ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বধ্যভূমিতে গণহত্যা দিবস পালন

শহীদ জায়ার জীবন চলে ভিক্ষাবৃত্তিতে, কেউ পায়নি স্বীকৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩০ আগস্ট ২০১৮

শহীদ জায়ার জীবন চলে ভিক্ষাবৃত্তিতে, কেউ পায়নি স্বীকৃতি

বিশ্বজিৎ মনি ॥ দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট। বাংলা ১১ ভাদ্র শনিবার। কাকডাকা ভোর। সেদিন সূর্যটা ঠিকই উঠেছিল। বইছিল বাতাস। প্রাণচাঞ্চল্য ছড়িয়ে ছিল গ্রামজুড়ে। নিভৃতপল্লী পাকুড়িয়া গ্রামে পাকিহানাদার বাহিনী তাদের সহযোগী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে এলো গ্রামে। গ্রামের যুবকদের জড়ো করা হলো স্থানীয় ইউনাইটেড হাই স্কুলের মাঠে। সেখানে তাদের ওপর স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্রাশফায়ার চালালো হানাদার বাহিনী। শহীদ হলেন, মুক্তিকামী ১২৮ জন মানুষ। পেরিয়ে গেছে স্বাধীনতার ৪৭ বছর। কিন্তু আজও মেলেনি শহীদদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। সেদিনের হত্যাযজ্ঞে শহীদ হওয়া কয়েকজনের স্ত্রীর জীবন চলছে এখনও ভিক্ষাবৃত্তি করে। অনেক বিধবার ভাগ্যেও জোটেনি বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতার অনুদান। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া অনেকে বেঁচে আছেন অন্যের গলগ্রহ হয়ে। মান্দা উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামে এই অবস্থাতেও মঙ্গলবার বর্বরোচিত গণহত্যা দিবসের ৪৭তম বার্ষিকীতে পালন করা হলো নানা কর্মসূচী। আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল ও গণভোজের মধ্য দিয়ে নওগাঁর মান্দায় ঐতিহাসিক পাকুড়িয়া বধ্যভূমিতে গত মঙ্গলবার পালন করা হলো গণহত্যা দিবস। শহীদ পরিবার কল্যাণ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয়ের যৌথ আয়োজনে এদিন বেলা ১১টার দিকে বিদ্যালয়ের হলরুমে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। শহীদ পরিবার কল্যাণ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আব্দুল লতিফ ম-লের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামানিক এমপি প্রধান অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দকার মুশফিকুর রহমান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরদার জসিম উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা ব্রহানী সুলতান গামা, আব্দুল লতিফ শেখ, জহুরুল ইসলাম, অনুপ কুমার মহন্ত, থানার অফিসার ইনচার্জ মাহবুব আলম, মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান, মুক্তিযোদ্ধা মোবারক আলী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ডাঃ ইকরামুল বারী টিপু, শহীদ পরিবারের পক্ষে জসিম উদ্দিন, প্রধান শিক্ষক পিয়ার বক্স ম-ল, আবুল কালাম আজাদ, গৌতম কুমার মহন্ত প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। পরে নিহত শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। ৪৭ বছর আগে এদিন পাকি হানাদার বাহিনী নওগাঁর মান্দা উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। ওই হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছিলেন এলাকার ১২৮ জন মুক্তিকামী মানুষ। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন ১৮ জন। তাদের একজন মমতাজ উদ্দিন। কোমরে বুলেট নিয়ে আজও তিনি বেঁচে আছেন। পাকুড়িয়া ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয়ে অফিস সহকারীর চাকরি করতেন। বর্তমানে তিনি চাকরি থেকে অবসরে রয়েছেন। তিনিই জানালেন ঐতিহাসিক গণহত্যা দিবসের বর্বরতার সেই ইতিহাস। মমতাজ উদ্দিন জানান, প্রতিদিনের মতো সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় সবেমাত্র ঘুম ভাঙছে গ্রামবাসীর। হঠাৎ গুলির শব্দে ঘোর কাটে। গ্রামবাসী ঠিক ঠাহর করতে পারেন না কোথায় এই অশনি সঙ্কেত। গ্রামের স্কুল মাঠের দিকে নয় তো! এরপর আর ফুরসত নেই। ততক্ষণে বন্দুকের নল উঁচিয়ে পাকি সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়েছে গ্রামের ভেতরে। একটু চালাকি করলেই বুক ভেদ করবে ঘাতকদের বুলেট। নিরুপায় গ্রামবাসী বন্দুকের নলের ইশারায় হাঁটতে থাকে গ্রামের স্কুল মাঠের দিকে। যুবক থেকে বৃদ্ধ প্রায় সকলকেই সমবেত করা হয় সেখানে। তাদের বুঝতে বাকি থাকে না কি ঘটতে যাচ্ছে তাদের ভাগ্যে। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে মমতাজ উদ্দিন জানান, মিটিংয়ের নামে মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর সারিবদ্ধভাবে বসানো হয় তাদের। হঠাৎ অচেনা ভাষায় গর্জে উঠল পাকি মেজরের কণ্ঠ। সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগান হাতে মাঠে শুয়ে পড়লেন কয়েকজন ঘাতক কমান্ডার। মেজরের নির্দেশ মাত্রই গর্জে উঠল তাঁদের মেশিনগান। চারদিক থেকে নামছিল গুলির বৃষ্টি। মুহূর্তে রক্তের বন্যায় ভেসে উঠল মাঠের সবুজ ঘাস। আর মৃত্যু যন্ত্রণার আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠল। সেদিন শরীরের বিভিন্নস্থানে চারটি গুলি লাগলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ছাবেদ আলী (৭২)। এ হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছিলেন তার বাবা লহির উদ্দিন ও ভাই আবেদ আলী। এদিন গুলিবিদ্ধ হাছেন আলী, আশরাফুল ইসলাম, আফসার আলী, আফজাল হোসেন, ইমান আলী ও নাছের উদ্দিন ওরা সকলেই পঙ্গুত্ব নিয়ে সেদিনের পাকি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন। পঙ্গুত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করে ইতোমধ্যে শমসের আলী, হেদায়েতুল্লা, জোনাব আলী, মেরুল্যা শাহ, আকন্দি, গাবু পাথর, নসরতুল্যাসহ অনেকেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। সেদিনের হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছিলেন নহির উদ্দিন, সাবির উদ্দিন, মসলেম উদ্দিন, ইসমাইল হোসেন, মহির সরদার, আব্বাস আলী, ফজের আলী চৌকিদার, সরুজ ম-ল, ঝড়ু ম-ল, বজের পাথর, প্রফুল্ল দেওয়ান, মাদার বক্সসহ ১২৮ জন। ঘাতকরা সেদিন ফজের চৌকিদারের বিধবা মা বুলন বেওয়াকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। বধ্যভূমির সরকারী একটি ফলক থেকে জানা যায় এসব তথ্য। তবে, ফলকে ১২৮ জনের মধ্যে ৭৩ জনের নাম দেখা গেলেও বাকিদের পরিচয়ের উল্লেখ নেই ফলকে। তবে সেদিনের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া অনেকে জানান পাকি হানাদার বাহিনী যখন পাকুড়িয়া গ্রামে আসছিল তখন রাস্তা থেকে অনেক বাঙালীকেও ধরে নিয়ে আসে এবং তাদেরও স্কুল মাঠে হত্যা করা হয়। ফলে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও পাকুড়িয়ার এই শহীদপল্লীতে সরকারের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টি পড়েনি। বধ্যভূমির একপাশে মাত্র কয়েক বর্গফুট গণকবরে সেদিনের শহীদদের সমাধিস্থ করা হয়েছে। স্থানীয় উদ্যোগে গণকবরটি ঘেরা হয়েছে আড়াই ফুট উঁচু ইটের প্রাচীর দিয়ে। সরকারী উদ্যোগে নির্মিত একমাত্র তোরণটি দেখে বোঝা যায় পাকিহানাদার বাহিনী সেখানে বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শহীদ পরিবারের সদস্যরা একবার ৫ হাজার টাকা করে অনুদান পেয়েছিলেন। এটিই তাদের প্রথম ও শেষ পাওয়া। শহীদ পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করে বলেন, স্বামী-সন্তান হারিয়ে গ্রামের দুই বিধবা নারী কাতরজান বেওয়া ও আবিজান বেওয়া এখনও ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ভিক্ষাবৃত্তি করতে করতেই শহীদ জননী ওকিনা বেওয়া কয়েক বছর আগে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। দিনটিকে স্মরণ করতে শহীদ পরিবারের সদস্যরা প্রতিবছর বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার শহীদ পরিবার কল্যাণ ব্যবস্থাপনা কমিটি এ বধ্যভূমিতে তাদের প্রিয় স্বজনদের স্মরণে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে (সরকারীভাবেও পালন করা হয় না এই দিনটি!)। শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, ৭১ থেকে আজ পর্যন্ত তারা সংগ্রাম করেই বেঁচে আছেন। স্বজন হারানোর কষ্ট পাথরচাপা দিয়ে রেখেছেন বুকে। পাওয়া না পাওয়ার বেদনার কথাও আর বলতে চান না তাঁরা। তারা দাবি করেন, শহীদদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হোক।
×