ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক ১৭ লাখ;###;ডিজিটাল ব্যাংকিং ২

গ্রামগঞ্জেও সেবা, জুন পর্যন্ত লেনদেন সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩১ আগস্ট ২০১৮

গ্রামগঞ্জেও সেবা, জুন পর্যন্ত লেনদেন সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

রহিম শেখ ॥ ব্যাংকের শাখা নেই অথচ হিসাব খোলা, টাকা জমা-উত্তোলন, রেমিটেন্স গ্রহণ, বিল প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা পাওয়া যাচ্ছে গ্রামগঞ্জে। এসব সেবা মিলছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। যেখানে ব্যাংকের শাখা নেই সেখানে এজেন্টই হয়ে উঠেছে ব্যাংকের শাখা। আর এসব এজেন্ট এখন সারাদেশের ৫ হাজার ৩৫১টি আউটলেটে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এতে ব্যাংক শাখার বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহক হয়েছেন ১৭ লাখ মানুষ। লেনদেন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, এজেন্ট ব্যাংকিং হলো, শাখা না খুলে চুক্তি করে প্রতিনিধির মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দেয়া। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ টু আই প্রকল্পের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায়ে সেবা সম্প্রসারণ করেছে অনেক ব্যাংক। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ২০১৪ সালে ব্যাংক এশিয়া প্রথমে এ সেবা চালু করে। এজেন্ট ব্যাংকিং হলো- সমঝোতা স্মারকে চুক্তির বিপরীতে এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকিং সেবা দেয়া। কোন ধরনের বাড়তি চার্জ ছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ২০১৩ সালের প্রথম নীতিমালায় প্রথমে শুধু পল্লী এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের অনুমতি দেয়া হলেও পরের বছর নীতিমালায় কিছুটা সংশোধন আনা হয়। সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী যেখানে ব্যাংকের শাখা নেই এমন পৌর ও শহর অঞ্চলেও এজেন্ট নিয়োগ দেয়া যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। বর্তমানে কার্যক্রম চালাচ্ছে ১৭টি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ গ্রাহক এ্যাকাউন্ট খুলেছেন। লেনদেন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই সময়ে মোট স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। রেমিটেন্স সংগ্রহের পরিমাণ ৩ হাজার ৫১৪ কোটি ২২ লাখ টাকা, ঋণ বিতরণের পরিমাণ ১৩৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের এজেন্টের সংখ্যা তিন হাজার ৫৮৮টি এবং যাদের আউটলেট রয়েছে ৫ হাজার ৩৫১ টি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের জুন মাস শেষে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় মোট জমার পরিমাণ ২ হাজার ১২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে গ্রামের মানুষের জমার পরিমাণ ১ হাজার ৬৫৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আর শহরাঞ্চলের মানুষের জমার পরিমাণ ৩৫৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪৪৪ কোটি টাকা জমা করেছেন ৬ লাখ ৯ হাজার ৮২৪ এজেন্ট ব্যাংকিং নারী গ্রাহক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেটের সংখ্যা ৫ হাজার ৩৫১টি। আর এজেন্টের সংখ্যা ৩ হাজার ৫৮৮টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে এ্যাকাউন্ট খোলার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে খোলা মোট এ্যাকাউন্ট সংখ্যার ৫৩ শতাংশের বেশি এ ব্যাংকের। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানে যথাক্রমে ব্যাংক এশিয়া এবং আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে বর্তমানে ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৪৮৩ গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট রয়েছে। ব্যাংক এশিয়ায় রয়েছে ৫ লাখ ১৪ হাজার ৪০২ গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে রয়েছে ১ হাজার ৬৩৬ গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের ৩৫ হাজার ২৭১, অগ্রণী ব্যাংকের ৩৪ হাজার ৩৫৮, মধুমতি ব্যাংকের ৩৪ হাজার ১৪৫, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ২৯ হাজার ৭৭৭, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২২ হাজার ৫০৩, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২০ হাজার ৯৮৪, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১১ হাজার ২০৯, দি সিটি ব্যাংকের ৮ হাজার ৩৫৪, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৬ হাজার ৫৬২, মিডল্যান্ড ব্যাংকের ২ হাজার ৮১৫, দি প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১ হাজার, এবি ব্যাংকের ৪৩০, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৩৪১ ও এনআরবি ব্যাংকের ১৩০ হিসাব খোলা হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৭৭০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে শীর্ষে অবস্থান করছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ডাচ-বাংলা ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করেছে ৫৯৯ কোটি টাকা ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা ব্যাংক এশিয়া আমানত নিয়েছে ৩৭৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এদিকে ঋণ বিতরণে শীর্ষে রয়েছে ব্যাংক এশিয়া। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১২৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক করেছে ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ। তৃতীয় অবস্থানে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ঋণ করেছে ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মূল লক্ষ্য হলো এজেন্টের মাধ্যমে জনগণকে ব্যয়সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দেয়া ও এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতিশীলতা আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী প্রতিনিয়ত প্রসার ঘটছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের। মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোঃ শফিউল আজম জনকণ্ঠকে বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিং হবে মধুমতি ব্যাংকের মূল ফোকাস। আমাদের লক্ষ্য দেশের সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পর্যায়ে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারণ। আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে দুই শ’র বেশি ডিজিটাল পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, চলতি বছরে আমাদের টার্গেট এক হাজার ডিজিটাল এজেন্ট পয়েন্ট স্থাপন। জানা গেছে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহক তার চলতি হিসাবে সর্বোচ্চ চারবার ২৪ লাখ টাকা জমা এবং সর্বোচ্চ দুটি লেনদেনে ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করতে পারেন। সঞ্চয়ী হিসাবে সর্বোচ্চ দুবার আট লাখ টাকা নগদ জমা এবং সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা করে দুটি লেনদেনে ছয় লাখ টাকা উত্তোলন করা যায়। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেটের মাধ্যমে ইনওয়ার্ড রেমিটেন্স বিতরণে বড় ভূমিকা রাখছে। দুই হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা রেমিটেন্স গ্রহণ করেছেন গ্রাহকরা। এছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নতুন ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলা, এ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলন, টাকা স্থানান্তর (দেশের ভেতর), বিভিন্ন মেয়াদি আমানত প্রকল্প চালু, ইউটিলিটি সার্ভিসের বিল পরিশোধ, বিভিন্ন প্রকার ঋণ উত্তোলন ও পরিশোধ এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সরকারী সকল প্রকার ভর্তুকি গ্রহণ করা যায়। এজেন্টরা কোন চেক বই বা ব্যাংক কার্ড ইস্যু করতে পারেন না। এজেন্টরা বিদেশী সংক্রান্ত কোন লেনদেনও করতে পারেন না। এছাড়া এজেন্টদের কাছ থেকে কোন চেকও ভাঙ্গানো যায় না। এজেন্টরা মোট লেনদেনের ওপর কমিশন পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মোট গ্রাহকের ৩ শতাংশ দিনমজুর। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ২৯ শতাংশ গ্রাহক ছোট ব্যবসায়ী। এছাড়া, মোট গ্রাহকের ৭ শতাংশ কৃষক ও ১৮ শতাংশ গৃহিণী। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকিং খাত ও সরকারী সহযোগিতার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের পুনর্জাগরণ ঘটেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুসন কর্মসূচী হাতে নেয়ার কারণে। উল্লেখ্য, ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকে গবর্নর হিসেবে যোগ দেয়ার পরই ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুসন কর্মসূচী হাতে নেন। আতিউর রহমান বলেন, ওই সময় ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুসন কার্যকর করতে মুদ্রানীতি কাজে লাগানো হয়। টাকা যাতে গ্রামের মানুষের হাতে সহজে পৌঁছায় সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ জন্য পেমেন্ট সিস্টেম আধুনিক করা হয়। তিনি বলেন, আগে চেক দিলে টাকা জমা হতে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় লাগত। এখন সেটি কয়েক সেকেন্ডে জমা হয়। যখন পেমেন্ট সিস্টেম আধুনিক হলো তখনই মোবাইল ব্যাংকিং আইডিয়া মাথায় এলো। পাশাপাশি শুরু করা হয় এজেন্ট ব্যাংকিং। যেখানে ব্যাংক কখনও যেতে পারেনি সেখানে এজেন্ট ব্যাংকিং কাজ করছে।
×