ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৩১ আগস্ট ২০১৮

বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ

ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সমরবিদ বলে খ্যাত আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ছিলেন প্রাচীন ম্যাসেডোনিয়া এবং পারস্যের রাজা। প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা যা ইতোপূর্বে কেউ কখনও দেখেনি। তিনি শুধু বিশ্ববিজয়ী বীর ছিলেন না সেই সঙ্গে ছিলেন একজন মহৎ হৃদয়ের মানুষও। পারস্য সাম্রাজ্য জয় করার পর তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিলেন। আলেকজান্ডার যতগুলো যুদ্ধ করেছিলেন, তার মধ্যে পাঞ্জাবের রাজা পুরুর বিরুদ্ধে তাঁর এই আক্রমণকে সুবিখ্যাত সামরিক অভিযান বলে মনে করা হয়। ইতিহাসে বলা হয়েছে যুদ্ধ শেষে বিজয়ী রাজা আলেজান্ডারের সমীপে শিকলে বেঁধে যখন হাজির করা হলো ঝিলাম নদীর তীরে পৌর বা রাজত্বের পরাজিত রাজা পুরুকে তখন বিশ্ববিজয়ী বীর আলেকজান্ডার তাকে প্রশ্ন করেছিলেন- তুমি আমার কাছে এখন কি আচরণ আশা কর? সেই প্রশ্নের উত্তরে পুরু তখন বলেছিলেনÑ একজন রাজার সঙ্গে রাজার আচরণের মতো। সত্যি সত্যি বিজয়ী আলেকজান্ডার পরাজিত পুরুর সঙ্গে আচরণ করলেন একজন রাজার মতোই। তিনি সে মুহূর্তেই শত্রু পুরুর বন্ধনমুক্ত করে সসম্মানে পাশে বসিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, পুরুকে রাজার সম্মান দিয়ে ফিরিয়ে দিলেন তার রাজ্যপাট। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দুনিয়ায় অবিশ্বাস্য একজন গ্রেট ছিলেন বাংলাদেশের মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ স্বাধীনের আগে কিংবা পরে তিনি তাঁর শত্রু মিত্র নানাজনের কাছে মানুষ হিসেবে যে অসামান্য মহানুভবতা দেখিয়েছেন তার বিবরণ রয়েছে অসংখ্য। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে খ্যাত শাহ আজিজুর রহমান সম্ভবত জীবনের এক দুর্বল মুহূর্তে নিজমুখে বলেছিলেন মুজিবের অজানা কিছু কথা। শেখ মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশ মুসলিম লীগ গঠিত হবার পর তিনি এই দলে যোগ দেন। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগদানেই পর তিনি জিয়া মন্ত্রিসভার শ্রমমন্ত্রী হন ও ১৯৭৯ সালে শাহ আজিজ হয়েছিলেন সংসদের নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী। শাহ আজিজুর রহমানের কথা বলতে গিয়ে তার পূর্ববর্তী রাজনৈতিক জীবনে পরিচয় প্রসঙ্গে এখানে কিছু বলা প্রয়োজন। তিনি ছিলেন ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। এরপর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে যোগ দিয়ে তিনি মার্চ ১৯৬৪ সালে যোগদান করেন আওয়ামী লীগে। এরপর তিনি নির্বাচিত হন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। ১৯৬৫ সালে তিনি কুষ্টিয়া থেকে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছিলেন। ছাত্র অবস্থা থেকে এসব দিনগুলোতে তিনি নানাভাবে জড়িয়ে ছিলেন মুজিবের জীবনে। মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন ১৯৭০-এর নির্বাচন কালেই তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে কুষ্টিয়া থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন। অতঃপর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় শাহ আজিজ ভোল পাল্টে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে সমর্থন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিন্দা জানিয়ে বহু বক্তৃতা বিবৃতি দেন। তিনি ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি। জাতিসংঘে শাহ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর আজিজুর রহমানকে ‘দালাল আইন’ অনুযায়ী পাকিস্তানের সহযোগী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা গণহত্যা ধর্ষণ ইত্যাদি ভয়ঙ্কর কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না সেই ধারায় ১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সাধারণ ক্লিসেস্মির অধীনে মুক্তি পান। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমি সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যোগ দিয়েছিলাম সরকারী চাকরিতে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশক্রমে আমাকে প্রধানমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই সময়টিতে সরকারী দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনে আমি ও আরও কিছু সরকারী কর্মকর্তাকে প্রায়শই যেতে হতো প্রধানমন্ত্রীর হেয়ার রোডের বাড়িতে। প্রকাশ্যে বক্তৃতা বিবৃতিতে- সংসদ অথবা জনসভায় তিনি প্রায়শই আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিব সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য রাখতেন। আমি ও তার সঙ্গে যারা কাজ করতেন এরকম ক’জনের সামনে সহসাই একদিন নিভৃত মুহূর্তে টেনে আনলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণের অতি আশ্চর্য এক কথামালা। শাহ আজিজুর রহমান ঐদিন তার স্মৃতিচারণ শুরু করছিলেন যেদিন মামলা থেকে মুক্তি পেলেন জামিনে। তিনি বলেছিলেন যে, কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজ বাড়িতে নয় জেল গেট থেকে সরাসরি চলে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মুজিবের ধানম-ি ৩২ নম্বর বাসভবনে। প্রধানমন্ত্রী তাকে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানানোর পর কিছু কুশল বিনিময় হয় এবং তারপরই মুজিব অপ্রত্যাশিতভাবে শাহ সাহেবকে উপহার দিলেন ৫৫৫ সিগারেটের একটি প্যাকেট নয় পুরো এক কার্টুন। কারণ, তিনি জানেন নামী আইনজীবী শাহ আজিজ সবচেয়ে দামী এই ব্র্যান্ড ছাড়া সিগারেট পান করতেন না। বিশাল হৃদয় এক মানুষ স্বাভাবিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, জেল থেকে বেরিয়ে শাহ সাহেবের পক্ষে অনেকদিন এই সিগ্রেট কেনা সম্ভব হবে না। জিয়াউর রহমানের প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা এই পর্যন্ত বলে তার কাহিনী শেষ করেননি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে যেন পেছন ফিরে চলে গেলেন যখন অন্তরীণ ছিলেন কারাগারে। বলা শুরু করলেন সেই সময় নিয়ে। ’৭২ সালে আমি যখন জেলখানায় ছিলাম তখন আমার স্ত্রী তিন নাবালক সন্তানসহ বসবাস করতেন পুরনো পল্টনের এক ভাড়া বাড়ির নিচ তলায়- যার দোতলায় বসবাস ছিল মালিকের। আর্থিক অসামর্থ্যরে কারণে স্ত্রীর পক্ষে কয়েকমাস ভাড়া পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। একদিন সকালে বাড়িওয়ালা গালিগালাজ করে বলল-শালা রাজাকারের বাচ্চা তো কখনও জেলখানা থেকে ছাড়া পাবে না আর আপনারা আমাকে কখনও ভাড়াও পরিশোধ করতে পারবেন না। এই বলে আমার পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে আসবাবপত্র ফেলে দিল রাস্তায়। সেসময় আমার ও পরিবারের পরিচিত কুষ্টিয়ার একটি হিন্দু ছেলে যে বাড়ির পাশের গলিতে একটি লন্ড্রিতে কাজ করত সে কারোর সহায়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের কাছে খবরটি সত্বর পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। আর সে খবর শুনে তোফায়েল আহমেদ অতি দ্রুত ধানম-ি ৩২ নম্বরে গিয়ে মুজিবের কাছে সেই খবরটি দেন। তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী মুজিব তখন প্রতিমন্ত্রীকে এই দায়িত্বটি দিয়ে ব্যাপারটি অবিলম্বে ফায়সালা করতে নির্দেশ দিলেন। শাহ সাহেব সেই প্রসঙ্গে আরও বললেন যে, প্রতিমন্ত্রী অবিলম্বে ভাড়া বাড়িতে ছুটে গিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে তাৎক্ষণিকভাবে লোকজনের ব্যবস্থা করে তার পরিবারকে বাড়িতে ঢুকিয়ে জিনিসপত্র ভেতরে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। ব্যাপারটি নিশ্চয়ই তোফায়েল আহমেদের আজ স্মরণ থাকবার কথা। এরপর থেকে মুজিবের পক্ষ থেকে কারা অন্তরীণ শাহ সাহেবের বাড়ি ভাড়া ও পরিবারের ভরণপোষণের জন্য নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শাহ আজিজ তার জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার দিনটিতে ফিরে গিয়ে কিছু আবেগপ্রবণ হয়ে আরও বলেছিলেনÑ মুজিব পরিশেষে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি আমার জন্য কিছু করতে পারেন কিনা? তখন আমার উত্তর ছিল ‘এই মুহূর্তে আমার কিছু টাকার প্রয়োজন’। এই কথা শোনামাত্রই প্রধানমন্ত্রী স্ত্রীকে ডেকে বললেন- শাহ সাহেব আজই জেলখানা থেকে বেরিয়েছেন। এ মুহূর্তে তার হাত শূন্য। একথা শুনে বেগম মুজিব তাৎক্ষণিকভাবে অন্তপুর গিয়ে হাতে করে কিছু ব্যক্তিগত টাকা এনে স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন শাহ আজিজকে দেবার জন্য। এখানেই এর শেষ হয়নি। মুজিবুর রহমানের হাত থেকে অর্থ গ্রহণ করবার পর তিনি চিন্তিত কণ্ঠে বলেছিলেন- আপনার তো ঢাকায় কোন নিজস্ব বাড়ি নেই। এবনডস্ট (পরিত্যক্ত) বাড়ি থেকে কোন একটি আপনার জন্য ব্যবস্থা করে দেই? তবে এজন্য আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলাম ওটার কোন প্রয়োজন হবে না। কারণ, এখন আমি যেহেতু মুক্ত সে কারণে কিছুদিনের মধ্যে আইনজীবী হিসেবে নিজের প্র্যাক্টিস শুরু করতে পারব। সেদিন শেখ মুজিব প্রসঙ্গে একই বৈঠকে আরও একটি ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন শাহ আজিজ। তখন বাকশাল গঠনের সময় কেউ কেউ আমাকে মুজিবের নাম করে সেখানে যোগদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করে চলেছিলেন। আমি বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়ে শেখের সঙ্গে দেখা করে বললামÑ আপনি কি সত্যিই আমাকে বাকশালে জয়েন করতে বলেছেন? কিন্তু মুজিব আমাকে স্পষ্টস্বরে জানালেন এমন কথা তিনি কখনও কাউকেই বলেননি। তবে সেই সঙ্গে তিনি সেদিন আমাকে সম্পূর্ণ অন্য এক ধারণাতীত বিষয়ে অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তি ও অগ্রগতির জন্য কেবল আওয়ামী লীগ নয় তিনি সকল দল ও মতের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার জন্য সংকল্পবদ্ধ। আরও বলেছিলেন- ‘বাকশালে যোগদান করা বা না করার স্বাধীনতা আপনার আছে। কিন্তু আপনি কি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কোন কাজ করতে চান?’ আমি তাৎক্ষণিকভাবে তাকে জানিয়েছিলাম যে অবশ্যই আমি সেটি করতে চাই। শাহ সাহেবের বাসায় বশির বলে অনেক পুরনো একজন লোক কাজ করতেন। কোন প্রসঙ্গে খেপে গেলে তিনি বক বক করে সবার সামনে বলতেন- এখন বক্তৃতা করতে গিয়া শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে কথা কন! যখন ওনার বাড়ি থাইকা টাকা আইনা দিতাম তা ভুইলা গেছেন? অহনো শেখ স্যারের দেয়া গাড়িটা আপনার গ্যারেজে রইছে! শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আমরা যারা সরকারী কাজ করতে তার বাড়িতে যেতাম তখন বশিরই এই গাড়িটি আমাদের দেখিয়েছিলেন। বশির বলেছিলেন পাকিস্তানী আমলেও শেখ সাহেব প্রয়োজন হলে শাহ সাহেবকে টাকা পয়সা দিয়ে সহায়তা করতেন। গ্যারেজের ভেতর রাখা বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত গাড়িটি শুধু আমি নই বহুজনই দেখেছেন। আলেকজান্ডারের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমাদের মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রসঙ্গে আর একটি কাহিনী না বললে চলবে না। যে আলাপন ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন সেই রফিকুল্লাহ চৌধুরী সিএসপির। মনে করিয়ে দেয়া জরুরী যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রফিকুল্লাহ চৌধুরী ষাটের দশকের মধ্যভাগে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি। সেই সঙ্গে তিনি একদিকে যেমন ছিলেন সুদর্শন তেমনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত তুখোড়। এই প্রসঙ্গে বলে নেয়া ভাল বর্তমান সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী তার কন্যা। বঙ্গবন্ধু নিয়ে আলাপ চারিতার জন্য সময়টা ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। তথাপি সেই পরিবেশে মাঝে মাঝে তাঁর মুখ থেকে একান্ত নির্জন কক্ষে বসে বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা সম্পর্কে বেশ কিছু ঐতিহাসিক কাহিনী শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমরা সে সময়কার মানুষেরা জানি দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধিতা করে যারা পাকিস্তানী পক্ষ নিয়েছিল তাদের বহুজনকে গ্রেফতার করে কারাগারে রেখেছিলেন সে সময়কার সরকার। কিন্তু একথা জানি না বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ওই সমস্ত ব্যক্তির মধ্যে যারা হত্যা ও ধর্ষণ কিংবা কোন ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না সেসব প্রবীণ রাজনীতিবিদদের আর্থিক অসুবিধাগ্রস্ত পরিবারের জন্য মাসিক ভাতা প্রদানের ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। রফিকুল্লাহ চৌধুরী একদিন গল্পচ্ছলে জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মহানুভবতার আর এক অভাবিত অজানা ইতিহাস। তিনি সেদিন বিবৃত করেছিলেন এই অর্থ প্রদান তদারকির দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়ভাজন এই তরুণ কর্মকর্তার হাতে। কিন্তু কাউকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকার পাত্র কি বঙ্গবন্ধু ছিলেন কখনো? শত ব্যস্ততার মাঝে একদিন হঠাৎ করে প্রশ্ন করলেন তরুণ একান্ত সচিবকে- পরিবারগুলোর সবাইকে কি টাকা পৌঁছানো হয়েছে? -জি না স্যার, কিছু সমস্যার কারণে এখনও কয়েকটি পরিবারকে দেয়া সম্ভব হয়নি। অপ্রস্তুত কণ্ঠে রফিকুল্লাহ চৌধুরী জবাব দিয়েছিলেন। শুনে গম্ভীর ও ব্যথাহত কণ্ঠে শেখ মুজিব বলেছিলেন- আজ মাসের সাত তারিখ অথচ এখনও তাদের কারও কারও কাছে টাকা পৌঁছানো বাকি রয়ে গেছে? তুমি কি করে বুঝবে পরিবারের প্রধান জেলে থাকলে সংসারের অন্যদের কত নিদারুণ কষ্ট পোহাতে হয়Ñ আমি তো সেটা জানি! হঠাৎ করে মাথা টাথা চুলকে জবাব দিয়েছিলেন তরুণ একান্ত সচিব -স্যার, আমিও তো প্রায় একবছর জেল খেটেছিলাম... -খেটেছিলে সেটাতো ভাল করেই জানি। কিন্তু সে সময় তোমার কি সংসারের প্রতি কোন দায়িত্ব ছিল? তুমি তো তখন ছাত্র- বিয়েই করনি! লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×