ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নবীন ভাস্কর আনিসুজ্জামান

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ২৮ আগস্ট ২০১৮

নবীন ভাস্কর আনিসুজ্জামান

শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ‘২১তম নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীÑ২০১৮’ তরুণ প্রজন্মের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর এক বিশেষ আয়োজন। নির্ধারিত বয়সসীমা ২১ থেকে ৩৫ এর মধ্যে তরুণ শিল্পীরা তাদের কাজ জমা দেন। এই প্রথম প্রায় ৭৮৭ জন শিল্পী কাজ জমা দিয়েছেন। যার মধ্য থেকে ৩৮০ জন শিল্পীর ৪১২টি শিল্পকর্ম বাছাই কমিটির বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। শিল্পকর্মের সংখ্যা বিচারে এটি দেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ নবীন চারুকলা প্রদর্শনী। এত বিপুলসংখ্যক কাজের মধ্যে থেকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন আটজন। এর মধ্যে রয়েছে নবীন শিল্পী চারুকলা পুরস্কার এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং ছাপচিত্রে একটি করে পুরস্কার। এ ছাড়াও সৃজনশীলতার বিচারে প্রদান করা হয়েছে চারটি সম্মানসূচক পুরস্কার। ভাস্কর্যে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন এস.এম শাহ্ আনিসুজ্জামান ফারুকী। তরুণ এই ভাস্করের শিল্পভাবনা, স্বপ্ন, জীবনের গল্প জানাচ্ছেনÑ পপি দেবী থাপা ডিপ্রজন্ম : আপনার বেড়ে ওঠার গল্পটা... আনিসুজ্জামান : জন্ম ১৯৯৩ সালে, মহেশখালীতে। ৫ ভাই এক বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। বাবা মোঃ ওমর আলী ফারুকী ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক, এখন অবসরপ্রাপ্ত। মা এলমুন নাহার ফারুকী গৃহিণী ছিলেন। মা পরলোকগমন করেছেন ২০১১ সালে। ২০০৯ সালে কক্সবাজার টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ২০১১ সালে এইচএসসি পাস করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। আমি যখন আমার বাড়িতে জানাই যে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না। কারণ ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম দূরন্ত। ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতাম। পড়ালেখার প্রতি খুব বেশি মনোযোগীও ছিলাম না। আমি তাদের বুঝিয়ে ছিলাম আমি যে বিষয়ে পড়তে যাচ্ছি তা গতানুগতিক বিষয়ের বাইরে, যা আমার পছন্দের সঙ্গে যায়। তবুও তারা যেন আমার প্রতি আস্থা রাখতে পারছিলেন না। তাই আমি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে কাউকে কিছু না বলেই বেড়িয়ে পড়ি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে। পরীক্ষা দেই এবং চান্স পাই। এখন আমি মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। আমার সিদ্ধান্তের প্রতি এখন বাড়ির সকলের আস্থা বিশ্বাস দুটোই আছে। ডিপ্রজন্ম : ভাস্কর্য শিল্পী হয়ে ওঠার প্রেরণার উৎস... আনিসুজ্জামান : আমি একাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে বন্ধুর মাধ্যমে অরণ্য শর্মা নামে একজন আর্টিস্ট এর সঙ্গে পরিচিত হই। যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছেন। তিনি মূলত একজন চিত্রশিল্পী তবে স্কার্ভিংও করেন। তার কাছেই আমার ড্রয়িং শেখা। তার কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারি এসব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করা যায়। তার স্টুডিও ছিল, সেখানে পেইন্টিং ছিল, ভাস্কর্য ছিল। উনি মানুষ হিসেবেও একটু ব্যতিক্রম। আমার তাকে ভাল লাগত। তাকে দেখে অনুপ্রেরণা পেতাম। স্টুডিওতে আমি তার কাজে সাহায্য করতাম। একাডেমিক প্রসেস ড্রয়িং তার কাছ থেকেই শিখি। ৯-৫টা ধরাবাঁধা জীবন আমার কখনই পছন্দ ছিল না। বিষয়টি ভাবতেই আমার অবাক লাগে। আমি বরাবরই একটু স্বাধীনচেতা। অনেকটা এসব বিবেচনা করেই আমার এ পেশাকে বেছে নেয়া। এখানে স্বাধীনতা আছে। আছে নিজের ভাল লাগার সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করার সুযোগ। ডি-প্রজন্ম : বিষয় হিসেবে ভাস্কর্য শিল্পকে বেছে নেয়ার কারণ? আনিসুজ্জামান : অরন্য দাদা বলেছিলেন আমি যখন ছবি আঁকি তখন একটা পাশ দেখতে পাই। যখন ভাস্কর্য করা হয় তখন চারপাশ দেখা যায়। একজন শিল্পীর স্কিলিং, এপ্রোজ পেইন্টিংয়ের চেয়ে ভাস্কর্যে বেশি পড়ে। এবং পুরো বিষয়টা দৃষ্টি গোচর। যখন চারুকলায় কর্মশালা করি তখন পুরোপুরি ঠিক করলাম আমি ভাস্কর্য নিয়েই পড়ব। ওখানে চারুকলার সিনিয়র ভাইয়েরাই ক্লাস নেন। আমি লক্ষ্য করি যারা ভাস্কর্য শিল্প নিয়ে পড়ে বা শিল্পী তাদের লুক, এ্যাপ্রোস আলাদা। ডি-প্রজন্ম : কোন বিষয়ের ওপর কাজ করছেন? আনিসুজ্জামান : আমি একাডেমিক ভাস্কর্য চর্চার পাশাপাশি রৈখিক প্রক্রিয়ায় মিনি মালিস্টিক ভাস্কর্য নিয়ে কাজ করছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চারপাশে যা কিছু রয়েছে, আবার মনসৃষ্ট কোন কিছু আমি প্রথমে ড্রয়িং করি এ সময় আমার সামনে ম্যাটেরিয়ালগুলো থাকে। এরপর সেই উপাদানগুলো দিয়ে শেপ দেই। এবং এই শেপ দেওয়ার সময় আমার ভাল লাগার সঙ্গে মিলিয়ে ভাস্কর্যের গঠনটাকে ঠিক করি। ডিপ্রজন্ম : আপনি ভাস্কর্য শিল্পে কী ধরনের উপাদান ব্যবহার করতে পছন্দ করেন? আনিসুজ্জামান : আমি শক্ত উপাদান ব্যবহার করে ভাস্কর্য বানাই। ঝালাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ডিপ্রজন্ম : যে বিষয়টিতে আপনি ২১ তম নবীন চারুকলা প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার (ভাস্কর্য) পেয়েছেন, বিষয়টির নাম এবং বিষয়বস্তু যদি ব্যাখ্যা করেন... আনিসুজ্জামান : এ ভাস্কর্যের নাম উড়ন্ত লোহার পাখা। একদিন ভোর বেলায় আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরছিলাম। চোখে পড়ল চারটা ইটের ওপর একটা পাটাতন রাখা। এটা খুব ইমব্যালেন্স কিন্তু পড়ে যাচ্ছে না। তখন ওই আইডিয়া থেকে অনেক ড্রয়িং করি তার মধ্য থেকে একটা বেছে নিয়ে ভাস্কর্যটি বানাই। এর নাম উড়ন্ত পাখা দিয়েছি কারণ ওগুলো মুভ করে। পাখাগুলো আমি জিওমেট্রিক মাপে নিয়ে আসি। ওগুলো দেখতে অনেকটা পাখার মতই। আমি দর্শকদের ভাবনার ওপর কোন বাইন্ডিং তৈরি করি না। ভাবনার দায়িত্বটা তাদের ওপর ছেড়ে দেই আমি পাবলিক ইমপ্রেশন দেখি। আমি বিশ্বাস করি প্রসেস এবং এ্যাপ্রোজে। ডিপ্রজন্ম : এ মুহূর্তের ব্যস্ততা... আনিসুজ্জামান : এশীয় শিল্পকলা প্রর্দশনী- ২০১৮ তে ‘আলোর সাথে রসিকতা’ শিরোনামে স্থাপনা শিল্প নিয়ে অংশ নিতে যাচ্ছি; এ মুহূর্তে ভাবনার কেন্দ্রে সেটাই। ডিপ্রজন্ম : আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শিল্পকর্মের পাশে আমাদের দেশীয় শিল্পের অবস্থান... আনিসুজ্জামান : আমি আসলে মানদ-ের তুলনা করি না। অবস্থান, পরিবেশ ও মানচিত্র ভেদে যে পরিবর্তন সেটা তো একজন শিল্পীর সৃষ্ট শিল্পে ফুটে উঠবেই। একজন আমেরিকান শিল্পীর শিল্প আর আমাদের তৈরি শিল্পের মধ্যে পার্থক্য তো থাকবেই। তাদের চিন্তাধারা আর আমাদের চিন্তার সঙ্গে তো মিল হবে না। তবে সময়ের সঙ্গে আমরা যথেষ্ট এগিয়ে আছি। ডিপ্রজন্ম : বর্তমানে বাংলাদেশে ভাস্কর্য শিল্পকে আরও এগিয়ে নেয়ার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে আপনি মনে করেন... আনিসুজ্জামান : বর্তমানে আমাদের শিল্পের বিস্তার হচ্ছে। গণমাধ্যমেও প্রচার হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আরও বেশি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। সরকার থেকে আরও বেশি উদ্যোগ নেয়া দরকার। বেশি করে ভাস্কর্য প্রদর্শনীর পাশাপাশি উন্নতমানের কর্মশালা হওয়া উচিত। পেইন্টিংয়ের জন্য নিজের ঘর অথবা স্টুডিওতে করলে হয়, ছাপচিত্রের জন্য অনেক স্টুডিও আছে যেখানে আর্টিস্ট কিছু প্রসিডিউর মেনটেন করে কাজ করতে পারে। কিন্তু ভাস্কর্য করার জন্য তেমন কোন বড় স্টুডিও নেই। যারা ভাস্কর্য শিল্প নিয়ে কাজ করে তাদের জন্য এটা একটা বড় বাধা। তাই ভাস্কর্য শিল্পের জন্য আমাদের একটা ভালমানের বড় ধরনের স্টুডিও দরকার। সাধারণ মানুষকে ভাস্কর্য শিল্পসম্পর্কে আরও বোঝানো উচিত। এ কারণে শিশুকাল থেকেই ছেলে মেয়েদের শিল্পবোধ তৈরির প্রতি আরও বেশি সজাগ থাকতে হবে। পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিশুরা এ শিক্ষা লাভ করবে। ডিপ্রজন্ম : সুন্দর সমাজ গঠনে একজন শিল্পীর দায়িত্ব... আনিসুজ্জামান : সুন্দর সমাজ গঠনে একজন শিল্পীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। একজন শিল্পীর চিন্তাধারা হয় সৎ এবং সুন্দর। সে তার সুন্দর ভাবনাকে সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে। এবং তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। একজন শিল্পী সমস্ত কিছুর মাঝেও ভিন্নধর্মী নতুন কিছু খোঁজে। সে সর্বদাই নতুন সৃষ্টির আশায় তাড়িত হয়। যখন সৎ চিন্তা আর সুন্দরের সৃষ্টি হবে তখন সমাজ এমনিতেই সুন্দর হবে। ডিপ্রজন্ম : বর্তমানে একটা শব্দ প্রায়ই শোনা যায় যে, ‘তরুণ সমাজ বিপথে যাচ্ছে’- এ বিষয়ে আপনি কী বলেন ? আনিসুজ্জামান : তরুণ্য কখনও বিপথগামী হয় না। আমি যদি কারও জন্য বিপদের কারণ না হই, কারও ক্ষতির কারণ না হয়, তাহলে ‘বিপথগামী’ শব্দটা কেন মেনে নিব। আমাদের যেতে হবে এর গোড়ার দিকটাতে। যারা তরুণ সমাজকে বিপথে চালিত করে, আত্মঘাতী করে তোলে সংশোধনের বিষয়টা তাদের থেকেই শুরু করা উচিত। ডিপ্রজন্ম : বুকের ভিতর যে বাংলাদেশের ছবি বহন করেন... আনিসুজ্জামান : ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি উচ্চারিত হলে বিশ্ববাসীর চোখে ভেসে উঠবে সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীতে সমৃদ্ধ এক দেশ। যেখানে থাকবে এমন এক ভাস্কর্য স্টুডিও যা নিয়ে গর্ব করবে বিশ্ববাসী। থাকবে বিশ্বসেরা সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও শিল্পের সংগ্রহশালা।
×