ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ইরান-মার্কিন যুদ্ধ কি হতে পারে...

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২৯ আগস্ট ২০১৮

ইরান-মার্কিন যুদ্ধ কি হতে পারে...

ইরান-মার্কিন উত্তেজনা ও টানাপোড়েন দিনকে দিন যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যের এই তল্লাটে আরেক যুদ্ধের দামামা বাজছে। দু’পক্ষের বাকযুদ্ধের এক পর্যায়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র যেন ‘সিংহের লেজ নিয়ে না খেলে’ জবাবে ট্রাম্প বলেছিলেন ফের যদি যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দেয়া হয় তা হলে এমন পরিণতি ইরানকে ভোগ করতে হবে যা ইতিহাসে খুব কম দেশকেই করতে হয়েছে। ট্রাম্পের দিক থেকে ইরানকে উদ্দেশ করে যুদ্ধংদেহী যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে সেগুলো নেহায়েত বাত কি বাত বলে ধরে নেয়ার উপায় নেই। তবে এই বাকযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত বাস্তব যুদ্ধের রূপলাভ করে কিনা এই মুহূর্তে সে ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে ‘হ্যাঁ বা ‘না’ বলার উপায় নেই। তবে এটা ঠিক যে একটা সংঘাতের আশঙ্কা থাকছে এবং সে কারণে তেল সরবরাহ বিঘিœত হওয়ার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখন বাড়তির দিকে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন দুটি দেশ নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত- সৌদি আরব ও ইরান। এরা ইয়েমেনে প্রক্সিযুদ্ধ চালিয়ে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আরেক দিকে বসেছে ইসরাইল মনে করে যে ইরানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে দেশটি অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। সৌদি আরব আমেরিকার অতি ঘনিষ্ঠ মিত্র। আরব ইসরাইল হচ্ছে এ অঞ্চলে আমেরিকার ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশ। এ দুটি দেশের পীড়াপীড়িতেই যে শুধু ট্রাম্প ইরানের প্রতি এত যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠেছেন তা নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলে নতুন মার্কিন স্ট্র্যাটেজি ও স্বার্থ। সবকিছু মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এই তল্লাটটি আবার এক সংঘাতের জন্য উষ্ণ হয়ে উঠেছে। ক্ষমতায় আসার কিছু দিন পরই ট্রাম্প ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। ফলে এ চুক্তির আওতায় ইরান আমেরিকার কাছ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। ইরানের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়ে। এখন আগস্ট থেকে ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপিত হওয়ায় দেশটি আরও বেশি বেকায়দায় পড়ল। আমেরিকার যেসব কোম্পানি ইরানে বিনিয়োগ করেছিল তারা এখন ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। নইলে পেনাল্টির ফাঁদে পড়ে যাবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সত্যিকারের যন্ত্রণা শুরু হবে ৬ নবেম্বর থেকে সে সময় ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন ও তেলের ওপর আরও এক সেট কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে। ইরান এখন ইউরোপে দৈনিক ১০ লাখ ব্যারেল এবং চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে প্রায় ২০ লাখ ব্যারেল তেল রফতানি করছে। ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টার কারণে ইরানী তেলের আমদানিকারকরা গত দু’মাসে প্রায় ৮ শতাংশ ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে। আগামীতে এমন ঘটনা আরও বাড়বে। এ ব্যাপারে প্রভাব রাখার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে যথেষ্ট বেশি রাখে। ফ্রান্সের এনার্জি কোম্পানি ‘টোটাল’ ইরানের সাউথ পারস গ্যাস ক্ষেত্রে প্রায় পৌনে ৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিল। মার্কিন অবরোধের হুমকির কারণে তারা সেখানে লোক পাততাড়ি গোটানোর জন্য তৈরি হচ্ছে। ইরান ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তির শর্তাবলী পুরোপুরি মেনে চলছে এই মর্মে ফ্রান্সসহ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষরিত অন্যান্য দেশের দৃঢ় বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও এমন হচ্ছে। মার্কিন অবরোধের কারণে ইরানের অর্থনীতি যে চাপে পড়েছে ইতোমধ্যে তার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের সরে যাওয়ার আগে ইরানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এ বছর ৪.৩ শতাংশ হবে বলে আগে হিসাব করা হয়েছিল। এখন সেই হার হবে ১.৮ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে যে ট্রাম্পের এই ক্র্যাকডাউনে পাশ্চাত্যের আরও অনেক কোম্পানি যোগ দেবে। ব্যাপারটা বড়ই সহজ। তাদের সামনে দুটি পথ খোলা- হয় ইরানের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া নয়ত মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারা শেষের পথটাই বেছে নিতে বাধ্য হবে। ইরানও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যতটা পারা যায় চেষ্টা করছে। প্রেসিডেন্ট রুহানি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে অঙ্গীকার আদায়ে ইউরোপ চষে বেড়িয়েছেন। কিন্তু এখনও কোন অঙ্গীকার আদায় করতে পারেননি। মার্কিন চাপের মুখে এমন এক মনস্তাত্ত্বি¡ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে কিছু ইউরোপীয় কোম্পানি ইতোমধ্যে ইরান থেকে সরে গেছে। অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রাখতে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তারা রাস্তায় নেমে তাদের অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। তারা বিদেশের মাটিতে ইরান সরকারের সামরিক হস্তক্ষেপে ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে পড়েছে। জনমনে এই অসন্তোষ ইরানী নেতৃবৃন্দকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ওদিকে ট্রাম্প প্রশাসন রেডিও-টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ইরান নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে প্রচারণা বাড়িয়ে তুলে জনগণকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে। প্রশাসন মনে করছে ইরানী সমাজে সত্যিকারের ফাটল দেখা দিয়েছে। সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এসব কিছুর কারণে তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে টানাপোড়েন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। রুহানি পুরনো হুমকি নতুন করে উল্লেখ করে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে উস্কানি অব্যাহত রাখলে তেহরান গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে। এই প্রণালী দিয়েই পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ পেট্রোলিয়াম সামগ্রী সমুদ্র পথে অন্যান্য দেশে যায়। হরমুজ প্রণালী ইরান বন্ধ করলে আন্তর্জাতিক তেলবাহী জাহাজগুলোর চালাচল বন্ধ হয়ে যাবে এবং এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে যুদ্ধ বেঁধে যাবে। আর সেই যুদ্ধ শুরু হলে এ অঞ্চলের সকল পক্ষ তাতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়বে যে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সে যুদ্ধে কোন্ পক্ষ জয়ী হবে তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। কারণ এটা আর তখন ইরান-আমেরিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সেই যুদ্ধ এ অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি ঘটাবে। সূত্র : টাইম ও অন্যান্য
×