ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৩০ আগস্ট ২০১৮

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের বিষয়টি উঠে এসেছে বিস্তারিতভাবে। জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সেদেশে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ ও বিতাড়নে সেনাবাহিনীর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ও দায়-দায়িত্বের কথা তুলে ধরা হযেছে। গণহত্যায় সেনাপ্রধানসহ অন্তত ছয়জন জেনারেলকে বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অথবা সমমানের কোন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। এর পাশাপাশি সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ায় মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর তথা সরকারপ্রধান আউং সান সুচিকেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সেনাপ্রধানসহ ২০ ব্যক্তি ও প্রতিনিধিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ফেসবুকে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের মানচিত্র থেকে জাতিগত রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব মুছে দিতে সে দেশের সেনাবাহিনী যে ভয়াবহ নির্যাতন ও গণহত্যা চালিয়েছে, তার রোমহর্ষক বিবরণ উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা গ্রন্থে। লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট : বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এক অধিবেশনে উপস্থাপন করা হয় গবেষণা গ্রন্থটি, নামÑ ‘ফোর্সড মাইগ্রেশন অব রোহিঙ্গা : দ্য আনটোল্ড এক্সপেরিয়েন্স।’ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নরওয়ের গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টায় লিখিত বইটি প্রকাশিত হয়েছে কানাডা থেকে। বইটি রচিত হয়েছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনে ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত এবং বাংলাদেশে আশ্রিত সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। বইটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সেদেশে কমপক্ষে ৮২০ কোটি টাকা বা ১শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ নগদ অর্থ সেদেশে ফেলে রেখে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। বইটির সার কথায় বলা হয়েছে, শুধু রাখাইনেই ২৪ হাজার রোহিঙ্গা হত্যাসহ ধর্ষণ করা হয়েছে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা নারীকে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে জাতিগত এই নিধনকে ভয়াবহ হিসেবে আখ্যায়িত করে একে গণহত্যা বিবেচনায় মিয়ানমার সরকারের বিচারের দাবি উঠেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এরই প্রতিফলন ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান, আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদের মিয়ানমারে প্রবেশ ও কাজ করার সুযোগ সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা প্রদান নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে ইতোমধ্যে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়েছে জাতিসংঘে। বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধিক বিপন্ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলমান সামরিক অভিযান তথা হত্যা-খুন-ধর্ষণসহ পোড়ামাটি নীতি অবিলম্বে বন্ধসহ শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ দমন-পীড়নের অভিযোগ এবং তাতে সমর্থন দেয়ার সুনির্দিষ্ট কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান এবং রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত আউং সান সুচির বিরুদ্ধেও নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দায়েরের জন্য ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। তা যত দ্রুত বাস্তবায়িত এবং রোহিঙ্গারা সেদেশে পুনর্বাসিত হয় ততই মঙ্গল। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশ ৫টি প্রস্তাব পেশ করেছে। বাংলাদেশও চায় জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব প্রয়াত কোফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা নিঃশর্ত, পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত হোক। যত তাড়াতাড়ি রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক নাগরিকত্ব দিয়ে ফিরিয়ে নেয় মিয়ানমার সরকার ততই ভাল হবে দেশটির জন্য।
×