ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নারীকে নিয়ে নজরুল যা ভাবতেন

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৩১ আগস্ট ২০১৮

নারীকে নিয়ে নজরুল যা ভাবতেন

ঊনবিংশ শতাব্দীতে আধুনিকতার জোয়ারে নবজাগৃতির হাওয়া বইলেও অবিভক্ত বাংলায় তখন অবধি নারীরা সামাজিক অভিশাপে জর্জরিতই নয় যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা অপসংস্কারের নিগঢ়েও কঠিনভাবে আবদ্ধ। এই রুদ্ধদ্বার আঘাত করার মতো সমকালীন নারীরা সেভাবে জেগেও ওঠেনি। প্রচলিত নিয়মবিধিকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ কিংবা ভাগ্যের লিখন হিসেবে মেনে নিতে তখনকার সময়ের নারীদের কোন কষ্ট কিংবা যন্ত্রণার কথা লিপিবদ্ধ হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নে যখন শিক্ষার আলোয় সারা বাংলা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে তখন শিক্ষিত পুরুষরাই ভাবতে শুরু করলেন পেছনে পড়ে থাকা নারী সমাজকে আলোকিত করা ছাড়া পুরো সমাজের অন্ধকার ঘুচবে না। রাজা রামমোহন রায়ই সর্বপ্রথম স্ত্রী শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে অপসংস্কারে আকণ্ঠ ডুবে থাকা অর্ধাংশ এই জাতিকে নতুন পথের সন্ধান দিতে তৎপর হলেন। তারপরে শৃঙ্খলিত সমাজের অবরোধবাসিনীরা অত সহজে নির্বিঘেœ সামনের দিকে এগুতে পারেনি। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এসব নারী অন্ধকারকে পেছনে ফেলে আলোর দিকে এগিয়ে যেতে আরও সময় ব্যয় করতে হয়। নারী প্রগতির অন্যতম প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুধু নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করতেও বদ্ধপরিকর হলেন। তিনি মনে করতেন শিক্ষাই মূল নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে অবোধ বালিকাদের সমস্ত সামাজিক আবর্জনা থেকে বের করে আনবে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা থেকে শুরু করে বিধবাবিয়ে প্রচলনই শুধু নয় পুরুষদের বহু বিবাহের কবল থেকেও নারীরা মুক্তি পাবে। তবে এই শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নেও নারী শিক্ষার দ্বার সবার জন্য অবারিত হয়নি। নারীরা সেভাবে পেছন থেকে সামনের দিকেও এগুতে পারেনি। স্মরণ করা যেতে পারে আধুনিক নারী জাতির অগ্রনায়ক বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে জন্ম নিয়েও প্রাতিষ্ঠানকি শিক্ষার দ্বার স্পর্শ করতেও পারলেন না। আর ১৮৯৯ সালে জন্ম নেয়া নজরুল ইসলাম বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও প্রত্যক্ষ করলেন অসহায় নারী জাতির অপমান, অসম্মানই শুধু নয় অধিকার ও স্বাধীনতা হরণের মতো অলঙ্ঘনীয় প্রতিরোধও। সৃষ্টিশীল উন্মাদনায় যখন সর্বমানুষের জয়গান গেয়ে যাচ্ছেন তখন এই অবহেলিত নারী সমাজও তাঁকে নানামাত্রিকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। ফলে ক্ষুরধার শৈল্পিক সত্তা যখন অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত সেই প্রয়োজনীয় সময়ে নারীরাও তাদের অধিকার আদায়ে তার সৃজনদ্যোতনার অনুষঙ্গ হয়েছে। সেই বোধে নারীর প্রতি গভীর মমতা আর সহানুভূতিতে নজরুল তার নান্দনিক শৌর্যকে নিয়তই একীভূত করেছেন। নারীকে মানুষের মর্যাদা দিতে গিয়ে তার শৈল্পিকশৈলীতে যে তাড়না অনুভব করেছেন তা শুধু প্রচলিত সমাজের নিয়মানুগ ব্যবস্থাই নয় তাকে অতিক্রম করে নতুন আলোয় আলোকিত করার প্রত্যয়ও দীপ্যমান হয়েছে। তাঁর মতে নারীর অধিকার ও স্বাধীন সত্তা বিঘিœত হওয়ার কারণ শুধু সমাজ কিংবা পুরুষ নয় নারীরা নিজেও তার সবচেয়ে বড় বাধা। তারা আবহমানকাল থেকে গড়ে ওঠা সমস্ত অপসংস্কারকে ভাগ্যলিপির বিধান হিসেবে মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছে। নিজেরা কখনও এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কিংবা প্রতিবাদও করেনি। অথচ ধর্মাশ্রিত সমাজের কোন ধর্মই নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা প্রদানের ক্ষেত্রে কোন বাধা প্রতিবন্ধকতার বিধান রাখেনি। হিন্দু ধর্মে দশভুজা দুর্গা নারী শক্তি ও অধিকার আদায়ের সচেতন প্রতিনিধি। শুধু তাই নয় সমাজের সমস্ত অশুভ শক্তি বিনাশেরও কল্যাণময়ী ত্রাতা। যুগে যুগে নারী শক্তির এই অবিচলিত সাহস আর উদ্দীপনা নারী জাতির অনির্বাণ শিখার শুভপ্রতীক। আর ইসলাম ধর্মে হযরত মুহম্মদ (স) প্রথম আল্লাহর ওহীর বার্তা পেয়ে সহধর্মিণী বিবি খাদিজাকে অবহিত করেছিলেন। স্ত্রী খাদিজাই সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে স্বামীর নতুন যাত্রাপথে একান্ত সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাই নয় সমস্ত মানবজাতিকে কবি এই ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নারীদের যথার্থ সম্মান দিতে উদাত্ত আহ্বান জানান। পুরুষদের অর্ধেক আসন কল্যাণময়ী নারীদের ছেড়ে দেয়ার অনুরোধও কবির পক্ষে করা হয়। প্রতিটি ধর্মীয় শাস্ত্রে নারী-পুরুষের তারতম্য সেভাবে দৃশ্যমান না হলেও মোল্লা-পুরুষ ও শাস্ত্রজ্ঞরা সেখানে পর্বত প্রমাণ প্রাচীর তুলে দিয়েছে। মানুষসৃষ্ট এই প্রতিবন্ধকতা ভেঙে নারীদের বেরিয়ে আসা ছাড়া মুক্তির আর কোন পথ খোলা নেই। এ সম্পর্কে কবির বক্তব্য উল্লেখ করা হলোÑ ‘আমাদের পথে মোল্লরা যদি হন বিন্ধ্যাচল, তাহা হইলে অবরোধ প্রথা হইতেছে হিমাচল। আমাদের বাংলাদেশের স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানদের যে অবরোধ, তাহাকে অবরোধ বলিলে অন্যায় হবে, তাহাকে একেবারে শ্বাসরোধ বলা যাইতে পারে। আমাদের দেশের মেয়েরা বড় হতভাগিনী। কত মেয়েকে দেখলাম কত প্রতিভা নিয়ে জন্মাতে, কিন্তু সব সম্ভাবনা তাদের শুকিয়ে যায় প্রয়োজনের দাবিতে। ঘরের প্রয়োজনে তাদের বন্দী করে রেখেছে। তাদের ঘিরে রেখেছে বারো হাত লম্বা এবং আট হাত চওড়া দেয়াল।’ প্রাচীর ভাঙ্গার দুঃসাহসিকাদের তিনি সমস্ত প্রতিরোধকে অতিক্রম করার উদাত্ত আহ্বান জানান। এই প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙানোর জন্য পুরুষের সহযোগিতা ছাড়াও আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বের হয়ে আসতেই হবে। কবি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অনুভব করতেন নারীদের অর্গল শুধু বাইরের থেকে নয় ভেতর থেকেও বন্ধ। সেই বদ্ধ দ্বারে সজোরে কড়া নাড়তে হবে নারীদেরই। নিজের মুক্তি উদ্দীপ্ত চেতনার নারীকেই আদায় করে নিতে হবে। শৃঙ্খলিত নারীরা শেকল ভাঙার শক্তি অর্জন করতে না পারলে মুক্ত পথে এগিয়ে চলা মুশকিল হবে। সমাজ ও পরিবারের পর্দা এবং অবরোধ প্রথা নারী শিক্ষাকেও পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষা নামক মহামূল্যবান সম্পদ অর্জন করতে না পারলে মুক্তির বারতা অবারিতও হবে না। অন্ধকারের কালো অধ্যায় নারী শিক্ষার সবচেয়ে বড় প্রাচীর, শুধু শিক্ষায় আলোকিত হলেই চলবে না অধিকার আদায়েও প্রত্যয়ী হতে হবে। সেই লক্ষ্যে সৃজনশীল কর্মকা-েও নিজেদের সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয়। বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের মতো স্বশিক্ষিত, সৃজনদ্যোতনায় নিবেদিত নারীরা ছিল নজরুলের কাছে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। সেই বোধে সমগ্র নারী জাতিকে জেগে ওঠার জোরালো প্রত্যয় ও প্রত্যাশা করেন তিনি। তার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় সৃজনশীল নারীদের জন্য ‘সন্ধ্যা প্রদীপ’ নামে একটি বিভাগ উন্মুক্ত রাখা হতো। যেখানে নারীরা তাদের অধিকার ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সুযোগ পেত। অনেক নারী জ্বালাময়ী বক্তব্যও পেশ করত ‘সন্ধ্যা প্রদীপে।’ সে লেখা শুধু পুরুষদের নয় অনেক নারীকেও মর্মাহত করত যা কবির জন্য ছিল নিতান্ত বেদনাদায়ক।
×