ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘দুই দশকেও বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশের জোট দেড় শ’ কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বড় কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি’

৭ দেশের বিদ্যুত সঞ্চালন গ্রিড ॥ বিমসটেক শীর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩১ আগস্ট ২০১৮

৭ দেশের বিদ্যুত সঞ্চালন গ্রিড ॥ বিমসটেক শীর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান

বিডিনিউজ ॥ বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা এগিয়ে নিতে দুই দশক আগে যাত্রা শুরু করা আঞ্চলিক জোট বিমসটেক যে এ অঞ্চলের দেড়শ কোটি মানুষের জীবন-মান উন্নয়নে বড় কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে জোটভুক্ত দেশগুলোকে আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিডের মাধ্যমে জোটভুক্ত সাত দেশকে যুক্ত করার উদ্যোগের মতো আরও কয়েকটি ক্ষেত্র তিনি জোটের নেতাদের সামনে তুলে ধরেছেন, যেখানে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সবাই লাভবান হতে পারে। নেপালের কাঠমা-ুতে বৃহস্পতিবার চতুর্থ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতির পরও প্রতিষ্ঠার ২১ বছরে বিমসটেকের সাফল্য হাতেগোনা।’ এ প্রেক্ষিতে বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিমসটেকের সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো নতুন করে বিবেচনা করতে এবং জোটের কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে বহু কাজ বাকি। এই যৌথ চেষ্টাকে অর্থবহ সম্পর্কের রূপ দিতে চাইলে, সহযোগিতার দৃশ্যমান ফল চাইলে আমাদের মৌলিক আইনী কাঠামোগুলো আরও সংহত করার কথা আমাদের ভাবতে হবে।’ আর এ লক্ষ্যে বিমসটেক ফোরামের মাধ্যমে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল সৃষ্টি, বিনিয়োগ ও জ্বালানি সহযোগিতা বৃদ্ধি, সদস্য দেশগুলোর নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং একটি যৌথ অর্থায়ন কৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা আরও বাড়ানোর ওপর জোর দেন শেখ হাসিনা। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছে বিমসটেক; কাজ করছে সার্ক ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতার একটি সেতুবন্ধ হিসেবে। ১৯৯৭ সালে ব্যাঙ্কক ঘোষণার মধ্য দিয়ে বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল এ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন বা বিমসটেকের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে কেবল বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড এর সদস্য হলেও পরে মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান বিমসটেকে যোগ দেয়। বিশ্বের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোতে বসবাস করে বলে বিশেষজ্ঞরা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই জোটের অপার সম্ভাবনার কথা বলে এলেও জোটভুক্ত দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ একেবারেই কম। এর মূল কারণ হিসেবে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও অবকাঠামোর দুর্বলতা এবং আঞ্চলিক অর্থনীতিতে সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে কাঠমা-ুর হোটেল সোয়ালটি ক্রাউনি প্লাজার মেঘনা মালহার হলে বিমসটেকের চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমেই সম্মেলন কেন্দ্রে আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আসেন ভুটানের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দাশো শেরিং ওয়াংচুক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মৈত্রি পালা সিরিসেনা ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ও-চা। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি অতিথিদের স্বাগত জানান। মঞ্চে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা ছিল দেশের নামের ক্রমানুসারে। বেলা ৪টার দিকে নেপালের জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির উদ্বোধনী বক্তব্যের পর বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। এই পরিবর্তন আর বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে বিমসটেককেও তাল মেলাতে হবে; আর তা করতে হবে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে। বাংলাদেশ যে বিমসটেকের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়, ঢাকায় বিমসটেক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা সেই অঙ্গীকারেরই বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। বিমসটেককে বিশ্বের সম্ভাবনাময় একটি অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ অঞ্চলে আন্তঃবাণিজ্য সম্প্রসারণের বিশাল সুযোগ রয়েছে। সদস্য দেশগুলোর উচিত ‘এখনও কাজে না লাগানো’ এই সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা। ২০১৬ সালে ভারতের গোয়ায় বিশেষ বিমসটেক রিট্রিটের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে নেয়া ১৬টি এজেন্ডার মধ্যে কয়েকটি বাস্তবায়ন হয়েছে, কিন্তু অনেকগুলো এখনও বাকি। বিমসটেক ফোরামকে সুসংহত, কার্যকর ও মনোযোগের কেন্দ্রে এনে এ জোট থেকে ভাল কিছু পেতে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ১৪টি সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন’ ক্যাটাগরিতে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জ্বালানি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং কৃষি বিষয়ক সহযোগিতা, ‘নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা’ ক্যাটাগরিতে নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ‘মানুষে মানুষে যোগাযোগ’ ক্যাটাগরিতে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও জনস্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, কয়েকটি বিমসটেক দেশ ইতোমধ্যে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের মাধ্যমে পরস্পরের বিদ্যুত গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। অন্যরাও এগিয়ে এলে তা বিমসটেক বিদ্যুত গ্রিডের রূপ নিতে পারে। দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সন্ত্রাসকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাধারণ শত্রু হিসেবে বর্ণনা করে এ সব বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলা, সন্ত্রাস দমন এবং বাণিজ্য-বিনিয়োগ বৃদ্ধির চেষ্টায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ আর সাফল্যের বিস্তারিত বিবরণ শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, উন্নয়ননির্ভর করে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা দূর করে বৈষম্যহীন সুষম উন্নয়ন নীতি নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার একটি যৌথ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে এ বারের সম্মেলন শেষ হবে। নেপালের কাছ থেকে বিমসটেক চেয়ারের দায়িত্ব পাবে শ্রীলঙ্কা। লাল গালিচা সংবর্ধনা ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সকালে নেপালের রাজধানী কাঠমা-ু পৌঁছলে তাঁকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। তিনি বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল এন্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক)-এর ৪র্থ সম্মেলনে যোগ দিতে দু’দিনের সরকারী সফরে কাঠমা-ু পৌঁছেন। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইট নেপালের স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ১০ মিনিটে কাঠমা-ুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রী ঈশ্বর পোখারেল এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক ও নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। এখানে প্রধানমন্ত্রীকে নেপালী সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। অভ্যর্থনা পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রীকে একটি সুশোভিত মোটর শোভাযাত্রাসহকারে তাহাচেল মার্গ এলাকায় হোটেল সোয়ালটি ক্রাউন প্লাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। নেপাল সফরকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রী এ হোটেলেই অবস্থান করবেন।
×