ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হামে আক্রান্ত ২৪ শিশু ঝুঁকিমুক্ত ॥ পরিদর্শনে মেডিক্যাল টিম

হাটহাজারীর ত্রিপুরাপল্লীতে আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ২৮ আগস্ট ২০১৮

হাটহাজারীর ত্রিপুরাপল্লীতে আতঙ্ক

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস/নিজস্ব সংবাদদাতা, ফটিকছড়ি ॥ হাটহাজারীতে অজ্ঞাত আকস্মিক রোগাক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে একই পরিবারের ৩ শিশুসহ ৪ শিশুর মৃত্যু এবং আরও ২৪ শিশু আক্রান্তের ঘটনায় ফরহাদাবাদের দুর্গম পাহাড়ের ত্রিপুরা পল্লীতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এই পল্লীতে প্রায় ৫৫টি পরিবারের ৪শ’ লোকের বসবাস। সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও অধিবাসীরা পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবাবঞ্চিত বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সোমবার দুপুরে ঢাকা থেকে উচ্চ পর্যায়ের তিনটি ও চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগে একটি হাটহাজারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া শিশুদের দেখতে যায়। তাদের পক্ষে এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে। সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী সোমবার সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল থেকে জনকণ্ঠকে জানান, নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষায় তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এটি অজ্ঞাত কোন রোগ নয়। প্রাথমিকভাবে শিশুরা হামে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে। নতুন করে কোন আক্রান্তের ঘটনা নেই। চিকিৎসাধীন শিশুরা ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে। ত্রিপুরা পল্লীতে হামের সংক্রমণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানত অসচেতনতার কারণেই এই রোগ হয়েছে। দুর্গম পাহাড়ে টিকা কেন্দ্র থাকলেও অভিভাবকদের শিক্ষার অভাব রয়েছে। এদের অনেকেই আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা না নিয়ে নানা ধরনের প্রাচীন চিকিৎসায় বিশ্বাসী। তবে বিগত কয়েক বছরে তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাটহাজারীর ত্রিপুরা পল্লীতে যাদের মৃত্যু হয়েছে তারা হলো ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের দক্ষিণ উদালিয়া সোনাইছড়ি ত্রিপুরাপাড়ার কৃষক শাম কুমারের দুই পুত্র অন্ন রায় (৫), সোমা রায় (৩) ও কন্যা অন্নবালা (৭) এবং কৃষক রমেশ চাকমার কন্যা সিমনী ত্রিপুরা (৩)। এছাড়া ওই এলাকা থেকে রবিবার দুপুরে ২২ ও সোমবার সকাল ২ জনসহ আক্রান্ত ২৪ শিশুকে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রমেশ চাকমার দুই পুত্র ম্যানশন চাকমা (৬) ও গোপাল চাকমা (২) এবং সোনালী চাকমার (৩) অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। রোগ নিরূপণে ঢাকা থেকে সোমবার দুপুরে হাটহাজারী উপজেলা কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া ২৪ শিশুকে দেখতে যান আইইডিসিআর, ইপিআই ও ডব্লিউএইচও’র তিনটি টিম। এ বিষয়ে সবাইকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন মোঃ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী। ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯ আগস্ট এলাকার কয়েক শিশু হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়। সর্দি, কাশির এক পর্যায়ে এদের ত্বকের মধ্যে লালচে বর্ণের ফোস্কা দেখা দেয়। মঙ্গলবার শিশু অন্ন রায় ও সিমনী রায়, শুক্রবারে সোমা রায় এবং সর্বশেষ রবিবার সকালে অন্নবালা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। শাম কুমার ত্রিপুরা জানান, কয়েক দিনের মধ্যে অজ্ঞাত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে তার দুই পুত্র ও এক কন্যার মৃত্যু হয়। ঠিক বিশ বছর আগেও এই পল্লীতে একইভাবে ৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। এদিকে, এলাকাবাসী ক্ষোভের সঙ্গে জানান, দু’শ’ বছর ধরে তারা ওই এলাকায় বসবাস করে আসছেন। তবে তাদের কোন স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও বিশুদ্ধ পানি নেই। ছড়া ও ঊশের পানি সংগ্রহ করে তারা পান করে থাকে। এছাড়া প্রত্যন্ত ও অনুন্নত এলাকায় বসবাসের কারণে এরা প্রায় সকল ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ ইমতিয়াজ হোসাইন জানান, শরীরে জ্বর নিয়ে ২৪ শিশু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছে। আশঙ্কাজনক ৩ শিশুকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। বাকি ২১ শিশু স্বাভাবিক ও সুস্থ রয়েছে। রোগের কারণ নির্ণয় করা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে ভাইরাসজনিত রোগ। রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার পর রোগ সম্পর্কে জানা যাবে। ত্রিপুরা পল্লী এলাকার বনকুমার ত্রিপুরা জানান যে, প্রথমে শিশুদের শরীরে জ¦র, তারপর শরীরে এক ধরনের বিরল ঘা বা বিচি পুরো শরীরে বিস্তার করে। এরপর খিঁচুনি শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে শিশুরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্থানীয় কয়েকজন এ প্রতিবেদককে জানান, উক্ত এলাকায় চিকুনগুনিয়া রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই।হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ যাবত যে ২৪ জনকে ভর্তি করা হয়েছে তাদের বয়স ৩ থেকে ৭ বছর। এরা হলো মেঞ্জন চাকমা, সোনালী চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা, শিশুল ত্রিপুরা, স্বপ্না ত্রিপরা, রিপন, রিপা, রোলা ত্রিপুরা, ইমারানী, বিজলী ত্রিপুরা, কিরনবালা, রণি, রুপা ত্রিপুরা, রোপন কুমার ত্রিপুরা, সুকন্দ ত্রিপুরা গোলধন,শিমা রাণী, বিজয় ত্রিপুরা, লক্ষণ, গীতা রাণী ও শুভরাণী। এর মধ্যে গোপাল চাকমা, মেঞ্জন চাকমা, সোনালী ত্রিপুরা এই তিনজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানান চিকিৎসক। এ ব্যাপারে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আবু সৈয়দ মোঃ ইমতিয়াজ হোসাইন জানান, ত্রিপুরা এলাকায় এখনও কী রোগ তা নির্ণয় করা যাচ্ছে না। গুরুতর অসুস্থ ৫ জনের রক্তের নমুনা নিয়ে ঢাকায় পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে। তবে অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। সোমবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি টিম সর্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে। অপরদিকে, ত্রিপুরা পল্লীতে সোমবার সকাল থেকে চিকিৎসা বিভাগের দুইটি ভ্রাম্যমান টিম এলাকায় অবস্থান করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, গত বছরের ১২ জুলাই পার্শ্ববর্তী সীতাকুন্ডের মধ্যম সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পল্লীতে একইভাবে আক্রান্ত হয়ে ৯ শিশুর প্রানহানি ঘটেছিল।
×