়াবের মংডুতে। সে মাঝে মাঝে সপরিবারে সেখানে বেড়াতে যায়। বিশেষ করে শীতের সময় পিঠাপুলি আর খেজুরের রস খাওয়ার জন্য। আর যায় ঈদুল আযহারের সময়, গরিব আরাকানিদের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ করার জন্য। এখানকার অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই ইসলাম ধর্মাবল¤¦ী। আরাকানের গ্রামগুলো আমাদের বাংলাদেশের গ্রামের মতোই। জীবনাচরণও একই রকম। করিম বয়সে আমাদের চেয়ে বেশ কয়েক বছর বড় হবে। করিমের সঙ্গে একই বাড়িতে বাস করত তার একমাত্র শ্যালিকা সামসুন্নাহার। সামসুন্নাহার উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল। মধ্যযুগীয় জীবনাচরণে অভ্যস্ত রাখাইন অঞ্চলটি হচ্ছে একটি অনগ্রসর দরিদ্র অঞ্চল। শিক্ষার আলোহীন একটি চরম পশ্চাৎপদ মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। পাদপ্রদীপের আলোর নিচে পার্শ্ববর্তী আকিয়াব ছিল একটি ঐতিহাসিক পুরনো বাণিজ্যিক শহর। এখানকার জনগোষ্ঠী মোটামুটি সিভিলাইজড শিক্ষিত। সামসুন্নাহারের সঙ্গে আমার পর্যায়ক্রমে একটি বিনিসুতা মালার মতোই একটা পবিত্র বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ও জানে আমি বিপতœীক, একটু বয়সও হয়েছে তথাপি তবু বলতে দ্বিধা নেই হৃদয়ের সম্পর্ক তো বয়স ঘিরে গড়ে ওঠে না। হৃদয়বৃত্তির কথাই এখানে শেষ কথা। শামসুন্নাহার তার রহিমা ভাবিকে নিয়ে আমাকে আর জগদীশকে নিয়ে, অবশ্যই মরিয়মকে নিয়ে মিয়ানমারের বিভিন্ন পর্যটন স্পট আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। সাথে করিম প্রায়শই অনুপস্থিত ছিল। কারণ সে ছিল একজন ব্যতিব্যস্ত ব্যবসায়ী। খুব একটা সময় দিতে পারত না। আব্দুল করিম কেবল একজন সফল ব্যবসায়ীই ছিল না। একজন আধুনিক মনমানসিকতাসম্পন্ন সংবেদনশীল দিলদরিয়া হৃদয়ের মানুষও ছিল বটে। সে বেশ ভোজনবিলাশী। রহিমা ভাবিও সমাজদার সুগৃহিণী বটে। মিয়ানমারের খাবার তালিকায় আমাদের দেশের মতোই ডাল-ভাত মাছই মুখ্য। আমাদের মতোই ইলিশ মাছ এখানে বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন রকম ছোট মাছ, মুরগির মাংস, বিভিন্ন রকম শাকসবজি। এমনকি কলমি শাকও আছে। বিভিন্ন বাঙালিয়ানা খাবার দিয়েই আমরা আপ্যায়িত হতাম। শামসুন্নাহার প্রায়শই আমাকে খুনসুটি আর কটাক্ষ করে বলত, ‘শামসু ভাই আমাদের ইলিশ মাছ আপনাদের দেশের ইলিশ মাছের চেয়েও বেশি সুস্বাদু।’ আমি আমার দেশকে কিছুতেই খাটো করতে রাজি নই। বেশ চ্যালেঞ্জের সুরেই বলতাম, ‘আমাদের পদ্মার ইলিশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সুস্বাদু ইলিশ মাছ।’ শামসুন্নাহার তৎক্ষণাৎ চ্যালেজ্ঞ গ্রহণ করে প্রত্যুত্তরে বলত, ‘তাহলে আমাদের ইলিশ মাছ আপনাদের দেশে ঠকবাজি ব্যবসায়ীরা পদ্মার ইলিশ বলে আমদানি করে চালিয়ে দেয় কেন? আমরা তো আপনাদের ইলিশ আমদানি করি না। ’ শামসুন্নাহার আমাকে প্রায়শ তর্কে হারিয়ে সে জিততে চাইত। আর আমি হেরে জিতে যেতাম। পুরুষ কোন কালে নারীকে পরাস্ত করে প্রকৃত জয়ী হয়েছে? সে তো জয় নয়, সে তো মেকী জয়। আমি জগদীশ, রহিমা ভাবি, শামসুন্নাহার, মরিয়ম সমভিব্যাহারে করিম ভাইয়ের ব্যক্তিগত ট্যাক্সি করে মিয়ানমারের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে বেড়িয়েছি। আমরা মিয়ানমারের নতুন রাজধানী নাপিতো গিয়েছি। নতুন রাজধানী নাপিতো ইয়াঙ্গুন থেকে ৩৭০ কিমি দূরে অবস্থিত। এ ছাড়াও সাফারি ওয়ার্ল্ড, ন্যাশনাল রিসোর্স ভিলেজ, জুলফিকার গার্ডেন, মান্দ্রেলা, বার্মাতে নির্বাসিত শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মাজার সব দর্শন করেছি। মাজারের শীর্ষদেশে এপিটাপে বাহাদুর শাহের লেখা কবিতা কিয়দংশ উৎকীর্ণ করা আছে। ‘কিতনি বদনসীব হ্যায় তু জাফোর, সত্যি সৃষ্টিকর্তার কী অদ্ভুত ভাগ্যের লিখন। করিম তার স্ত্রী রহিমা ভাবি, মরিয়ম আর আমার সেই অতি প্রিয় মানুষটি আজ কোথায় কেমন আছে কে জানে। কোথায় গেল তাদের বৈভব আর প্রতিপত্তি। আব্দুল করিম সপরিবারে বেশ কয়েকবার আমাদের বাংলাদেশ ভ্রমণ করে গেছে। বিশেষ করে আমিও তাদের চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যটনগুলো ঘুরিয়ে দেখিয়েছি। বায়েজিদ বোস্তামির মাজার, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, কক্সবাজারের সী বিচ, ফয়েজ লেক, কাপ্তাই লেকে ইঞ্জিনবোটে চড়ে কাপ্তাই জলবিদ্যুতকেন্দ্রে দেখিয়েছি। চট্টগ্রাম থেকে ৪৫ কিমি দূরে পাহাড়ের পাদদেশে কাপ্তাই লেক। শামসুন্নাহার আমাকে বলেছিল, ‘আপনাদের বাংলাদেশ যে এত সুন্দর না এলে বুঝতে পারতাম না’। প্রত্যুত্তরে আমি বলতাম, ‘দেখার এখনও অনেক বাকি আছে।’ ‘দেখবে না’? ও বলত, ‘অবশ্যই’। আমি তৎক্ষণাৎ একটু রোমান্টিকতার সুরে বলতাম, ‘সবাই মিলে নয়। শুধু তুমি আর আমি।’ ও ঈষৎ লজ্জাবনত মুখে বলত, ‘অসভ্য’। তার পরও আরও বেশ কয়েকবার কখনও ওর ভাবি-ভাতিজি আর আমি ঘুরতে গিয়েছি। আবার কখনও ওর ভাতিজি মরিয়ম হোটেল স্যুটে কিছুক্ষণের জন্য রেস্ট নিত। আর আমরা তারুণ্যের প্রতি সুবিচার করে এ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পরতাম। দু’তিন ঘণ্টার জন্য। শুধুই দু’জনে একাকী। মনে হতো আদম আর হাওয়ার মতো আমরাই শুধু এই পৃথিবীর একমাত্র বাসিন্দা। আর একদিন আদম আর হাওয়ার মতো আমরাও গিয়েছিলাম কর্ণফুলী নদীতে নৌবিহার করতে। আমি বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম শহরে যেখানেই গেছি শামসুন্নাহারকে বিভিন্ন দোকান থেকে বিভিন্ন রকমের শো পিচ কিনে দিয়েছি। বিশেষ করে উপজাতীয়দের হাতের তৈরি বিভিন্ন চটের ব্যাগ, পুতিরমালা, কানের দুল আরও কত কী? ভ্রমণ শেষে ওগুলো রহিমা ভাবি, মরিয়ম আর শামসুন্নাহার যে যার পছন্দমতো ভাগাভাগি করে নিত। তবে তারুণ্যউদ্দীপ্ত বিশেষ উপঢৌকনগুলো শামসুন্নাহারের জন্যই রেখে দিতাম। সে উপঢৌকনগুলো পেয়ে খুবই খুশি হতো। একটা অনাবিল হাসি হেসে কৃতজ্ঞচিত্তে বলত, ‘এগুলো শুধু আমার কাছে শুধুই গিফ্ট নয়, এর সবই আমার কাছে শুধু তুমি, শুধুই তুমি।’ পতেঙ্গা বীচ থেকে আমরা কর্ণফুলী নদীতে নৌবিহারে যাই। চঞ্চলা খড়স্রোতা পাহাড়ী কন্যা কর্ণফুলী। একটা সাম্পান ভাড়া করে আমরা কিছুক্ষণ নদীতে ঘুরলাম অগ্রহায়ণের অপরাহ্ণে। সূর্য পশ্চিমাকাশে ধীরে ধীরে হেলে পড়ছে। সূর্যের মিঠে রোদ আর রক্তিম আলোর বিভায় শামসুন্নাহারের মুখটা কেমন উষ্ণ রোমাঞ্চের লজ্জায় ক্রমশ রক্তিম হয়ে উঠছে। আমি তার পাপড়িকমল ওষ্ঠে একটা চুমো এঁকে দিলে ‘সে বলল একটা’ গান ‘গাও’। আমি একটি নজরুল সঙ্গীতের পঙ্ক্তি গেলাম। ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেবো খোঁপায় তারার ফুল ‘কর্ণে দোলাবো তৃতীয় তীথি চৈতি চাঁদের দুল।’ আমার গান শেষ হতেই ও পরিষ্কার নির্ভুল উচ্চারণে গেয়েছিল ভারতীয় হিন্দী গান। ‘পরদেশি পরদেশি জানানেহি মুঝে ছোড়কে মুঝে ছোড়কে।’ মিয়ানমারের ছবির হলগুলোতে সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার মতো প্রচুর ভারতীয় হিন্দী ছবি চলে। সেদিন শামসুন্নাহার কক্সবাজার উপজাতীয়দের দোকান থেকে কেনা যে কানের দুলটি আমি তাকে দিয়েছিলাম তাই সে কানে পড়েছিল। তাকে বেশ লাগছিল। আমি সেদিন তাকে কর্ণফুলী নদীর গল্প বলেছিলাম, ‘চট্টগ্রামে এক উপজাতীয় রাজকুমার আরাকানী এক রাজকুমারীকে ভালবাসত। একদিন জোছনাস্নাত রুপালি রাতে রাজকুমার তার খোঁপায় ফুল গুঁজে দিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ফুলটি নদীতে পড়ে গেলে ঢেউয়ের স্রোতে তা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন রাজকুমারী মাথা ঝুঁকে ফুলটি উদ্ধার করতে গিয়ে সে নদীর স্রোতে হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য। সলিলসমাধি হলো তার। সেই সাথে রাজকুমার রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে নদীতে ঝাঁপ দিলেও সেও চিরদিনের জন্য কর্ণফুলী নদীতে হারিয়ে গেল।’ আমার কথা শুনে শামসুন্নাহার খুব দুঃখ পেয়ে বলেছিল, ‘আমার রংধনুর লাল রঙের আলতা দরকার নেই, তুমি আমার তোমার চোখের আলোয় রাঙিয়ে দিও।’ আমি বলেছিমাল, ‘যদি কখনো চোখের আলো নিভে যায়?’ ও বলল, ‘হৃদয়ের আলোতে দেখব।’ স্মৃতিজাগানিয়া মনে ভেসে আসছে কত কথা। আরেকদিন বান্দরবানে নীলগিরি দেখতে গেলাম। তার পর চি¤¦ুক আর স¦প্নচূড়া। স¦প্নচূড়া থেকে মিয়ানমার দেখা যায়। শামসুন্নাহার সেদিন বলেছিল, ‘কত কাছাকাছি আমাদের দেশ?’ আমি বলেছিলাম, ‘তবুও আলাদা দুটি দেশ।’ মাঝখানে বর্ডার অতিক্রম করতে পারবে? ও বলল, ‘বর্ডার তো কোন ছাড় তুমি পাশে থাকলে আমি হিমালয় পাড়ি দিতে পারব।’ ওর চোখে সেকি প্রত্যয়দীপ্ত অহঙ্কার। নিয়তির কী খেলা, শামসুন্নাহারকে খুঁজতে আমি সেই কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পেই যাচ্ছি। কতদিন বলেছি ‘তোমাকে আমি এখন থেকে নাহার বলব’ শামসুন্নাহার এতবড় নাম আমি বলতে পারব না।’ প্রত্যুত্তরে ও তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিল, ‘না এটা হবে না। শামসুদ্দিন আর শামসুন্নাহার নামে এত সুন্দর মিল আমি কিছুতেই ভাঙতে দিবো না।’ হানিফ পরিবহনের কোচটি ইতোমধ্যে দেশনেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সৃষ্টি ছয় লেনের মহিপাল ফ্লাইওভার অতিক্রম করল। চট্টগ্রাম কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের ৮০ ফিট প্রশস্ত রোড ধরে কোচটি কক্সবাজার সড়ক ধরে ছুটে চলেছে। আমার হার্টবিটও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কী জানি শামসুন্নাহারের খোঁজ পাব কিনা বেঁচে আছে কি নেই। আমি জগদীশকে বলেছি কক্সবাজারে সুগন্ধ পয়েন্টে অবস্থিত হোটেল সিগালে থাকতে। ওখানে হোটেলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে তার পর আমরা দুজনে মিলে ক্যাম্পগুলোতে শামসুন্নাহারদের খোঁজ করব। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জগদীশ কক্সবাজারের সিগাল আবাসিক হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করল। আমরা দু’জনে মিলে প্রথমদিনে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কক্সবাজারে বালুখালি ক্যাম্পের মধ্যে শামসুন্নাহারদের খুঁজে বেড়িয়েছি। কিন্তু পেলাম না। কীভাবে পাব? হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ শরণার্থী। ক্যাম্প ইনচার্জে নিযুক্ত বিজিপি কর্মকর্তাদের তালিকা চেক করেছি। আমার কাছে সংরক্ষিত শামসুন্নাহারের ছবি দেখিয়েছি। আব্দুল করিমের আকিয়াবের ঠিকানা বলেছি। তার গ্রামের বাড়ির কথাও বলেছি। মংডুর রাখাইন ইনদিন গ্রামের ঠিকানা বলেছি। ডিজিটাল বায়োম্যাট্রিক রেজিস্টারে কোথাও তাদের খুঁজে পেলাম না। আশাহত ভগ্ন হৃদয় উপর্যুপরি চার পাঁচদিন জগদীশকে নিয়ে প্রায় প্রত্যেকটি ক্যাম্পেই খোঁজ করলাম। কিন্তু পেলাম না। উখিয়ার কোট বাজার থেকে টেকনাফ উখিয়ার মধ্যে বারোটি শরণার্থী ক্যাম্প রয়েছে। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ক্যাম্পে, বিভিন্ন ক্যাম্প সংলগ্ন আশপাশে বাজারেও খুঁজে পেলাম না। থাইনখালী বাজার টেকনাফের শাহপরিদ্বীপের জালিয়া পাড়া বাজার কোথাও পেলাম না। শরণার্থী ক্যাম্পগুলো ক্রমান¦য়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভিড়ে ভয়ানক মানবেতর পরিবেশে পরিণত হয়। সর্বত্রই এক নিয়মন্ত্রণহীন বিশৃঙ্খলা। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিযুক্ত বিজিপি পুলিশ সব ঠিকঠাক রাখতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রিলিফ নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারি। অস্বাস্থ্য পয়োনালী, পানীয় জলের প্রচ- অভাব। পর্যাপ্ত স্নানাগার নেই। প্রায় বস্ত্রহীন শিশুরা এখানে সেখানে মল ত্যাগ করছে। বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়াল এখানে সেখানে খাবারের আশায় ঘোরাঘুরি করছে। স্থানীয় ভবঘুরে বখাটে দালাল আর রোহিঙ্গা দালালরা একজোট হয়ে চুরিচামারি করে বেড়াচ্ছে। দেখার প্রায় কেউ নেই। বাংলা মদ, চরস, গাঁজা, আর ইয়াবার যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। নারী ব্যবসায়ী রোহিঙ্গা দালালরা স্থানীয় দালালদের যোগসাজশে দেদার ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছে। শরণার্থী ক্যাম্পগুলো বলতে গেলে নরককু-ে পরিণত হয়েছে। জামায়াতী ধর্ম ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে অহরহ নিরুৎসাহিত করে তুলছে। এ ব্যাপারে আরএস ও আল ইয়াকিন ক্যাডাররা সমানভাবে তৎপর। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ লেনদেন হচ্ছে। মাঝে মাঝে র‌্যাবের আনাগোনা দেখা গেলে বখাটেদের লাগাম টেনে ধরলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। অবশেষে মরুভূমিতে মরুদ্যানের মতো শামসুন্নাহারের সন্ধান পেলাম বালুখালি ক্যাম্পের বল খেলার মাঠের পাশে। রোহিঙ্গা সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন মুসলমান মেজর জেনারেলের সাথে আমার দেখা হলো। সেও রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের একজন আশ্রিত বাসিন্দা। তার নাম মেজর জেনারেল ওমর আব্দুল মুকিম। তিনি মুসলিম বিধায় এই নাম চাকরির ক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করতে পারেননি। সরকারি খাতায় তার নাম ছিল মেজর জেনারেল সিংলাঅং। ১৯৪৯ সালে রাখাইনে তার জন্ম। ১৯৮২ সালে তাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। জেনারেল ওমর মুকিম ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে শামসুন্নাহারকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে সাহায্য করেন। শামসুন্নাহার তখন তাদের গ্রামের বাড়ি মংডুর ইনদিনে ছিল না। সে আগস্ট মাসে তার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আকিয়াবে অবস্থান করছিল। ফলে ২৫ আগস্ট সেই ভয়াল কালরাতের গণহত্যার শিকার থেকে আপাতত সে বেঁচে গিয়েছিল। জেনারেল মুকিম শামসুদ্দিনকে আর জানাল যে বর্তমান মিয়ানমারে গণহত্যার অন্যতম কসাই মেজর জেনারেল মাউং সোয়ের একসময়ের তারই অধীনস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিল বলেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার প্রতি আর শামসুন্নাহারের প্রতি কিছুটা সদয় ব্যবহার করেছিল। জেনারেল মুকিম আব্দুল করিমকে ভাল করেই চেনেন। তার গ্রামের বাড়ি মংড়ুর আন্দাং কুল্লুং বড়ছড়া গ্রামে। জেনারেলের কাছ থেকে জানতে পারলাম, রোহিঙ্গা আর্মিরা আব্দুল করিমের পরিবারের সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। করিমদের বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। করিমেরে স্ত্রীকে করিমের সামনেই অত্যন্ত পৈশাচিকভাবে দিবালোকে প্রকাশ্যে বলাতকার করে হত্যা করে। করিমের মেয়েটাকেও তারা মানবতার চূড়ান্ত অবমাননা করে ধর্ষণের পর হত্যা করে। কেবল শামসুন্নাহার ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল। শামসুন্নাহার জেনারেল মুকিমের সাথে টেকনাফে শাহপরীর দ্বীপখোলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সে এখন হাকিমপাড়া মহিলা ক্যাম্পে আছে। হাকিমপুর ক্যাম্পে গিয়ে দেখলাম সদ্যত্রিপল ছাউনি দেয়া হয়েছে। আগে বোধহয় পলিথিনের শেড ছিল, কিছুদিন আগে বৃষ্টি হয়েছে। আদ্রতাভেজা মেঝে। নিউমোনিয়া রোগীদের স¦াস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। সীমাহীন উদ্বেকাকুল টেনশন নিয়ে বলতে গেলে হন্তদন্ত হয়ে প্রায় দৌড়ে ক্যাম্পে ঢুকলাম। ঢুকে হাজার শরণার্থীর মধ্যে শামসুন্নাহারকে খুঁজতে লাগলাম। খুব তাড়াতাড়ি তাকে শনাক্ত করতে পারলাম। অবশ্য এ ব্যাপারে জেনারেল সাহেব আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। দেখলাম হৃদয়বিদীর্ণ সেই দৃশ্য। শামসুন্নাহার মেঝেতে পাতা একটা বাঁশের হোগলার চাটাইয়ের ওপর বিছানো বেশ পুরু একটি শতছিন্ন কাঁথার উপর শুয়ে আছে। আমাকে দেখে সে দারুণ খুশি হলো। মনে হলো সমস্ত পৃথিবীর সুখ যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সে আমার ডাকে সারা দিয়ে শয্যা ছেড়ে উঠে বসতে চেষ্টা করল। শীর্ণ হাতখানি খুব চেষ্টা করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে উদ্যত হলো। তার হাতখানি কাঁপছে। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে পুনরায় শুইয়ে দিয়ে প্রবোধ দিয়ে বললাম, থাক ! থাক ! তুমি শুয়ে থাক ! তবু সে উঠে বসল। তারপর আমার দিকে চোখে চোখ রেখে বিপুল অনুযোগ আর অভিমানী বাষ্পরুদ্দ অস্ফুট সুরে বলল, ‘ শামছু আমি জানি তুমি আসবে ! আমার শামসু না এসে পারেই না। কিন্তু এত দেরি করলে কেন? আমি সেই কবে হিমালয় ডিঙিয়ে ঠিক চলে এসেছি। তুমি এত দেরি করলে কেন ? শামসুন্নাহার একটা পাটের চটের ব্যাগ থেকে আমার দেয়া উপহারগুলো একটি একটি করে আমাকে দেখিয়ে বলল একটাও, হারাইনি। এগুলোর মাঝেই যে আমি তোমাকে খুঁজে পাই। এই অমূল্য ভালবাসার উপঢৌকনগুলো নিয়েই তো আমি এই দেড় মাস বেঁচে ছিলাম। আমি নির্বাক অবরুদ্ধ কণ্ঠে শুধু বললাম, ‘শামসুন্নাহার এখন তুমি কেমন বোধ করছো?’ ও বলল, ‘ভাল না বুকে ব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ভয় নেই এখন তুমি আমার পাশে আছো। সব ব্যথা ‘দেখবে সেরে যাবে’। আমি আর জগদীশ কোনরকম কালক্ষেপণ না করে খুব তাড়াতাড়ি কক্সবাজার শহরের সদরে গিয়ে একজন ভাল মেডিসিনের ডাক্তার ডেকে আনলাম। সুচিকিৎসায় সে আপাতত মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠল। ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতি নিয়ে আমি তিন চারদিনের জন্য শামসুন্নাহারের ওখানেই থেকে গেলাম। রাত্রে অবশ্য মহিলা ক্যাম্পে পুরুষদের থাকার অনুমতি নেই। আমি জেনারেল মুকিম চাচার ওখানে দু’রাত থেকে গেলাম। মুকিম চাচা একদিন কথায় কথায় আমাকে বলল, শামসুন্নাহার আসলেই তোমাকে খুব ভালবাসে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসতে কতকষ্ট, কত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। ওকে আমি বার বার বললাম। উপঢোকনের ব্যাগটা ফেলে দাও, তাহলেই আমরা তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে যেতে পারব। এদেশে এখন খুব বিপদ কখন কি হয়। কিন্তু ও ব্যাগটি ফেলে দেয়নি। ও বলেছে আমি শামসুকে ফেলে যেতে পারব না। ও আমাকে পই পই করে বলল, আমার এখানে ভাল লাগে না। আমাকে তুমি ঢাকায় নিয়ে চলো। তুমি না বলেছ তোমার মা আমাকে খুব দেখতে চায়?’ আমি শামসুন্নাহারকে বলেছিলাম, ‘তুমি একটু সুস্থ হয়ে নাও তোমাকে আমি একেবারে বউ সাজিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে যাব।’ ও বলেছিল, ‘কবে নিয়ে যাবে?’ আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশ সরকার ফরেনার্স ম্যারিজ এ্যাক্ট বা বিবাহ আইন গত ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাশ করেছে। এই আইনগত বাধাটা মিটিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসছি। ঢাকায় আমার এক বন্ধু আছে সে সব ঠিক করে দিবে ইনশাআল্লাহ্। আমি ঢাকায় চলে আসার সময় শামসুন্নাহার আমার হাতে তার দেয়া উপঢোকনের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ব্যাগটা কিন্তু খুব যন্ত করে রেখ। পরদেশি চলে যেও না কিন্তু । সেই হিন্দী গানের সুরটা একটু গলায় ভাঁজল। আমি ঢাকায় এসে আমার বাল্যবন্ধু ওয়েস্ট এ্যান্ড হাই স্কুলে যার সাথে একসঙ্গে পড়েছি সেই আনোয়ার এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। আনোয়ারের কাছে সব খুলে বললে সে একটা আইনগত যথাবিহিত ব্যবস্থা করে দিল। সেও চাইত আমি আর কতদিন বিপতœীক থাকব? বিয়েথা করে সংসারী হই। তাই সে স্বউদ্যোগী হয়ে কাজটি দ্রুত করে দেয়। আইনগত প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সপ্তাহখানেক সময় লেগে গেল। মায়ের কাছে শামসুন্নাহারের উপঢৌকন সংবলিত ব্যাগটি দেখালে মা বললেন, ‘তাড়াতাড়ি’ বৌমাকে নিয়ে আয়। আমার শরীর ভাল নেই। আর কতদিন বাঁচি ঠিক নাই। মৃত্যুর আগে বৌমাকে একবার দেখে যেতে চাই। তুই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বৌমাকে নিয়ে আয়। সাতদিন পর আমি যথারীতি বিয়ের উপঢৌকন সংবলিত লওয়াজিমার স্যুটকেসটি নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেই। এদিকে জগদীশ আর মুকিম চাচাকে সব ঠিকঠাক করে রাখার কথা বলে এসেছিলাম। ডাক্তার অবশ্য আসার সময় আমাকে বলেছিল, ‘রোগীর শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভাল নেই।’ কেবল মনের জোরেই টিকে আছে। ঢাকায় নিয়ে ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে। দেশে বর্তমানে প্রবল শৈত্যপ্রবাহ চলছে। সেই সাথে বৃষ্টিপাত। গত কয়েকদিন যাবত শীতজনিত কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নানা রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। কোথাও বৃষ্টির মতো শিশির পড়ছে। তাপমাত্রা দুই সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। বিগত সত্তর বছরেও যা নাকি কখনও হয়নি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডিফথেরিয়া ও নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। রোগব্যাধি উপশমের জন্য ক্যাম্পগুলোতে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমি ভীষণ টেনশন নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছি। মোবাইল ফোনে অবশ্য প্রায়ই শামসুন্নাহারের সঙ্গে আমার কথা হয়। তবে তার কণ্ঠস্বর খুবই ম্রিয়মাণ ও দুর্বল। অনেকটা নিরুত্তাপ নি®প্রাণ বলা যায়। সেই আগের প্রাণবন্ত মুড আর নেই যেন। হয়ত আমি খুব টেনশন করব বলেই সত্যটা আমার কাছে লুকিয়ে যাচ্ছে। আমি হাইপ্রেসারের রোগী, সে জানে পাছে যদি আমার কিছু অমঙ্গল হয়। আমার সওয়ারী হানিফ পরিবহনের কোচটি কক্সবাজার পৌঁছতেই মুকিম চাচা আমাকে মোবাইল ফোনে বলল, ‘গতকাল’ শামসুন্নাহার ভোর রাতে মারা গেছে। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম এনজিও সংস্থাটি তাকে গতকালই দাফন করে ফেলেছে। এই ক্যাম্পে দীর্ঘক্ষণ লাশ রাখার নিয়ম নেই। আমি আর হাকিমপুর শরণার্থী ক্যাম্পে গেলাম না। আমি আর জগদীশ যাত্রাপথ পরিবর্তন করে কর্ণফুলী নদীর ধারে চলে গেলাম। একটা সাম্পান ভাড়া করে মধ্য নদীতে আমার বিয়ের লওয়াজিমের স্যুটকেসটি কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দিলাম। আমার স¦প্নের সমাধি হলো। স¦প্নের বিসর্জন দিলাম। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললাম, ‘আমার শামসুন্নাহারের সঙ্গে আর ঘর করা হলো না। মায়ের জন্য আর বউ আনা হলো না। আরাকান রাজকুমারীর আজ কর্ণফুলী নদীতে সলিলসমাধি হলো। আর আমার স¦প্নের সমাধি হলো। সেদিন আকাশে ঘনকুয়াশার ভেতর মরা চাঁদ দেখা গেল। রংধনুর লাল রং দিয়ে শামসুন্নাহারের পায়ে আলতা পরানো আমার আর হলো না। আকাশ ধূসর কালো কেবলই অন্ধকার।
×