ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন

নজরুলের প্রয়াণবার্ষিকী সম্প্রীতির আবাহনে পালিত

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৮ আগস্ট ২০১৮

নজরুলের প্রয়াণবার্ষিকী সম্প্রীতির আবাহনে পালিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া থেমে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান এভাবেই মানুষে মানুষে সমতার স্বপ্ন জাগিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সৃষ্টির আলোয় ধারণ করেছিলেন প্রেম ও মানবতাকে। সত্য ও সুন্দরের আরাধনা ছিল তাঁর সৃষ্টিশীলতার মন্ত্র। অন্যায় কিংবা শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে বিদ্রোহী কবির কলম। গান ও কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে স্বদেশমুক্তির আকাক্সক্ষা ও অসাম্প্রদায়িকতা। এভাবেই দ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার কবি হিসেবে ঠাঁই করে নেন বাংলা সাহিত্য ও শিল্পের অনুরাগীদের মননে। তাই তো সঙ্কট কিংবা দুঃসময়ে আজো তিনি বাঙালীর পথের দিশারী। সোমবার ছিল গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াকু কবি নজরুলের ৪২তম প্রয়াণবার্ষিকী। জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকীর আনুষ্ঠানিকতার গান, কবিতা অথবা বক্তৃতায় বারংবার উচ্চারিত হয়েছে সাম্যের চেতনা ও সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মাণের কথা। ধর্মের বিভেদ পেরিয়ে সম্প্রীতির আবাহনে পালিত হলো কবির প্রয়াণবর্ষিকী। অনুরাগীদের হৃদয় উৎসারিত ভালবাসার সঙ্গে কবির অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী চেতনার অনুরণন ছিল গোটা জাতির অন্তরে। ধর্মান্ধতার আস্ফালনের অস্থির সময়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ গড়ার শপথে পালিত হলো তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। কবির সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদনের পাশাপাশি নানা আয়োজনে গান-কবিতা ও কথায় শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয় কবিকে। জাতীয় পত্রিকাগুলোয় গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর সংবাদ। সরকারী-বেসরকারী টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত হয়েছে নজরুলকে নিবেদিত গান-কবিতায় সাজানো অনুষ্ঠানমালা। এ ছাড়া নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিকে স্মরণ করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ভালবাসায় সিক্ত কবির সমাধি ॥ পুব আকাশে সূর্যের রক্তিম আভার দেখা মিলতেই সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে শুরু হয় জাতীয় কবিকে স্মরণে দিবসের কর্মসূচী। কিছুক্ষণের মধ্যেই সর্বস্তরের মানুষসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নিবেদিত ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত হয়ে যায় সমাধিসৌধ। এছাড়া কবির রুহের মাগফেরাত কামনা করে ফাতেহা পাঠ করা হয়। সর্বসাধারণের সঙ্গে সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কবির নাতনি খিলখিল কাজী। এ সময় তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সবার কবি, মানুষের কবি। তার জীবন-দর্শন ছিল অসাম্প্রদায়িক, মানুষকে তিনি ভালবাসতেন। আমরা সকলেই মানুষ- এটাই ছিল তার আদর্শ। এই সময়ে বিশ্বে যেখানে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তখন নজরুল দর্শনের চর্চা খুবই জরুরী। আওয়ামী লীগের পক্ষে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তার সঙ্গে আরও ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি প্রমুখ। এ ছাড়া সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিএনপি, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাসদ (মার্কসবাদী), বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, মহিলা আওয়ামী লীগ, ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ, নজরুল ইনস্টিটিউট, ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, কপিরাইট অধিদফতর, ঢাবি অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ওবায়দুল কাদের বলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষকে আমরা উৎপাটিত করব দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। এটাই আজকে বিদ্রোহী কবি, জাতীয় কবির মহাপ্রয়াণ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার, আমাদের প্রত্যয়, আমাদের শপথ। আবদুল মঈন খান বলেন, আজকেও যেন সেই কলমের মধ্য দিয়ে, বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্যায় ও অনাচারের প্রতিবাদ করে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রকামী স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে এই দেশকে পুনরায় গড়ে তুলি। রফিকুল ইসলাম বলেন, কবির সমাধিকে যেন স্মৃতিসৌধ করে ফেলা না হয়। এটা সমাধিই থাকবে। কবির সমাধির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আরও বাড়ানো দরকার। তিনি সমাধি প্রাঙ্গণে আরও ফুলগাছ ও অন্যান্য গাছ রোপণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, কবির বিভিন্ন কবিতায় অনেক গাছের ও ফুলের নাম রয়েছে। সেই সব ফুলের গাছ লাগানোর জন্য তিনি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান। মুহাম্মদ সামাদ বলেন, নজরুল সারাবিশ্বের নির্যাতিত মানুষের কবি। মানবতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। বিশ্বে এখন এই কবি মানবতার ও সৃষ্টিশীলতার কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কবির সমাধিতে ফুল দেয়ার পর সমাধি প্রাঙ্গণে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী, সঙ্গীত বিভাগের চেয়ারপার্সন টুম্পা সমদ্দার প্রমুখ। আলোচনা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করেন খায়রুল আনাম শাকিল, ইয়াকুব আলী খান, শিল্পী লীনা তাপসী খান ও ঢাবির সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা। দুই গুণীজনের নজরুল পুরস্কারপ্রাপ্তি ॥ নজরুলসঙ্গীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ খায়রুল আনাম শাকিল এবং নজরুল গবেষণায় ‘নজরুল পুরস্কার ২০১৭’ পেয়েছেন অধ্যাপক ড. রশিদুন নবী। নজরুল প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে সোমবার জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে নজরুল ইন্সটিটিউট প্রবর্তিত এ পুরস্কার তুলে দেয়া হয় দুই গুণীজনের হাতে। উভয়কে স্মারক, সনদপত্র ও পুরস্কারের সম্মানী হিসেবে এক লাখ টাকার চেক প্রদান করেন অতিথিরা। এছাড়া অনুষ্ঠানে ১৭ খ-ের নজরুল সমগ্রের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কবি নাতনি খিলখিল কাজী। স্বাগত ভাষণ দেন নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ভূঞা। পদকপ্রাপ্তির অনুভূতি ব্যক্ত করে খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, সব পুরস্কারই আনন্দের। তবে পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আনন্দের পাশাপাশি ভীতিও কাজ করে। কেননা পুরস্কার পেলে তখন দায়িত্বটাও বেড়ে যায়। একইসঙ্গে এই পুরস্কারের যোগ্য কিনা সেটাও মনে হয়। এই পুরস্কারপ্রাপ্তির কারণে নজরুলের জীবন দর্শন ছড়িয়ে দিতে নিজের সর্বোচ্চ শ্রমকে কাজে লাগাব। রশিদুন নবী বলেন, নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহের কাজটি খুবই কঠিন। কারণ তাঁর গানের শ্রেণীকরণ নিয়ে জটিলতা আছে। দুই ধরনের শ্রেণীকরণের মাধ্যমে ইনস্টিটিউটের কাছে আমি সেটা উপস্থাপন করব। খিলখিল কাজী বলেন, না থেকেও সৃষ্টির ঐশ্বর্যে বাঙালীর আত্মায় বিরাজমান নজরুল। তিনি আমাদের আত্মপ্রকাশের প্রেরণা। সংকীর্ণতা, কুসংস্কার ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখান তিনি। শিখিয়েছেন অসাম্প্রদায়িক হতে। হয়ে আছেন জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত। মুহাম্মদ সামাদ বলেন, নজরুল একইসঙ্গে অনুকরণীয় কবি ও সংগ্রামী মানুষ। তাঁর গান, কবিতা ও মানবিক দর্শনকে পুঁজি করে গড়তে হবে সম্প্রীতির সমাজ। নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্দীপনা জুগিয়েছে নজরুলের গান ও কবিতা। পদক প্রদান ও আলোচনা শেষে ছিল সাংস্কৃতিক পর্ব। এ পর্বে নজরুলের গান শোনান ইয়াকুব আলী খান, লীনা তাপসী খান, ছন্দা চক্রবর্তী, নার্গিস পারভীন বনি, লুৎফরন্নাহার পাখি, গোলজার হোসেন ও সুদাম কুমার বিশ্বাস। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে নজরুল ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষার্থী ও আজনবী সঙ্গীত একাডেমির শিল্পীরা। একক কণ্ঠে আবৃত্তি করেন নায়লা তারান্নুম কাকলী। কবির পত্র পাঠ করেন ¯িœগ্ধা বাউল। নজরুল স্মরণে শিল্পকলার আয়োজন ॥ কবির প্রয়াণ দিবসে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ছিল আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একাডেমির জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে মুখ্য আলোচক ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী এতে সভাপতিত্ব করেন। আলোচনা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই শিশু একাডেমির শিশু শিল্পীরা গেয়ে শোনায় ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ ও ‘রুম ঝুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম ঝুম’ গান দু’টি। একক কণ্ঠে গান শোনান নুজহাত সাবিহা পুষ্পিতা, গার্গী ঘোষ, সুমাইয়া বিনতে আলম ও রাইয়ান বিনতে হাবিব।
×