ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মালয়েশিয়াগামী ৮০ হাজার শ্রমিকের ভাগ্য অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৮ আগস্ট ২০১৮

মালয়েশিয়াগামী ৮০ হাজার শ্রমিকের ভাগ্য অনিশ্চিত

ফিরোজ মান্না ॥ মালয়েশিয়া হঠাৎ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ ঘোষণার পর ৮০ হাজার কর্মীর ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অনলাইন পদ্ধতিতে ৪০ হাজার কর্মীর ভিসা দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। আরও ৪০ হাজারের বেশি কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক কর্মীর কাছ থেকে ১০ সদস্যের সিন্ডিকেট কয়েক শ’ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। তাদের বিষয়ে সিন্ডিকেট কোন দায়িত্ব নেবে না বলে জানিয়েছে। এ নিয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও কোন ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেনি। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে মালয়েশিয়া প্রচলিত নিয়মে বাংলাদেশ থেকে আর জনশক্তি নেবে না। কোন পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ করবে মালয়েশিয়া তাও স্পষ্ট করে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও সচিব ড. নমিতা হালদারের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর জন্য ১০টি জনশক্তি রফতানিকারককে এককভাবে ক্ষমতা দেয়া হয়। তারা অনলাইন ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে (এসপিপিএ) লোক পাঠিয়েছে। এই সিস্টেমের নাম দেয়া হয় জি টু জি প্লাস। ১০টি বাদে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে পৌনে দুই লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। আরও পাইপ লাইনে আছে ৮০ হাজারের বেশি কর্মী। গত জুনে মালয়েশিয়ার সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, মালয়েশিয়ায় লোক পাঠিয়ে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় একজন কর্মী পাঠাতে খরচ হয় দুই হাজার রিঙ্গিত। আর বাংলাদেশী একটি চক্র নিচ্ছে ২০ হাজার রিঙ্গিত। এভাবে দুই বছরে একটি চক্র হাতিয়ে নিয়েছে ৩ শ’ কোটি রিঙ্গিত। বাংলাদেশী মুদ্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ওই চক্রের হোতা হিসেবে বাংলাদেশের প্রভাবশালী এক ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। তিনি ১৫ বছর আগে এক মালয়েশীয় নারীকে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করেন। ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণেই চুক্তি সই হয়। তার ছত্রছায়ায়ই ১০টি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে হাজার হাজার কোটি টাকার হাতিয়ে নেয়। এটা এক ধরনের মানবপাচারের মতো ঘটনা। এই ব্যবসাকে বৈধতা দেয়ার পেছনে তার ভূমিকাই মূল। এসপিপিএ অনুসারে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগে মালয়েশীয় কোম্পানিকে ৩০৫ রিঙ্গিত দিতে হতো। নিবন্ধন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে বেস্টিনেট এসডিএন বিএইচডি নামের একটি বেসরকারী কোম্পানি। এসপিপিএ-র সংগৃহীত টাকা চলে যায় বেস্টিনেটের কাছে। ১০টি কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন নিয়োগ কর্তাদের কাছে কর্মীদের বণ্টন কাজের জন্য টাকা নিয়েছে বেস্টিনেট। প্রতিবেদনে বলা হয় ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও মায়ানমার থেকে মালয়েশিয়া যেতে ওই দেশগুলোর কর্মীদের বাংলাদেশের তুলনায় কম টাকা দিতে হয়। ওই দেশগুলোর কর্মীদের খরচ পড়ে মাত্র আড়াই হাজার রিঙ্গিত। সিন্ডিকেটের সদস্যরা হচ্ছে, প্র্রান্তিক ট্রাভেল, ইউনিক ইস্টার্ন, ক্যাথারসিজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যারিয়ার ওভারসিজ, আমিন এ্যান্ড ট্যুরস, এইএসএমটিস হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, প্যাজেস এ্যাসোসিয়েটস ও আল ইসলাম ওভারসিজ। বিএমইটির ডিজি সেলিম রেজা বলেন, মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে এসপিপিএ (অনলাইন সিস্টেম) পদ্ধতিতে জনশক্তি নিয়েছে। এখন তারা এই পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছে। তাদের দেয়া চিঠিতে বলেছে ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই পদ্ধতিতে দেশটি বাংলাদেশ থেকে আর জনশক্তি নেবে না। কিন্তু তারা কোথাও বলেনি যে তারা ভিসা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা এখনকার পদ্ধতির পরিবর্তে একটি ইউনিফর্ম সিস্টেম ডেভেলপ করবে। সেটা আগামী মাসেই দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ঠিক হবে। এদিকে রবিবার বিবিসি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারগুলোর একটি, মালয়েশিয়ার দরজা আর পাঁচ দিনের মধ্যেই আপাতত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ‘জিটুজি-প্লাস’ নামে যে এসপিপিএ সিস্টেমের আওতায় মালয়েশিয়া তাদের দেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিয়োগ করত, সেই পদ্ধতি আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকেই স্থগিত হয়ে যাবে বলে সে দেশের সরকার বাংলাদেশকে ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে। কুয়ালালামপুরের সাংবাদিক শেখ কবীর আহমেদ বিবিসিকে জানিয়েছেন, বর্তমান পদ্ধতিতে যে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মারফত বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ করা হত তা বাতিল ঘোষণা করা হলেও মালয়েশিয়ার সরকার নতুন কি পদ্ধতি চালু করতে চাইছে তা আদৌ স্পষ্ট নয়। মাহাথির মোহাম্মদের নতুন সরকার হয়তো নতুন কোন পদ্ধতি চালু করবেন। কিন্তু তাতে যে বেশ সময় লাগবে তাতে কোন সন্দেহ নেই, আর ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে এদেশে শ্রমিক আসা বন্ধ থাকবে ধরেই নেয়া যায়। বাংলাদেশ জনশক্তি রফতানিকারকদের সমিতি বায়রা বিবিসিকে জানিয়েছে, গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার অভিবাসী শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছেন। এই সংখ্যা সৌদি আরবে যাওয়া বাংলাদেশী শ্রমিকের সমান- কাজেই বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিতে মালয়েশিয়ার গুরুত্ব কতটা, তা বোঝা কঠিন নয়। বায়রার সচিবালয়ের উপদেষ্টা মোঃ দলিলউদ্দিন ম-ল অবশ্য বলছেন, হ্যাঁ, সাময়িকভাবে হয়তো বিরূপ প্রভাব। তবে মালয়েশিয়া এর আগেও বহুবার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ করেছে ও আবার চালু করেছে। গত পঁচিশ বছর ধরে এ জিনিস চলছে। কাজেই আমরা অতটা ভয় পাচ্ছি না, আশা করছি আবার নতুন কোন সিস্টেম চালু হবে। তবে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ এম. এম. আকাশ মনে করছেন, মালয়েশিয়ার এই সিদ্ধান্তে রেমিট্যান্স প্রবাহে যেমন বড় ভাটা পড়ার আশঙ্কা আছে সেটা একটা দিক - কিন্তু তার চেয়েও বড় বিপদ হলো বাংলাদেশের ‘ভাবমূর্তি সঙ্কট।’ যে কারণেই মালয়েশিয়া এটা বন্ধ করুক, আমাদের যে কিছুটা বদনাম হয়ে গেল তা তো অস্বীকার করতে পারি না। আমি যেটুকু সমস্যাটা বুঝতে পারছি, আমাদের দিক থেকেও যে মালয়েশিয়াতে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত ছিল না - সেটা তো পরিষ্কার। বাংলাদেশকে এখন তারই মাসুল গুনতে হবে। কিন্তু মালয়েশিয়া কেন ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক নেয়া বন্ধ করছে, তার কি কোন নির্দিষ্ট কারণ দেখিয়েছে? মালয়েশিয়ার সাংবাদিক শেখ কবীর আহমেদ জানাচ্ছেন, গত ২১ অগাস্ট এ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি, জেনারেল দাতো ইন্দেরা খাইরুল দাজমি বিন দাউদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে জানানো হয়েছে যে সে দেশের বিগত সরকার বাংলাদেশের যে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মারফত শ্রমিক নিত, তাদের এসপিএ সিস্টেম সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকেই বাতিল হয়ে যাবে। এখন যদিও ওই চিঠিতে নির্দিষ্ট কোন কারণ উল্লেখ করা হয়নি, আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারছি ওই ১০টি এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় নিয়োগ পেতে একজন শ্রমিকের যেখানে মাত্র ৪০,০০০ টাকা লাগার কথা, সেই জায়গায় এই এজেন্সিগুলো চার লাখ টাকা পর্যন্ত চার্জ করত বলে জানা যাচ্ছে, বলছিলেন মি. আহমেদ। এই দুর্নীতির সঙ্গে মালয়েশিয়ার পূর্বতন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন মালয়েশিয়ার নাগরিকও জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এই কথিত দুর্নীতির বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি বায়রা কর্তৃপক্ষ। তবে সংস্থার উপদেষ্টা দলিলউদ্দিন ম-ল জানাচ্ছেন, তারা চেয়েছিলেন এই রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতি সব সংস্থার জন্যই উন্মুক্ত করে দেয়া হোক। তার কথায়, এর আগে ২০১৬তে দুই দেশের সরকার যখন আলোচনায় বসেছিল, তখন বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯০০ এজেন্সির নাম জমা দেয়া হয়েছিল- কিন্তু মালয়েশিয়া মাত্র ১০টি এজেন্সিকে বেছে নেয় এবং বলে যে সংখ্যাটা পরে বাড়ানো হবে। আমরা অনেকবার লিখেছি যে প্রসেসটা ওপেন করে দেয়া হোক, কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত আর হয়নি।
×