ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাচার হওয়ার শঙ্কা

জেলা পর্যায় থেকে চামড়া আসছে না ঢাকায়

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৮ আগস্ট ২০১৮

জেলা পর্যায় থেকে চামড়া আসছে না ঢাকায়

এম শাহজাহান ॥ দাম কমে যাওয়ায় জেলা পর্যায় থেকে ঢাকায় কোরবানির চামড়া আসছে না। পোস্তার আড়ত ও সাভারের ট্যানারিগুলো চামড়া সংগ্রহে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ঈদের ছুটির পর ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হওয়ায় আর্থিক লেনদেনের সঙ্কটও নেই। কিন্তু বড় ধরনের লোকসানের ভয়ে স্থানীয় মৌসুমী ও খুদে ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করার জন্য ঢাকা আনছে না। দ্রুত এসব চামড়া ঢাকায় এনে প্রক্রিয়াকরণ শুরু না করলে তা পাচার হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে চামড়া পচে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোরবানির দিন দুপুর থেকে ঢাকার পোস্তা ও সাভারের শিল্পনগরীতে চামড়া কেনাবেচা শুরু হয়েছে। সাধারণত দাম নিয়ে তেমন কোন সমস্যা তৈরি না হলে ঈদের পরের দিন থেকে ঢাকার আড়তে চামড়া আসা শুরু হয়। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে থেকে চামড়া আসার খবর পাওয়া যায়নি। দু’চারটি চামড়াবাহী ট্রাক আসলেও ভাল দাম না পেয়ে বড় অস্বস্তি নিয়ে ব্যবসায়ীরা আবার ফিরে যাচ্ছে। কেউ বা লোকসান দিয়ে পুঁজি হারিয়ে ঘরে ফিরছেন। এই বাস্তবতায় জেলা পর্যায়ের চামড়াগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণসহ ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে কোরবানিতে চামড়া সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা পূরণও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনবেন। সরকার নির্ধারিত দামে কেনা হবে, তবে সেই চামড়া লবণযুক্ত ও মানসম্মত কি না তা যাচাই-বাছাইয়ের পর। তিনি বলেন, সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরিসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে এই ব্যবসা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এছাড়া এবার চামড়া কিনতে যে পরিমাণ ব্যাংক ঋণ চাওয়া হয়েছিল তা পায়নি উদ্যোক্তারা। ফলে পুঁজির সঙ্কট রয়েছে। সাভারের ট্যানারিগুলোর অবকাঠামোগত সমস্যা দূর হয়নি। এরপরও মালিকরা চামড়া কিনবেন। তিনি বলেন, শীঘ্রই ঢাকার বাইরে থেকে চামড়া আসা শুরু হবে। আগামী কয়েক মাস পর্যন্ত জেলা পর্যায়ের চামড়া সংগ্রহ করা হবে। এই সময় যাতে চামড়া পাচার না হয়, সেদিকে বিজিবি এ পুলিশের টহলদারি বাড়ানো প্রয়োজন। জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর না হওয়ায় কাঁচা চামড়ার বাজারের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে লবণের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে অনেক মৌসুমী ও খুদে ব্যবসায়ীরা লবণ না মাখিয়ে চামড়া রেখে দিয়েছেন। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি গরুর চামড়া সংরক্ষণে কমপক্ষে ২৫০-৩০০ টাকার লবণের প্রয়োজন হয়। কিন্তু লবণের দাম বাড়া ও চামড়ার মূল্য কমায় এখন সঠিকভাবে কেউ পচনশীল এই পণ্যটি সংরক্ষণ করছে না। চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছে, গত মে মাসে উৎপাদনের মৌসুম শেষে আয়োডিন ছাড়া প্রতিবস্তা (৭৫ কেজি) লবণ ৭০০-৭০৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঈদের আগে লবণের দাম বস্তায় ২০০-২৫০ টাকা বেড়ে যায়। আর ঈদে দিন থেকে দাম আরও বেড়ে গেছে। কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে লবণের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন রিটেইল ডিলার মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, সরকার লবণের দাম বাড়ায়নি। অথচ চাহিদা বেশি থাকায় লালবাগ ও পোস্তার একটা সিন্ডিকেট কোন কারণ ছাড়াই লবণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে লবণ নিয়ে নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এদিকে, বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট চাহিদার ৪৫-৫০ শতাংশ চামড়া কোরবানির সময় সংগৃহিত হয়ে থাকে। আর বাকি ৫০ ভাগ চামড়া সারা বছরে পাওয়া যায়। সাধারণত মৌসুমী ব্যবসায়ীরা কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেন। আড়ত হয়ে এগুলো কিনে নেন ট্যানারি মালিকরা। ইতোপূর্বে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করা হলেও এ বছর সবচেয়ে কম দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের চেয়ে কাঁচা চামড়ার দাম ভারতে আড়াই থেকে তিনগুণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ছয়গুণ বেশি দাম। দেশে এ বছর প্রতিবর্গফুট গরুর লবণযুক্ত চামড়া ঢাকায় ৪৫-৫০ টাকা বেঁধে দেয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরে প্রতিবর্গ ফুটে দাম আরও ৫ টাকা কম। এই দাম নিয়ে শুরু থেকে ক্ষুদ্র ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। চামড়ার উপকারভোগী মসজিদ, মাদ্রাসা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও চামড়ার সঠিক দাম নির্ধারণের জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ বিবেচনায় না নিয়ে ট্যানারি মালিকদের ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। গত কয়েক বছর ধরে একই কায়দায় কাঁচা চামড়ার দাম কমিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় কাঁচা চামড়া রফতানি করার অনুমতি প্রদানের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ কাঁচা চামড়া রফতানির বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। তবে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম দিতে হলে তাদের লোকসান গুনতে হবে। আর কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের বেশি মূল্যে কিনতে হয়েছে। এ অবস্থায় ট্যানারি মালিক ও এ শিল্পের বড় উদ্যোক্তারা চামড়া ক্রয়ে ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করেছেন। এতে করে চামড়ার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এদিকে, বেশি দামে চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেয়া দামে বেচতে হলে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হবে বলে জানান কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা। এ পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি মালিকদের দায়ী করে ব্যবসায়ীরা বলছে, ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নিয়েও প্রতিবছর কোরবানির সময় চামড়া কেনা নিয়ে টালবাহানা করেন ট্যানারি মালিকরা। আবার তারাই চামড়া পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে আহাজারি করে। চামড়ার কেনাবেচায় সরকারী তদারকির দাবি জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, তা না হলে চড়া সুদে ধার নিয়ে চামড়া কেনাবেচা করতে গিয়ে পথে বসবেন সারাদেশের প্রান্তিক ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। এতে বিপর্যস্ত হবে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ প্রক্রিয়া, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে।
×