ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উঁচু ভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় থাকবে সিসি ও মুভি ক্যামেরা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৩০ আগস্ট ২০১৮

উঁচু ভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় থাকবে সিসি ও মুভি ক্যামেরা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সভা-সমাবেশে হামলা ঠেকাতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একুশে আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলাসহ বহু হামলার অভিজ্ঞতা থেকে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। নির্ধারিত জায়গায় সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সভা-সমাবেশের আশপাশের উঁচু ভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ীভাবে শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা ও মুভি ক্যামেরা গোপনীয়ভাবে স্থাপন করাসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব ক্যামেরা অপরাধী, অপরাধে ব্যবহৃত যানবাহন, সন্দেহভাজন বস্তু শনাক্তসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হবে। ঘটনাস্থলে থাকা সবার কর্মকা-ও মনিটরিং করা যাবে এসব ক্যামেরার সাহায্যে। ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি বিভাগীয় শহরে উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়টি সরেজমিনে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্পও বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ঢাকাকে নিরাপদ ও যানজটমুক্ত শহর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এজন্য পুলিশের কন্ট্রোলরুম শাহবাগ থেকে সরিয়ে সচিবালয়ের সামনে নবাব আব্দুল গণি রোডে স্থাপন করে আধুনিক করার কাজ শুরু হয়। ১৪তলা ভবনের নির্মাণ চলতে থাকে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে মাত্র ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। ঢাকাকে নিরাপদ শহর হিসেবে গড়ে তুলতে লাগানো হয় মাত্র ১৫৫টি সিসি ক্যামেরা। যা পরবর্তীতে অচল হয়ে যায়। পুলিশ সদর দফতরের উর্ধতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে চালানো গ্রেনেড হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ঘটনাস্থলের আশপাশে সিসি ক্যামেরার খোঁজ করা হয়। আশ্চর্য বিষয়, বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশের এলাকায় কোন সিসি ক্যামেরা মেলেনি। পরবর্তীতে নিশ্চিত হওয়া যায়, বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কোন সিসি ক্যামেরা লাগায়নি তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। যে ১৫৫টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল, তা লাগানো হয়েছিল রাজধানীর পুরানা পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায়। যেখানে বিএনপি-জামায়াতের মুভমেন্ট বেশি ছিল। ধারণা করা হয়, খুবই পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সিসি ক্যামেরা লাগায়নি তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। যা একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা খুবই পরিকল্পিত বলে ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া গাজীপুরে সমাবেশে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, সিলেটে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগ নেতা ও অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা, রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, সিলেটে বাংলাদেশস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীসহ অন্তত শ’খানেক হামলার ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারান অনেকেই। বহু শোক চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, এসব হামলার ঘটনার আশপাশে গুরুত্ব বিবেচনা করে যদি ক্যামেরা লাগানো হতো, তাহলে অনেক আগেই এসব ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব ছিল। হামলার পরে হামলাকারীদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এত বেগ পেতে হতো না। এসব চাঞ্চল্যকর ঘটনার আদ্যোপান্ত রহস্যের অনেক কিছুই আজও উদঘাটিত হয়নি। অনেকেই এখনও নানা কারণে ঘটনার আড়ালেই রয়ে গেছেন। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে এজন্যই এমন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত করতে পারে এজন্যই সরকারের এমন উদ্যোগ। এ সংক্রান্ত গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ডেভেলপমেন্ট অব ঢাকা সিটি ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম’। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনও প্রকল্পের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স, এ্যাপ্লাইড ফিজিক্স, বিটিসিএল (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। ঢাকা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন ৪৯ হাজার সিসি ও মুভি ক্যামেরার মধ্যে প্রথম দফায় ১৬ হাজার ক্যামেরা বসানোর চিন্তাভাবনা চলছে। পুলিশ সদর দফতরের ডেভেলপমেন্ট শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এসব ক্যামেরা যুক্ত থাকবে অপটিক্যাল ফাইবারের সঙ্গে। ক্যামেরাগুলো যানজট নিরসনে আগাম সংকেত, পুলিশের সুনির্দিষ্ট অবস্থান, সন্দেহভাজন বস্তু, ব্যক্তি শনাক্তকরণে আগাম সংকেত দেবে। পাশাপাশি জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ নম্বরে আসা ফোন নম্বরগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চাহিদা মোতাবেক সেই সেলে চলে যাবে। বিভিন্ন জেলা থেকেও মানুষ জরুরী জাতীয় সেবা নম্বরে ফোন করেন। এসব ফোন তাৎক্ষণিকভাবে জেলা পুলিশ, এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ও ফায়ার সার্ভিসের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে। অপরাধে ব্যবহৃত গাড়ি ও অপরাধী শনাক্তে সংকেত দেবে, যানবাহনের নম্বরপ্লেট শনাক্ত করা, ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীকে শনাক্ত করা, কোন্ সড়কে কত গাড়ি রয়েছে, সে সম্পর্কে আগাম বার্তা দেবে। পুলিশের প্রতিটি শাখার সঙ্গে যুক্ত থাকবে এই সিস্টেমটি। ফলে কে কি কাজ করছে, তা কন্ট্রোলরুম থেকে দেখা যাবে। এসব সিসি ও মুভি ক্যামেরায় যুক্ত থাকবে পুলিশ গ্লোবাল ইনফরমেশন সিস্টেম। যা কোন জায়গা বা বস্তু সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেবে। ফলে কোন ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে সেই জায়গায় চলে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে কোন্ পুলিশ সদস্যের জায়গাটি কোথায় বা কিভাবে যাবে সে সম্পর্কে আগাম ধারণা না থাকলেও তেমন কোন সমস্যা হবে না। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতরের উন্নয়ন শাখার অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রকল্প রয়েছে। আমাদের দেশে আজ হোক আর কাল হোক এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ হালের অপরাধ প্রযুক্তিনির্ভর। ফলে প্রযুক্তি দিয়েই প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ মোকাবেলা করতে হবে। তাছাড়া কোন বিকল্প নেই। সম্প্রতি জার্কাতা ঘুরে এসেছি। সেদেশেও এমন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, তাদের দেশের অপরাধ শতকরা ৮০ ভাগ কমে গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির বিষয়ে খুবই আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা দ্রুত প্রকল্পটি চালু করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
×