ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মতিলাল দেব রায়

চীনের দুঃখ হুয়াং হু- কমলগঞ্জের দুঃখ ধলাই

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৯ আগস্ট ২০১৮

চীনের দুঃখ হুয়াং হু- কমলগঞ্জের দুঃখ ধলাই

শৈশবকালে ইতিহাস বা ভূগোলে পড়েছিলাম হুয়াং হু নদী চীনের দুঃখ। পরীক্ষায় প্রশ্ন আসত হুয়াং হু নদীকে চীনের দুঃখ বলা হয় কেন? তখন ঠিকই পরীক্ষায় পাসের জন্য এর উত্তর মুখস্থ করেছিলাম, তখন তার অন্তর্নিহিত অর্থ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। কমলগঞ্জ উপজেলার এক গ্রামে জন্ম নেয়া একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আজ তার তাৎপর্য বুঝতে পারি কেন হুয়াং হু নদীকে চীনের দুঃখ বলা হতো। হুয়াং হু নদীর মতো চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কমলগঞ্জের বুক চিরে বয়ে চলেছে যে নদী, প্রতি বছর বর্ষাকালে তার রুদ্র রূপ দেখলে মনে হবে যেন এক ভয়ঙ্কর জনপদ ধ্বংসকারী পানির ঢেউ প্রতি বছর আসে আর ছিনিয়ে নিয়ে যায় প্রান্তিক কৃষককুলের সারা বছরের বুকের ঘাম পায়ে ফেলে বপনকৃত ফসল, সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যায় তার পুরো কয়েক বছরের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে যায় বাসস্থান, ধুয়ে নিয়ে যায় পলিমাটি, নিয়ে যায় চাষকৃত পুকুরের মাছ, ভেসে নিয়ে যায় অসংখ্য প্রাইমারী স্কুলের ঘর, একমাত্র পানির উৎস হ্যান্ড নলকূপ, পুকুরের পানিকে পরিপূর্ণ করে দিয়ে যায় আবর্জনায় ধ্বংস করে যায় গবাদী পশুর খাবার, গোয়াল ঘর, এক কথায় এ এলাকার মানুষের জীবনকে নিমজ্জিত করে যায় এক অজানা হতাশায়। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে এ বছর কি পারবে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে, পারবে কি তার ছেলের কলেজের বেতন চালিয়ে যেতে, পারবে কি শোধ করতে ব্যাংক ঋণ, এনজিও, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ, না গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তাবৃন্দের নির্যাতন সহ্য করতে হবে। নানারকম সামাজিক সমস্যর কথা চিন্তা করে তিলে তিলে নিজেকে একেবারে নিঃশেষ করে দিতে চায়। আবার নতুন করে আশা নিয়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকার আশায় আবার জীবনযুদ্ধ শুরু করে। এভাবে প্রায় প্রতি বছর ধলাই নদীর পাড় বিভিন্ন এলাকায় ভেঙ্গে গিয়ে যে গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে সরাসরি পানির ঢেউ খেলে যায়, সেই গ্রামগুলো হলো : কাটাবিল, বাঘবাড়ী, ঘোড়ামারা, কান্দিগাঁও, মকাবিল, গুলেরহাওড়, রানীর বাজার, শিমুলতলা, তেতইগাঁও, কোনাগাঁও, হেরেঙ্গা বাজার, শ্রীপুর, গঙ্গা নগর, কেওয়ালী ঘাট, শিববাড়ি, ভানুবিলসহ অসংখ্য গ্রাম। যাদের কর্মযজ্ঞে, যাদের নানারকম সামাজিক অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যে উপজেলা পুরা বছর মুখরিত থাকে সেই গোত্র/মুণিপুরী সম্প্রদায়ের বাসস্থান হচ্ছে এই সকল গ্রামে। তাই কমলগঞ্জের মুণিপুরী সম্প্রদায়ের সাজানো গ্রামগুলো রক্ষা করার জন্য কমলগঞ্জে প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ ও পর্যটন আকৃষ্ট এই জনপদ যাতে তাদের বৈশিষ্ট্য কর্মচঞ্চল থাকে, সেই ব্যবস্থা জাতীয় স্বার্থে করে দিতে হবে। কমলগঞ্জ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে তাদের অবদান সবচেয়ে বেশি। এই মুণিপুরী সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আদিবাসী জীবনব্যবস্থা দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য দেশী-বিদেশী পর্যটক কমলগঞ্জে আসেন। মুণিপুরী সম্প্রদায়ের বাসস্থান হিসেবে কমলগঞ্জ পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিবছর বন্যার পর নদী ভাঙ্গার পর স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ এসে দেখে যান, পত্রিকার পাতায় তাদের বিভিন্ন রকম বক্তৃতা-বিবৃতি দেখা যায়। কিছু ত্রাণ সরকারী দান হিসেবে সাময়িক পাওয়া যায় এবং কিছুদিন সরকারী টাকায় বালির বাঁধ দিয়ে মেরামত করা হয় এবং এলাকার মানুষ তাদের নিয়মে চাষাবাদে লেগে যান, যাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গেছে, তারা তা মেরামত করেন আবার সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়াতে চান এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা জীবনের এই ছন্দপতন নিয়তি বলে মেনে নেন। যুগের পর যুগ, কালের পর কাল কিন্তু তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। একটা জনগোষ্ঠীকে সাময়িকভাবে ঠকানো যায়, চিরদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। একদিন না একদিন তারা জেগে উঠবেই। প্রতিবছর পানি উন্নয়ন বোর্ড/সরকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মাটির বাঁধ না দিয়ে একটি পাকা বা চিরস্থায়ী বাঁধ দেয়ার ব্যবস্থা করলে আজকে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না। সাধারণ মানুষজনের এত দুঃখ দুর্দশা করতে হতো না। হয়তো কৃষকগণের মেরুদ- আরও সোজা হতো। ধলাই নদীর যে সকল স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে গেছে, সেই সকল এলাকার পুরনো বাঁধ আবার ভেঙ্গেছে, নতুন ভাঙ্গা স্থান, পুরনো ভাঙ্গা স্থান ইত্যাদি এলাকা চিহ্নিত করে কেন বার বার এই এলাকাগুলো বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে এ ব্যাপারে গভীরভাবে খুঁজে বের করতে হবে। যদি বাঁধ নির্মাণে দেশের বাইরে কোন দেশের কারিগরি পরামর্শ দরকার হয়, তাও করতে হবে। স্থায়ীভাবে যে সকল স্থানে নদী সবসময় ভাঙ্গে এবং পানির স্রোত বেশি হয় সেই স্থানে নদীর কিনারায় পাকা বাঁধ দেয়া যেতে পারে। শুকনা মৌসুমে যখন পানি কম থাকে, তখন নদী ড্রেজিং করে মাটি/বালি অপসারণ করে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সম্ভব হলে নদীর স্রোতের গতি অন্যদিকে ফিরিয়ে দেয়া যায় কি-না, তা ভেবে দেখতে হবে। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম শহর সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক নিচে এবং সমুদ্র কাছাকাছি থাকায় সমুদ্র তীরে শহর রক্ষা উঁচু বাঁধ স্থায়ীভাবে আমস্টারডাম শহরকে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস থেকে বা যে কোন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে থেকে রক্ষা করে। একটা দেশের রাজধানী শহরকে যদি রক্ষা করা যায়, তা হলে বাঁধ দিয়ে স্থায়ীভাবে কমলগঞ্জের মানুষদের চিরদিনের দুঃখ ধলাই নদীর স্রোত কর্তৃক কিনারা ভাঙ্গা বন্ধ করা যাবে না কেন? [email protected]
×