ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নের ধারা হাটের জটলায়, সেদিন ও আজ...

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৯ আগস্ট ২০১৮

উন্নয়নের ধারা হাটের জটলায়, সেদিন ও আজ...

সমুদ্র হক ॥ গ্রামের সে-ই হাটখোলার রূপ আর নেই। তবে পরিবর্তিত রূপে হাটখোলার অবয়ব পাল্টেছে। এবারের কোরবানির ঈদের পর গ্রামীণ জীবনের হাটখোলা পরিণত হয়েছে অন্যরকম মিলন ক্ষেত্রে। আড্ডা যে কথা দিয়েই শুরু হোক অঙ্কের এ্যালজেবরার মতো কমন একটি কথা নিয়ে ব্রাকেট দেয়ার পর তার ভেতরে সেই কথার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটতে থাকে। লোকজন এসে জড়ো হয়। কোথাও মিষ্টি রাখলে যেমন অনেক পিঁপড়ে চলে আসে, হাটখোলায় এই সময়ের নানা স্বাদের কথায় এক দুই চার আট ষোল.... এমন জ্যামিতিক হারে লোকজন বাড়তে থাকে। কেউ যোগ দেয় আলোচনায়। কেউ দাঁড়িয়ে ও বেঞ্চে বসে নিমগ্ন শ্রোতা হয়ে থাকে। তারা যা শোনে তা প্রচার করে প্রথমে নিজের বাড়িতে। এরপর আশপাশের বাড়িতে। তারপর পাড়াজুড়ে। এই সময়ের হাটখোলার হট কেক : ইলেকশন। বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বাঙালী তীরের এক গ্রাম রানীরপাড়া। গ্রামটি ছিল পাঠ্যপুস্তকে দেখা ছবির প্রতিচ্ছবি। মেঠা পথ। নদী পারপারের খেয়াঘাট। বটতলায় বাঁশের মাচাং। হালের বলদে লাঙলে জমি চাষ। খড় ছনে বেড়ায় ঘেরা কুড়েঘর। আঙিনার কোনায় মাটি খুঁড়ে চুলা। রাতে কুপি (বগুড়ার ভাষায় নেম্পো) ও চিমনি সলতেয় হারিকেন। হাটবারের দিনে কাঁধে ধামা। হাতে দড়িতে ঝুলানো তেলের শিশি। কাঁচা পথ ধরে দল বেঁধে গল্প গুজব করে গ্রামের হাটে যাওয়া। রাতের অন্ধকারে কখনও জ্যোৎ¯œায় ঘরে ফেরা। পথের ধারে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। জোনাকির মিটি মিটি আলো। এমন দৃশ্য আজ আর খুঁজেও পাওয়া যায় না। এখন পাকা সড়ক। চলে মোটরগাড়ি ও যন্ত্রচালিত যানবাহন। পথে বিদ্যুত পোলে বাতি। নদীতে খেয়া পারাপার নেই। নির্মিত হয়েছে ব্রিজ। বটতলার বাঁশের মাচাং উঠে গিয়ে শহরের মতো আধুনিক দোকান। পাকা রাস্তার মোড়গুলোতে বাস স্ট্যান্ড। সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, ব্যাটারি চালিত টোটো গাড়ি দাঁড়ানো। মিনি মার্কেটও গড়ে উঠেছে। গ্রামের বাড়িগুলো আর কুড়ে ঘর নেই। কোনটি টিনে ছাওয়া আধাপাকা বাড়ি। কোনটি পাকাবাড়ি। বিদ্যুতের সংযোগ। বাতি জ¦লে ফ্যান ঘোরে। আঙিনায় মাটির চুলার বদলে এলপিজি চুলা। ঘরে ফ্রিজ, কালার টিভি। কেবল সংযোগ। গ্রামের তরুণ তরুণীদের হাতে স্মার্ট ফোন। কারও ট্যাব ও ল্যাপটপ আছে। গ্রামের প্রতিটি কৃষক ও কিষান বধূর হাতে মোবাইল ফোন। কুয়ার ও ইঁদারার পাড় নেই। টিউবওয়েল। স্যানিটেশন ও বাথরুম। জমিতে ভটভট শব্দে পাওয়ার টিলারে চাষ। ধান মাড়াইকাটাই হয় বড় ঢোলের মতো কাঠের চার ধারে লেগে থাকা পেরেকের ঘূর্ণনযন্ত্রে। এই যন্ত্র মোটরেও চলে, পায়ের ঝাঁকুনিতেও চলে। গোয়াল ঘর উঠে গিয়ে তৈরি হয়েছে গরু পালনের মিনি ডেইরি ফার্ম। গৃহস্থ ও কিষাণ ঘরের ধারে কাঠের চৌকোনা বড় বাক্সে আর হাস মুরগী পালন হয় না। মিনি পোল্ট্রি গড়ে উঠেছে। গ্রামের লোক কাছের হাট বাজারে যায়। নিকট অতীতে সন্ধ্যায় বড় কুপি বাতি জ্বালানো হতো প্রতিটি দোকানে। মোটা সলতের কুপি বাতির আলো দূর থেকে দেখে বোঝা যেত কোন এক হাট। সেদিনের সেই হাটও আধুনিকায়ন হয়েছে। এখন আর কুপি বাতি নেই। বিদ্যুতের আলোয় হাটও আলোকিত। খড়ের চালার ঝুপরি ঘরের বদলে পাকা অবকাঠামোর ওপরে টিন সেডের নিচে হাটের দোকান বসে। কেউ যদি এখন কবিতার ছন্দে বলে ‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়ে..... সেই গ্রাম আর দেখা যাবে না। গ্রামেও আজ শহুরে উন্নয়নের ছোঁয়া। উন্নয়নের এই ধারায় হাটখোলার আজকের জটলা আরেক রকম- কে কিভাবে জীবন মানের উন্নয়ন করবে সেই আলোচনা। এখানেই প্রবেশ করেছে রাজনীতি। ইলেকশন নিয়ে গ্রামের মানুষের কৌতূহল নগরীর মানুষের কৌতূহলের চেয়ে বেশি। এর বড় কারণ হলো : শহর ও নগরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সহজে দেখা যায় না। নগরীর ব্যস্ততায় ভরা মানুষের কৌতূহল তেমন নেই। গ্রামে ছোট এলাকায় নতুন মানুষের আগমনে লোকজন ধরেই নেয় মৌসুম এসেছে ইলেকশনের। তখনই হিসাব কষে, আর কতদিন বাকি আছে। রানীরপাড়া গ্রামের বাসেত আলী বললেন ‘ক্য বা ভোট তো পৌষ মাসতই হবি তাই ন্য (তা বাবা ইলেকশন তো পৌষ মাসেই হবে তাই না)’। পৌষ মাস মানে ডিসেম্বরের শেষ দিকে। কোথায় শুনেছেন এই কথা, এমন প্রশ্নে বলেন ঈদের পর হাটখোলায় গিয়েছিলেন। জটলায় লোকজন কী না বলাবলি করছে। কোন সম্ভাব্য প্রার্থী কয়টি গরু কোরবানি দিয়ে কোথায় মাংস বিতরণ করেছেন। কোন প্রার্থী কতজনকে দাওয়াত করে খাইয়েছেন। কোন প্রার্থী কয়জনের বাড়িতে গিয়ে কুশলাদি বিনিময় করেছেন। এমন হাড়ির খবর হাটখোলার আড্ডায় হটকেক। সোনাতলার তরুণ ব্যবসায়ী কাজল বললেন, হাটের হোটেলগুলোতে চা বিক্রি বেড়ে গেছে। শহরের মতো ভাসমান চায়ের দোকানিও বসেছে। তারা বেঞ্চ পাতিয়ে লোকজনের বসবার ব্যবস্থা করেছে। আগে রাত ৮টার মধ্যে গ্রামের হাট বন্ধ হতো। এখন দশটা অবধি খোলা থাকছে। কৃষক জহুরুল ইসলাম বললেন, গ্রামের লোক এখন আগের মতো নেই যে হৈ হৈ করবে। তারা এখন শুনবে। চারদিকে দেখবে। চুপ করে থাকবে। যারা কথা বলছে তারও খুব সাবধানী। কারও পক্ষে বিপক্ষে সহজে বলবে না। তবে এলাকায় যে উন্নয়ন হয়েছে তা বলবে। লোকজন দেখছে আগে কেমন ছিল আর এখন কেমন। উন্নয়ন যে হয়েছে তা খালি চোখেই দেখা যায়। এত কিছুর পরও সেদিনের হাটখোলার সঙ্গে আজকের মিল হলো- আড্ডার মিলন ক্ষেত্রটি। তবে আন্তরিকতার দূরত্ব অনেকটাই বেড়েছে। একটা সময় হাটখোলা যতটা ছিল বাণিজ্যিক তার চেয়ে বেশি ছিল দশ গাঁয়ের সমাজ জীবনের ভাবনা ও ভাব আদান প্রদনের তীর্থভূমি। হাটবারে (সপ্তাহে দুইদিন বা একদিন) গ্রামের ছেলে বুড়ো সকলে হাটে না গেলে পেটের ভাত হজম হতো না। মনের ভেতরে কত কথা জড়ো হয়ে থাকতো। হাটে গিয়ে একের অপরের সঙ্গে শেয়ার না করলে ষোল কলা পূর্ণই হতো না। একবিংশ শতকে ‘শেয়ার’ শব্দটি ডিজিটালাইজড হয়ে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনের অনেক বড় একটি অধ্যায়ে রূপ নিয়েছে। প্রযুক্তির সঙ্গে একিভূত হয়েছে নিকট অতীতে তা ছিল না। তবে ছিল হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের কথার এক প্রান্তর। এই প্রান্তরটি ‘হাটখোলা’। শত সহ¯্র কথার ফুলঝুরির সঙ্গে সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনের সব কিছুই আলোচনায় স্থান পেত। গ্রামের মোড়ল মাতবর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হলে তো কথাই নেই। চামচা মোসাহেব কাহাকে বলে কত প্রকার তা একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়। কত রকমের মানুষের যে দেখা মেলে হাটে.......। ভিলেজ পলিটিকসের সঙ্গে ট্রিকস সবই আছে। আলাপের সূত্রে কত যে অলংকার দেয়া হয় কথার মধ্যে। সেই দিনের মতো হাটে হাড়ি ভাঙার চল আজও রয়েই গেছে। হাটখোলায় এমন সরস আলাপের কারণে হাটের দিনে গ্রামের গৃহস্থ ও কৃষকদেরও হাটে যাওয়া নেশায় পরিণত হয়েছে। ইলেকশনের সময় প্রচারের বড় একটি ক্ষেত্র এই হাটখোলা। শীতের সময়ের ইলেকশনে হাঁড় কাঁপানো শীতের চেয়ে হাটখোলার ইলেকশনের উষ্ণতা শীতকে তাড়িয়ে দেয়। যখন যে প্রার্থী আসে একই সুরে মেতে ওঠে হাটুরেরা। হাট শেষে বাড়িতে গিয়ে ভোট নিয়েও হয় সরস আলোচনা। হাপখোলায় যিনি এত খাতির যতœ করলেন তার প্রতিক্রিয়া কিষান ও গৃহস্থ বাড়ির উঠান হয়ে পরের হাটে নানা কথায় উপস্থাপিত হয়। পোশাক-আশাক ও আড্ডার আলাপচারিতা নিয়ে হাটখোলার আবেদন চিরন্তন।
×