ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিন আক্তার চাঁদনী

তবু প্রশংসার দাবি রাখে মারিয়ারা

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২৯ আগস্ট ২০১৮

তবু প্রশংসার দাবি রাখে মারিয়ারা

ফাইনালের আগে জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপনে বাংলাদেশ দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন বলেছিলেন, ‘আমরা খেলেছি সেমির দ্বিতীয় ম্যাচটি। এর আগে সেমির প্রথম ম্যাচটিও মাঠে বসে দেখেছি। দেখলাম ভারতের খেলার ধরন। এর আগেও অবশ্য তাদের খেলা দেখেছি। ফাইনালে তারাই আমাদের প্রতিপক্ষ। শুধু বলব- আমাদের মেয়েরা যদি তাদের স্বাভাবিক খেলাটাই খেলে, তাহলে জয় পেতে কোন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।’ শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক খেলা খেলতে না পারারই খেসারত দিতে হলো ছোটনের দলকে। আগের তিন ম্যাচে যেভাবে দাপটের সঙ্গে খেলেছিল বাংলাদেশ, ফাইনালের প্রথমার্ধে সেই রূপে খুঁজেই পাওয়া যায়নি তাদের। মনে হচ্ছিল স্থায়ুচাপে ভুগছিল পুরো দল। মাঝমাঠ ছিল বিস্ময়করভাবে নিষ্প্রভ। মিডফিল্ডাররা বারবার বলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এর প্রভাব পড়ে আক্রমণভাগে। ফরোয়ার্ডরা বলতে গেলে বলই পাচ্ছিল না। অনেকটা নিচে নেমে তাদের বল পেতে হচ্ছিল! ভারত এই অর্ধে বাংলাদেশের প্রতিটি খেলোয়াড়কে মার্কিং করে, প্রতিটি পজিশনই ধরে খেলে, মাঠ বড় করে খেলে এবং টানা আক্রমণ করে। তারপরও যে বাংলাদেশ দল আক্রমণে উঠছিল না, তা নয়। কিন্তু তাদের প্রতিটি আক্রমণই ‘অঙ্কুরেই বিনাশ’ করে দিচ্ছিল ভারতীয় ডিফেন্ডাররা। পুরো খেলায় ৩টি গোলের সুযোগ নষ্ট করে বাংলাদেশ। ৪৩ মিনিটে আক্রমণে যায় বাংলাদেশ। ডান প্রান্ত ধরে বল নিয়ে শামসুন্নাহার সিনিয়র পাস দেয় তহুরার উদ্দেশ্যে। সেই বল ভারতের ফরোয়ার্ড লিন্ডা কম পেলেও বলটি সে ঠিকমতো ক্লিয়ার করতে পারেনি। বল চলে যায় বক্সের ভেতরে। সাজেদা খাতুন দূর থেকে দৌড়ে আসে। বক্সের ভেতরে একেবারেই অরক্ষিত ছিল সে। সামনে শুধু গোলরক্ষক। পোস্টে রাখতে পারলেই যেখানে গোল হয়ে যায়, সেখানে বিস্ময়করভাবে চলতি বলে সাজেদা যে শটটি নেয়, তা পোস্টের অনেক ওপর দিয়ে চলে যায়। নিশ্চিত গোলবঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। ৭৬ মিনিটে মাঝ মাঠের আরেকটু সামনে বল পায় মনিকা চাকমা। বা পায়ে দূরপাল্লার শট নেয়। ৪০ গজ দূর থেকে তার নেয়া জোরালো শটটি দুভার্গ্যজনকভাবে ভারতের ক্রসবারে লেগে মাঠের বাইরে চলে যায়। হতাশায় পোড়ে বাংলাদেশ। ৮২ মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে তহুরার বা পায়ের শট ভারতের সাইডপোস্টে লাগলে আবারও গোলবঞ্চিত হয় লাল-সবুজরা। ইনজুরি সময়ে ৯৪ মিনিটে গোলের সবচেয়ে সহজ সুযোগ নষ্ট করে বাংলাদেশ। মাঝমাঠ থেকে শামসুন্নাহার সিনিয়র বল পেয়ে উঁচু করে বল ফেলে ডান প্রান্তে বক্সের ভেতরে ঢুকে পড়া বদলি ফরোয়ার্ড রোজিনা আক্তারের উদ্দেশ্যে। রোজিনা ডান পায়ে উঁচু ক্রস পেলে বক্সের মাঝে আরেক সতীর্থ তহুরাকে। পোস্ট ফাঁকা, বলে মাথা ছোঁয়ালেই গোল হয়ে যায়, কিন্তু বিস্ময়করভাবে বলে মাথা লাগাতেই পারল না তহুরা! এর মিনিটখানেক পরেই রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজালে শিরোপা জেতার উল্লাসে ফেটে পড়ে ভারত এবং শিরোপা খোয়ানোর বেদনায় ভেঙ্গে পড়ে বাংলাদেশ। রানার্সআপ হলেও এই আসরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের খেলা মুগ্ধ করেছে সবাইকে, যা মনে থাকবে অনেকদিন। ৬৬ মিনিটে গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। কর্নার পায় ভারত। লিন্ডা কম বক্সের ভেতরে উঁচু করে বল ফেলে। সেই চলতি বলে ডান পায়ের ভলি করে মাহমুদা আক্তারকে পরাস্ত বল জালে জড়িয়ে দেয় ফরোয়ার্ড সুনীতা মুন্দা (১-০)। মাহমুদা গোল হজম করলো ৬৯৬ মিনিট পর। আগের আসরের চার ম্যাচের ৩৬০ মিনিট এবং ফাইনালের আগ পর্যন্ত ৩৩৬ মিনিট গোলবার অক্ষত রেখেছিল সে। সিনিয়র পর্যায়ে না পারলেও বয়সভিত্তিক ফুটবলে গত তিন বছর ধরে শক্তিশালী ভারতকে নিয়মিতভাবেই (চারবার) হারের স্বাদ উপহার দিয়ে আসছে বেঙ্গল টাইগ্রেস দল। ২০১৫ এএফসি অ-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে দুবার হারিয়েছিল বাংলাদেশ (গ্রুপ পর্বে ৩-১ এবং ফাইনালে ৪-০ গোলে)। ২০১৭ সালে সাফ অ-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপেও তাই (৩-০ এবং ১-০)। এবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারলে জয়ের সংখ্যা দাঁড়াত ৫-এ। এই আসরে গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ১৪-০, নেপালকে ৩-০ এবং সেমিতে ভুটানকে ৫-০ গোলে হারায়। পক্ষান্তরে ভারত গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কাকে ১২-০, ১-০ গোলে ভুটানকে এবং সেমিতে নেপালকে ২-১ গোলে হারায়। ‘ভুটান’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’। অন্য মতে, ভুটান শব্দটি এসেছে ভোটস-আন্ত, অর্থাৎ ‘তিব্বতের শেষ সীমানা’ হতে, যেহেতু দেশটি তিব্বতের ঠিক দক্ষিণেই অবস্থিত। থিম্পু ভুটানের পশ্চিম অংশে অবস্থিত দেশটির রাজধানী শহর। শহরটি হিমালয় পর্বতমালার একটি উঁচু উপত্যকায় অবস্থিত। আর এটি নিয়েই ‘সাফ অ-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ’ আসরের শুরুতে কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তায় ছিল বাংলাদেশ অ-১৫ জাতীয় নারী ফুটবল দল। কেননা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩৩৪ মিটার উচ্চতায় স্বাভাবিক ও ভাল ফুটবল খেলাটা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশি ওপরে খেলতে গেলে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকে। শ^াস-প্রশ^াস নিতে সমস্যা হয়। ফলে দ্রুত দমের ঘাটতি দেখা দেয় এবং স্বাভাবিক খেলার ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে হাড়ে হাড়ে ফুটবল শিখিয়ে শঙ্কাটা অমূলক প্রমাণ করে ছোটনের শিষ্যারা। এরপর বাকি ম্যাচগুলোতেও গোলের বন্যা বইয়ে দিয়ে সেটা অব্যাহত রাখে তারা। কিন্তু কথায় আছে, ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তার।’ শেষটা ভাল হয়নি বাংলার বাঘিনীদের। শিরোপা ছাড়া আর সবকিছুই পেল তারা! সবচেয়ে বেশি গোল (২২) করে এবং সবচেয়ে কম গোল (১) খেয়েও সাফল্যের হাসি হাসতে পারল না বাংলার বাঘিনীরা। শিরোপা জিততে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, সেই ভাগ্যটাই যে সঙ্গে ছিল না! ফলে বাংলাদেশ অ-১৫ জাতীয় নারী ফুটবল দল সাফল্যের মুকুটে যোগ করতে পারল না আরেকটি পালক। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন পারলেন না তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সাফল্যটি কুড়িয়ে নিতে। অধিনায়ক মারিয়া মান্দা পারল না তৃতীয়বারের মতো সুদৃশ্য ট্রফিতে চুমু খেতে। সাফ অ-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা অক্ষুণœ রাখতে পারল না বাংলাদেশ। গত ১৮ আগস্ট হাইভোল্টেজ ফাইনালে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের কাছে ১-০ গোলে হেরে তারা হয় রানার্সআপ। ভুটানের থিম্পুর চাংলিথিমাং স্টেডিয়ামে গড়া হলো না বিজয়গাথা। বরং আগের আসরের হারের বদলা নিয়ে নিল ভারত। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম আসরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ, ফাইনালে ১-০ গোলে ভারতকে হারিয়ে। প্রথম আসরে অংশ নেয়া সেই দলের ১৮ ফুটবলার ভুটানের আসরেও ছিল। বাকি ৫ ফুটবলার এসেছে বাংলাদেশ গেমস এবং অ-১৪ জেএফএ কাপে ভাল পারফরম্যান্স করে। এরা হলো : ইলা মনি, শাহেদা আক্তার রিপা, রেহেনা আক্তার, রোজিনা আক্তার এবং নওশন জাহান। অ-১৫ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় আসরে ছয়টি দল অংশ নেয়। বাংলাদেশ ছিল ‘বি’ গ্রুপে। যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান ও নেপাল। অন্যদিকে ‘এ’ গ্রুপে ছিল ভারত, শ্রীলঙ্কা ও স্বাগতিক ভুটান। বাংলার বাঘিনীরা ॥ মাহমুদা আক্তার, রুপনা চাকমা, রূপা আক্তার, আঁখি খাতুন, আনাই মগিনি, নাজমা, নিলুফা ইয়াসমিন নীলা, ইলামনি, শাহেদা আক্তার রিপা, আনুচিং মগিনি, রেহানা আক্তার, মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, লাবণী আক্তার, তহুরা খাতুন, মুন্নী আক্তার, শামসুন্নাহার, সোহাগী কিসকু, ঋতুপর্ণা চাকমা, সাজেদা খাতুন, শামসুন্নাহার জুনিয়র, রোজিনা আক্তার, নওসুন জাহান।
×