ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের বৈঠক বর্জন

ইভিএম ব্যবহারের বিধান রেখে আরপিও সংশোধন

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৩১ আগস্ট ২০১৮

ইভিএম ব্যবহারের বিধান রেখে আরপিও সংশোধন

শাহীন রহমান ॥ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিরোধিতা এবং বৈঠক বর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন ইভিএমের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। বৃহস্পতিবার কমিশনের বৈঠকে শেষে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা। তবে জানান, আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কিনা সে বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তবে ব্যবহারের জন্য কমিশন প্রস্তুত থাকবে। আরপিও সংশোধন সংক্রান্ত কমিশনের বৈঠক কমিশনার মাহবুব তালুকদার বর্জন করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এখন এটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর তা আলোচনার জন্য আগামী সংসদ অধিবেশনেই এটি তোলা হবে এবং পাস হবে। আরপিও সংশোধনী সংসদে পাস হলে আগামী নির্বাচনে ইভিএমে ভোট নেয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হতে পারে বলে জানা গেছে। ইসির প্রস্তুতি সেই ভাবে নেয়া হচ্ছে। আগামী নির্বাচনেই কমিশনের ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তের কথা সিইসি না বললেও ইতোমধ্যে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইতোমধ্যে কমিশন সচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দেড় লাখ ইভিএম মেশিন কেনার জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছে। আরপিও সংশোধন হলেই আগামী নির্বাচনে এক তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা ইসির থাকবে। আগামী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিন্তাভাবনা করছে নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছে। ইসি সচিব জানান, তাদের প্রাথমিক প্রস্তুতির প্রায় ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বাকি কাজ তফসিল ঘোষণার পর কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করা হবে। নবেম্বরের মাঝামাঝি পর্যায়ে এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি তাদের রয়েছে। এদিকে মতবিরোধ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি তারা আরপিও অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরপিও সংশোধনের জন্য কমিশনের বৈঠক ডাকা হয়। বেলা ১১টায় বৈঠক শুরু হলেও ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে কমিশনার মাহবুব তালুকদার শেষ পর্যন্ত বৈঠক বর্জন করেন। পরে এর বিরোধিতা করে নোট অব ডিসেন্ট দেন। তবে ৫ সদস্যের কমিশনের একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকলেও কমিশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতের ভিত্তিতে আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। এর আগে গত ২৬ আগস্ট রবিবার কমিশনের বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। স্বল্প সময়ের জন্য বৈঠক বসলেও কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা শেষ হয়। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তারা ফের আলোচনায় বসে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার সভাপতিত্বে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে কমিশনের সভা বসে। বৃহস্পতিবার কমিশনের বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে মাহবুব তালুকদার ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আমরা চারজন সম্মত হয়েছি। তবে আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত এখনও নেননি তারা। বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে- এমন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমাদের প্রস্তুতি থাকবে। আরপিও সংশোধন নিয়ে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় কমিশন সভা শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা ছাড়া ইভিএম ব্যবহারের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বেরিয়ে আসেন মাহবুব তালুকদার। এরপর বেলা পৌনে ২টা পর্যন্ত কমিশনের সভা চলে। মাঝে আধা ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকেল ৫টায় শেষ হয় গুরুত্বপূর্ণ এই সভা। এরপর তিন নির্বাচন কমিশনার মোঃ রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী এবং ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন সিইসি নুরুল হুদা। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ইভিএম বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পেলে পরবর্তী প্রক্রিয়া শেষে সংসদে উপস্থাপন করা হতে পারে। এবার আরপিও সংশোধনে অনেক প্রস্তাব এলেও মূলত ইভিএমের বিষয়টি ছিল মুখ্য। নিজেদের এই অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছি। সংসদের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত সংস্কার হলে সংসদে ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি হবে। কমিশন কোন সময়ে সিদ্ধান্ত নিলে প্রস্তুতি নেয়া যাবে। পরিবেশ পরিস্থিতি ‘অনুকূলে’ থাকলে আগামী নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুতি রাখা হবে উল্লেখ করেন। নোট অব ডিসেন্টে যা উল্লেখ করেছেন মাহবুব তালুকদার ॥ এদিকে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে বিরোধিতা করে কমিশন সভা শুরুর আধা ঘণ্টার মাথায় কমিশনার মাহবুব তালুকদার সভা বর্জন করে বেরিয়ে কর্মচারীর মাধ্যমে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন ‘আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনে ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করি না। ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করছি। এই আপত্তির কারণ হিসেবে ইভিএম নিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধিতা’ এবং ‘দক্ষ জনবলের অভাব’ এর কথা বলা হয়েছে ওই নোট অব ডিসেন্টে। সর্বশেষ কমিশন সভার (২৬ আগস্ট) প্রসঙ্গ টেনে উল্লেখ করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনে ইসি ওই বৈঠকে তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে আরপিও বাংলা ভাষায় রূপান্তর, যা একজন পরামর্শক তৈরি করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইংরেজী আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জন। আর সর্বশেষ প্রস্তাবটি ছিল একাদশ সংসদ নির্বাচনে সময় স্বল্পতার কারণে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন। কমিশন সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে কেবল ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়। যা ৩০ আগস্ট বৃহস্পতিবারের সভায় আলোচনার জন্য মুলতবি করা হয়। সরকারী দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। এ অবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে ইভিএম ব্যবহারের কোন সম্ভাবনা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ইভিএম নিয়ে সরকারী ও বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। আর সিইসি প্রথম থেকেই বলে এসেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আরও আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি উল্লেখ করেন শুরুতে স্থানীয়ভাবে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার হয়েছিল। এজন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার ইভিএম কেনায় ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। সম্প্রতি ৩৮২১ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কোন কোন রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন মনে জাগে। তিনি উল্লেখ করেন পরিকল্পনা কমিশন এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি। যে ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে বিনা টেন্ডারে কেনা হচ্ছে, তার কারিগরি বিষয় বুয়েট বা অনুরূপ কোন সংস্থা থেকে যাচাই করা হয়নি। কারিগরি দিক থেকে এ যন্ত্র সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হয়নি। আরপিওতে শুধু ইভিএম ব্যবহারের যে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে তা ইতোমধ্যে কমিশন সভায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, আমি ধারণা করি, জনমত বা সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহৃত হলে তা নিয়ে আদালতে অসংখ্য মামলার সূত্রপাত হবে। অন্য কারণ ছাড়া কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বর্তমান ইসির পক্ষে এ ঝুঁকি নেয়া সঙ্গত হবে না। যন্ত্রের অগ্রগতির এ যুগে ইভিএম ব্যবহারের ‘বিরোধী নন’ জানিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেছেন, স্বল্প সময়ে এত বিশাল জনবলের প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ততা এবং ভোটারদের অজ্ঞতাপ্রসূত কারণে ইভিএম নিয়ে অনীহাও থাকবে। সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনে কিছু বিশৃঙ্খলা এবং ইভিএম কেন্দ্র দখলের অভিযোগের কথাও নোট অব ডিসেন্টে তুলে ধরেছেন তিনি। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে কে এম নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার নোট অব ডিসেন্টে পাঠিয়ে তিনি ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে। এ সংক্রান্ত বৈঠক বর্জন করেন। গত ২০১০ সালে দেশের প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ইভিএম ব্যবহারের করে শাসছুল হুদা কমিশন। ওই সময় থেকে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে কেবল ইভিএম ব্যবহার হয়ে আসছিল। সর্বশেষ গাজীপুর, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট এবং বরিশাল সিটি নির্বাচনেও কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট নেয়া হয়। অন্যসব কেন্দ্রে যেখানে ব্যালট পেপারে ভোট নেয়া হয়েছিল তার চেয়ে ইভিএম নেয়া কেন্দ্রগুলোতে দ্রুত ফল প্রকাশ করা হয়। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ব্যাপক পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হয়নি। যদিও একবার কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে সন্ধ্যার মধ্যে ফল ঘোষণা করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু মাঝখানে কিছু ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহারে জটিলতা দেখা দেয়া ব্যাপক পরিসরে এটি ব্যবহার থেকে সরে আসে ইসি। এখন জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করা হচ্ছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ এবং সমমনা দলগুলো ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে। যদিও ইসির পক্ষ থেকে বরাবরেই জানানো হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি থাকবে নির্বাচন কমিশনের। শেষ পর্যন্ত তারা এটি ব্যবহারের আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
×