ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্দান্ত পারদর্শিতায় শেষ অবধি রানার্স আপ

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৩১ আগস্ট ২০১৮

দুর্দান্ত পারদর্শিতায় শেষ অবধি রানার্স আপ

বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে অর্ধাংশ নারী জাতির সমানতালে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই আজ এক বাস্তবোচিত ঘটনাপ্রবাহ। নারীরা আজ কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। একসময় নারীদের জন্য শিক্ষকতাই ছিল মহান এবং সর্বোত্তম পেশা। উন্নয়নের জোয়ারে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বহুমুখী পেশায় নারীদের সম্পৃক্ততা নজর কাড়ার মতো। শুধু তাই নয় ক্রিকেট ফুটবল খেলার মতো পুরুষের দাপটী আধিপত্যেও নারীরা কোনভাবেই পিছিয়ে নেই। ক্রিকেট-ফুটবলে যে শারীরিক সক্ষমতা এবং শক্তি প্রাবল্য সেখানে মেয়েরা একসময় পিছিয়ে ছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মেয়েরা ফুটবল বিশ্বে প্রবেশ করার ইতিহাস খুব একটা দীর্ঘ নয়। ছেলেদের ৩২ বছর পর মেয়েরা আন্তর্জাতিক ফুটবল আঙিনায় তাদের শুভযাত্রা করে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের ক্রান্তিলগ্নে মেয়েরা ফুটবল খেলায় নিজেদের অভিগমনকে দৃশ্যমান করে। শুধু তাই নয় দক্ষতা আর পারদর্শিকতায় নিজেদের প্রমাণ করতে তাদের খুব বেশি সময় লাগেনি। অনুর্ধ-১৪, ১৫ এবং ১৬ নারী ফুটবলাররা একেবারেই উদীয়মান কিশোরী। ফলে অভিজ্ঞতা, ব্যক্তির ক্ষমতা, দৃঢ় মনোবল থেকে শুরু করে দলীয় গতিশীলতা, পারদর্শিতা কিংবা সুসংসহত ব্যবস্থাপনা সব দিক থেকেই অপরিপক্ব বলা গেলেও ফলাফল এসেছে ঠিক তার বিপরীত। অর্থাৎ প্রাণবন্ত উচ্ছল তরুণীরা কতখানি মনোযোগী আর খেলার প্রতি নিষ্ঠতার পরিচয় দিতে পারলেই শুধু আন্তর্জাতিক খেলায় এমন অবিস্মরণীয় মুকুট অর্জন করা অসম্ভবই নয়, বিস্ময়করও বটে। ফুটবলের মাঠে কিশোরী খেলোয়াড়রা যেভাবে দাপটের সঙ্গে নিজেদের পারদর্শিতা প্রমাণ করে সেখানে বিজ্ঞ ফুটবলারও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। গত বছর অনুর্ধ-১৬ নারী ফুটবলার তাদের সেরা খেলাটি উপহার দিয়ে লাল সবুজের পতাকা মহিমান্বিত করেনি শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এশিয়ার সেরা আটে নিজেদের জায়গাও করে নেয়। এরই পর্যায়ক্রমিক ধারায় ভুটানোর রাজধানী থিম্পুর চালিমিখাং স্টেডিয়ামে অনুর্ধ-১৫ নারী ফুটবলার সাফ খেলার দ্বিতীয় আসরের সম্মুখ সমরে মোকাবেলা করেছে পাকিস্তানী নারী খেলোয়াড়দের সঙ্গে। ফুটবলে মেয়েদের প্রশংসিত অংশগ্রহণে আজ আলোকিত বাংলাদেশ। তরুণীদের দৃষ্টিনন্দন পারদর্শিতা ও অভাবনীয় সাফল্যে বিমুগ্ধ বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফা। ফিফার মতে বাংলাদেশের মেয়েরা যে নির্ভীক পদচারণায় ফুটবল বিশ্বে তাদের সম্পৃক্ততাকে জয় জয়কার করে তুলেছে তা সবার জন্য উদাহরণ। আর এই দৃষ্টান্ত বিশ্ব ফুটবলের নারীদের জন্য একেবারে রোল মডেল। থিম্পুতে পাকিস্তানকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়ে মারিয়া-তহুরার দল মোটেও বিচলিত হয়নি। শুরুর আগ থেকেই নিশ্চিত জয়ের সম্ভাবনায় বাংলাদেশী খেলোয়াড়রা বেশ মানসিক স্বস্তিতেই ছিলেন। বিশেষ করে তহুরা যার অনবদ্য গোল প্রদর্শন ইতোমধ্যে তাকে ‘গোল মেশিন’ অভিধায় অভিষিক্ত করেছে তিনি বেশ সতেজ মেজাজেই ছিলেন। এ ছাড়াও পূর্ববর্তী খেলায় জয়টা এসেছিল অধিনায়ক মারিয়া মান্ডার হাত ধরেই। তিনিও ছিলেন আত্মবিশ্বাসে টগবগ। দুই জনেই প্রত্যয়ের সঙ্গে ব্যক্ত করেন তারা চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসেছেন। শুধু তাই নয় কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটনের কাছে কঠোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েই এই আন্তর্জাতিক খেলায় যোগ দিতে এসেছেন। তারা তৈরি তাদের সেরা খেলাটা উপহার দিতে। শেষ পর্যন্ত অধিনায়ক মারিয়ার পুরো টিম তাদের সবটুকু দিয়ে বিজয় মুকুট ছিনিয়ে আনতে বেগ পেতে হয়নি। খেলার শুরুতে বাংলাদেশী নারী খেলোয়াড়রা যে পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে থাকে সেখান থেকে তাদের আর পেছনে যেতে হয়নি। ম্যাচের পুরো খেলাটাই মারিয়া-তহুরাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এমনই আধিপত্য ছিল তাদের ১৪টা নয় তারা নাকি আরও দশটা গোল দিতে পারত। স্ট্রাইকার শামসুন্নাহার জুনিয়র হ্যাটট্রিকসহ অনবদ্য চারটি গোল করে একাই। গত বছর নিজ দেশে অনুষ্ঠিত প্রথম আসরে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশী নারীরা। আর পাকিস্তানের বিপক্ষে পুরো খেলাটাকে নিজেদের আয়ত্তে রেখে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে মারিয়া-তহুরাসহ তাদের সহযোদ্ধারা। এমন অভাবনীয়, বিস্ময়কর খেলায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন ধারাভাষ্যকারসহ উপস্থিত দর্শক। দিশেহারা পাকিস্তানী গোলরক্ষকের শোচনীয় অবস্থাও দর্শনীয় ছিল। আর পাকি নারীরা তো ছিল পুরো খেলায় এক পরাজিত পরাভূত বিহঙ্গ। তবে দুর্ভাগ্য ছিল বাঙালী নারীদেরও। অনেক গোল তাদের মিসও করতে হয়। তা না হলে আরও বড় ব্যবধানে পাকিস্তানীরা ধরাশায়ী হতো। নেপালকেও ৩-০তে হারিয়ে দেয় বাংলার উদ্দীপ্ত কিশোরীরা, দাপটের সঙ্গে নিজেদের সেরাটা খেলতে গিয়েও প্রথম ৪৫ মিনিটে প্রতিপক্ষের রক্ষণাত্মক আক্রমণের মুখোমুখি পড়ে। বিরতির আগ মুহূর্তে দর্শকদের তাক লাগিয়ে নেপালকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে তুখোড় স্ট্রাইকার তহুরা প্রথম গোলটি উপহার দেয় তার সহযোদ্ধাদের। তবে বাংলাদেশের নারী খেলোয়াড়রা নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেতে খুব বেশি সময় নেয়নি যদিও তারা ২/১টি গোল মিসও করে। বাঙালী নারী খেলোয়াড়দের অসাধারণ খেলায় বিপর্যস্ত নেপালী নারীরাও রক্ষণাত্মক কৌশলে সতর্কাবস্থায় বিরোধী পক্ষকে ঠেকানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু এক সময় বাংলাদেশী মেয়েরা সমস্ত প্রতিরোধকে দক্ষতার সঙ্গে সামলিয়ে ম্যাচ জেতার মতো অবস্থানে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় গোলটি আসে অধিনায়ক মারিয়া মান্দার দুর্দান্ত পারদর্শিতায়। শেষ গোলটি মাজেদা খাতুনের অনবদ্যতায় বাংলাদেশ ৩-০তে এগিয়ে যায়। খেলা তখনও ২৩ মিনিট বাকি। এই সময়টাতে প্রতিপক্ষ কোন ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। চ্যাম্পিয়নশিপের খেলায় বাংলাদেশের পাল্লাটা ভারি হলেও মারিয়া-তহুরারা স্বাগতিক ভুটানের বিরুদ্ধে প্রথম সেমিফাইনালে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। তবে আত্মবিশ্বাসী উদীয়মান তরুণীরা লক্ষ্যে স্থির থেকে সেরা খেলাটা খেলতে চায় এবং আগের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে দৃঢ়প্রত্যয়ী। মারিয়া-তুহরা এবং গোলরক্ষক মাহ্মুদার অপ্রতিরোধ্য পারদর্শিতায় টানা ৩ ম্যাচে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করেও শেষ অবধি চ্যাম্পিয়ান শিরোপা হাতছাড়া হয়ে যায়। সেমিনে ওঠা বাঙালি কিশোরিরা চূড়ান্ত খেলায় মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ভূটানের। সেখানেও উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত তরুণীরা তাদের স্বভাবসুলভ দুর্দান্ত খেলায় ভূটানকে ও ৫-০তে পরাজিত করে চূড়ান্ত পর্বের ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হয়। কোন খেলাতেই আগের পারদর্শিতা তেমন কোন ভূমিকা রাখে না। তারপরেও মনোবল টিকে থাকলে ও খেলার শুরুটা একেবারেই আলাদাভাবে তৈরী হয়। তা ছাড়া খেলা সব সময়ই সেদিন খেলে সে দিনেরই খেলা। ফলে পূর্বের অভিজ্ঞতা সামনে এসেও দাঁড়ায় না। গত বার যাদের হারিয়ে লাল সবুজের মেয়েরা চ্যাম্পিয়ান ট্রফি জিতেছিল প্রথম আসরে সেই ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় আসরের চূড়ান্ত খেলায় নিজেদেরকে সেভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। চ্যাম্পিয়ান ভারও দর্শক মাতানো খেলা উপহার দিতে না পারলে ও ১-০ তে বাংলাদেশকে পরাভূত করে শিরোপা ফিরিয়ে নেয়। তারপরে ও হার-জিত যে কোন ফলাফলের অবধারিত নিয়ম। সেই চিরায়ত ধারাকে মেনে নিয়ে বাংলাদেশের ইতিবাচক খেলাকে বিবেচনায় আনা সঙ্গত। টানা ৩টি ম্যাচে যেভাবে প্রতিপক্ষকে কোন সুযোগ না দিয়ে জেতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সেটাও কম কৃতিত্বের নয়। বিদেশের মাটিতে পারদর্শিতা দেখনো সেও এক কঠিন ব্যাপার। দর্শক থেকে আরম্ভ করে পুরো পরিবেশ থাকে স্বাগতিকদের পক্ষে। দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় তাকে অতিক্রম করা কম গৌরবের নয়। সেখানে ছন্দপতন হওয়াটাও কি খুব অস্বাভাবিক? উদীয়মান তরুণীরা প্রাণচাঞ্চল্যে নিজেদের সম্পূর্ণ ভাবে সমর্পণ করে দেশের জন্য যে প্রাপ্তি এনে দিল তাকে কোনভাবেই ম্লান করা সমুচিত হবে না। আমরা খুশি, ভীষণ আনন্দিত আমাদের কিশোরীরা তাদের সবটুকু দিয়ে অন্য দেশের মাটিতে যা করে দেখালো তা অভিনব এবং চমকপ্রদ। রানার্স আপ হওয়ার জন্য তাদের আন্তরিক অভিনন্দন এবং অশেষ শুভেচ্ছা সামনে আরও সম্ভাবনাময় দিন অপেক্ষা করছে। নতুন উদ্যমে নিজেদের এগিয়ে নিতে হবে। ফলাফল যাই আসুক না কেন। আমরা ও সেভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×