ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এরপরই পাসপোর্ট ও বিআরটিএ ॥ টিআইবির খানা জরিপে তথ্য

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩১ আগস্ট ২০১৮

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা দেশের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি পরিচালিত ‘সেবা খাতে দুর্নীতি সংক্রান্ত জাতীয় খানা জরিপে’ এই তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের ফল তুলে ধরে সংস্থাটি বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার পাশাপাশি দেশের পাসপোর্ট ও বিআরটিএ সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। এই তিন খাতে ঘুষ নেয়ার পরিমাণ অনেক বেশি। এ ছাড়াও বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, শিক্ষা (সরকারী ও এমপিওভুক্ত) এবং স্বাস্থ্যখাতও দুর্নীতিগ্রস্ত। বৃহস্পতিবার সকালে টিআইবির ধানমণ্ডি কার্যালয়ে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সেবাখাতে দুর্নীতি সংক্রান্ত এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়েছে ’১৭ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের শতকরা ৬৬.৫ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। গত বছরে শতকরা ৪৯.৮ খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে। তবে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সেবা খাতে ঘুষের শিকার খানার হার কমলেও ঘুষ আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। খানাপ্রতি বার্ষিক গড় ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৪ হাজার ৫৩৮ টাকা থেকে বেড়ে ’১৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৩০ টাকা। জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ ২০১৫ সালের ৮ হাজার ৮২১.৮ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৬৮৮.৯ কোটি টাকা। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৩.৪ এবং বাংলাদেশের জিডিপির শূন্য দশমিক ৫। গবেষণার তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয় শুধু ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ বিবেচনায় সেবা নিতে গিয়ে বিআরটিএ খাতে সর্বাধিক খানা ঘুষের শিকার হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও পাসপোর্ট সেবায় ঘুষের শিকার হয়েছে যথাক্রমে ৬০.৭ ও ৫৯.৩ খানা। তবে খাতওয়ারী হিসেবে বিভিন্ন খাতে খানাপ্রতি প্রদত্ত গড় ঘুষের পরিমাণ বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান পঞ্চম। ২০১৭ সালের খাতওয়ারী হিসেবে প্রতিটি খানা গ্যাস খাতে গড়ে ৩৩ হাজার ৮০৫ টাকা (সর্বোচ্চ), বিচারিক সেবা খাতে ১৬ হাজার ৩১৪ টাকা, বীমা খাতে ১৪ হাজার ৮৬৫ টাকা, ভূমি সেবা খাতে ১১ হাজার ৪৫৮ টাকা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা খাতে ৬৯৭২ টাকা ঘুষ দিয়েছে। ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যায় না’ এই কারণটি চিহ্নিত করেছে জরিপে অন্তর্ভুক্ত ৮৯ ভাগ খানা। ২০১৫ সালে যার হার ছিল ৭০.৯ ভাগ। এর মাধ্যমে ধারণা করা যায় যে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা জানান দেশের খানাগুলোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকৃতি ও মাত্রা নিরূপণসহ দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে দেশের আট বিভাগে গ্রাম ও শহরাঞ্চলের সমন্বয়ে তিন পর্যায় জরিপটি পরিচালিত হয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খানাসমূহ পনেরোটি প্রধান ও অন্যান্য খাতে যেসকল সেবা গ্রহণ করেছে তার ওপর ভিত্তি করে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ ’১৮ জরিপের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। জরিপের বৈজ্ঞানিক মান নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আট বিশেষজ্ঞের সার্বিক সহায়তা ও পরামর্শ গৃহীত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্ব ও প্রভাব রয়েছে এমন পনেরোটি প্রধান খাতসহ ওয়াসা, বিটিসিএল ও ডাকসেবাকে ‘অন্যান্য খাত’ হিসেবে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পনেরোটি প্রধান খাত হলো: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি সেবা, কৃষি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুত, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বীমা এবং গ্যাস। গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের তুলনায় ’১৭ সালে গ্যাস, কৃষি, বিচারিক সেবা, বিদ্যুত, বিআরটিএ, স্বাস্থ্য (সরকারী), বীমা ও এনজিও খাতে দুর্নীতি বৃদ্ধির বিপরীতে শিক্ষা (সরকারী ও এমপিওভুক্ত), পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি সেবা, কর ও শুল্ক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা খাতে দুর্নীতি কমেছে। তবে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির হার ২০১৫ সালের তুলনায় ’১৭ সালে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। আবার ’১৫ সালের তুলনায় ’১৭ সালে কৃষি, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, বীমা, স্বাস্থ্য (সরকারী), গ্যাস ও এনজিও খাতে ঘুষের শিকার খানার হার বৃদ্ধির বিপরীতে শিক্ষা (সরকারী ও এমপিওভুক্ত), পাসপোর্ট, ভূমি সেবা, বিদ্যুত, কর ও শুল্ক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং খাতসহ ‘অন্যান্য খাত’ (ওয়াসা, বিটিসিএল, ডাকসেবা ইত্যাদি) এ ঘুষের শিকার খানার হার কমেছে। তবে সার্বিক ঘুষের হার কমলেও দায়িত্ব পালনে অনীহা, অসদাচরণ ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানি, প্রতারণা, স্বজনপ্রীতি, প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপ প্রভৃতি অনিয়ম-দুর্নীতির হার ’১৫ সালের তুলনায় ’১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আত্মসাতজনিত দুর্নীতি কমেছে। পাশাপাশি হয়রানি বা জটিলতা এড়ানো, নির্ধারিত ফি জানা না থাকা এবং নির্ধারিত সময়ে সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষ দেয়া খানার সংখ্যা তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। পক্ষান্তরে, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সেবা পাওয়া এবং অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির জন্য ঘুষ দেয়া খানার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ’১৭ সালে বিভিন্ন খাতে সরকারের ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, তদারকি বৃদ্ধি এবং স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন সার্বিকভাবে এবং কয়েকটি (সাতটি) সুনির্দিষ্ট খাতে ঘুষের শিকার হওয়া খানার হার হ্রাস পাওয়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে গবেষণায় চিহ্নিত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সেবা খাতে দুর্নীতিতে কিছুক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও সার্বিক তথ্য উদ্বেগজনক। ঘুষের শিকার হওয়ার হার কমলেও পরিমাণ বেড়েছে। বিচারিক খাতের দুর্নীতিও উদ্বেগজনক। যারা অনিয়ম করছেন, তারা ঘুষকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে। যারা দিচ্ছে তারা জীবনযাপনের অংশ করে নিয়েছে। সরকারী কর্মচারীদের বেতন বুদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আশা করা হয়েছিল বেতন বৃদ্ধির পরে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু যারা দুর্নীতি করেন তাদের জন্য বেতন বৃদ্ধি কোন উপাদান নয়। প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, দুর্নীতি কমাতে হলে দেশ পরিচালনায় যারা আছেন, তাদের সদিচ্ছা জরুরী। ঘুষ না দিলে সেবা দেয় না যারা, তারা জবাবদিহিতার সম্মুখীন হচ্ছে না। এই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের তারা দায়িত্ব পালন করছে না। তিনি বলেন, দুর্নীতি আমাদের জীবন সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। তাই দুর্নীতিতে বসবাস এবং অবাধ দুর্নীতি মেনে নিয়ে চলতে হচ্ছে। কিন্তু জাতিগতভাবে এটা অসম্মান এবং অমর্যাদাকর। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ওয়াহিদ আলম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোহাম্মদ নূরে আলম।
×