ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম জিয়ার নাম এসেছে ডিজিএফআইর সাবেক ডিজি রুমীর জবানবন্দীতে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৮ আগস্ট ২০১৮

বেগম জিয়ার নাম এসেছে ডিজিএফআইর সাবেক ডিজি রুমীর জবানবন্দীতে

শংকর কুমার দে ॥ বহুল আলোচিত একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের জবানবন্দীতে নাম এসেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার। তার নাম বলেছেন আন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা পরিদফতরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব) সাদিক হাসান রুমি। ডিজিএফআইর সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব) সাদিক হাসান রুমি তার জবানবন্দীতে বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন ২২ আগস্ট দুপুর বারোটার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাই। ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য ডিজিএফআইর পক্ষ থেকে একটা তদন্ত দল গঠন করার অনুমতি চাই। উত্তরে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেন, আপনাদের তদন্ত করার প্রয়োজন নেই। তদন্তের জন্য একটা কমিটি করে দেয়া হবে। এরপর আমি সেখান থেকে ফিরে যাই। চিন্তা করি, আমার একটা তদন্ত কমিটি গঠন করার প্রয়োজন ছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি সম্পর্কে কিভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন তা ডিজিএফআই প্রধানের জবানবন্দীতে চলে এসেছে। জবানবন্দীতে রুমী বলেছেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। সেদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পাঁচটা ৪৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকা এ্যাটাচমেন্ট কমান্ডার কর্নেল ইমাম আমাকে ফোনে ঘটনা জানান। আমি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি (কর্নেল ইমাম) বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) সামান্য আহত অবস্থায় বাসভবনে পৌঁছে গেছেন। ঘটনাটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে (বেগম খালেদা জিয়া) সঙ্গে সঙ্গে জানানোর চেষ্টা করি। সে সময় তিনি (বেগম জিয়া) নোয়াখালীতে একটি জনসভায় ব্যস্ত ছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এডিসিকে না পেয়ে তার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে টেলিফোন করি। ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে বলি। তিনি শুনে ফোন রেখে দেন এবং বলেন তিনি জানাবেন। এরপর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে টেলিফোন করি। শুনেছেন, জানিয়ে তিনিও টেলিফোন রেখে দেন। এরপর আমি আমার সিআইডির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার এবং কর্নেল ইমামকে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আমাকে জানাতে বলি। পরদিন ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী জানান, ঘটনার দিন রাতে লুৎফুজ্জামান বাবর তাকে ঘটনাস্থল থেকে অবিস্ফোরিত গ্রেনেডগুলো সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। সেই মতে তিনি সেনা সদস্য পাঠিয়ে রাতে দুটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড ওসমানী উদ্যানের ভেতর সেনাবাহিনী দ্বারা ধ্বংস করা হয়। এরপর ২২ তারিখ আমি ডিজিএফআইর কয়েক অফিসারকে পরিদর্শন এবং তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য ঘটনাস্থলে পাঠাই। এলাকাটি পুলিশ দিয়ে কর্ডন করা ছিল, আমার অফিসাররা কোন কিছুই উদ্ঘাটন করতে পারেনি। সেদিন দুপুর বারোটার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাই। ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য ডিজিএফআইর পক্ষ থেকে একটা তদন্ত দল গঠন করার অনুমতি চাই। উত্তরে তিনি বলেন, তদন্তের জন্য একটা কমিটি করে দেয়া হবে। আপনাদের তদন্ত করার প্রয়োজন নেই। এরপর আমি সেখান থেকে ফিরে যাই। চিন্তা করি, আমার একটা তদন্ত কমিটি গঠন করার প্রয়োজন ছিল। জবানবন্দীতে ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল (অব) সাদিক হাসান রুমী বলেন, আমি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দারকে টেলিফোন করি, মাওলানা সালামের মাধ্যমে তাইজউদ্দিনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে বলি। এও বলি, র‌্যাব তাকে খুঁজছে। সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার আমাকে বলেন, মাওলানা তাইজউদ্দিনকে র‌্যাবের হাতে তুলে দিলে অসুবিধা আছে। অসুবিধার কথা জিজ্ঞাসা করলে আমাকে জানানো হয়, সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে। এ ঘটনার দুই থেকে তিন দিন পর ব্রিগেডিয়ার এটিএম আমিন আমাকে জানান, মাওলানা তাইজউদ্দিনকে পাওয়া গেছে। তাকে গুলশান সেফ হাউসে রাখা হয়েছে। পরে এটিএম আমিন এবং সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার জানান, মুফতি হান্নানের দেয়া তথ্য মাওলানা তাইজউদ্দিন স্বীকার করেছে। এও জানায়, এ ব্যাপারে তারা লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পিএস সাইফুল ইসলাম ডিউককে (বেগম জিয়ার ভাগ্নে) এ ঘটনা জানিয়েছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর জন্য। তারা আরও জানায়, মাওলানা তাইজউদ্দিন সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং সাইফুল ইসলাম ডিউক জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে। আমিন এবং সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার তাদের এও জানিয়েছে, মাওলানা তাইজউদ্দিনকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তারা ব্যবস্থা করছে। তারা আরও বলে, মাওলানা তাইজউদ্দিন পাকিস্তান যেতে ইচ্ছা পোষণ করেছেন। আমি তখন তাদের বলি, তোমরা যখন সব ব্যবস্থা করে ফেলেছ আমাকে না জানিয়ে, এখন আমায় কেন জিজ্ঞাসা করছ? ডিউক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বোনের ছেলে। লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ডিউকের ভায়রা। ব্রিগেডিয়ার এটিএম আমিনের সঙ্গে তাদের সখ্য থাকায় ডিজিএফআইর অনেক রিপোর্ট সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে চলে যেত। সেহেতু ডিজিএফআইর গোপনীয়তা অনেক সময় বজায় রাখা সম্ভব হতো না। একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার তদন্তে ডিজিএফআই প্রধান রুমি ছাড়াও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর জবানবন্দীতে নাম এসেছে বেগম জিয়ার। নাম এসেছে তার পুত্র তারেক রহমানের। তখনকার ‘হাওয়া ভবনে’র কর্ণধার হিসেবে তারেক রহমানের নাম আসার পর তাকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু বেগম জিয়াকে আসামি করা হয়নি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি বলেছেন, একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় আগামী সেপ্টেম্বর মাসে হবে। এই মামলার ৫২ আসামির মধ্যে ৩ জনের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে অন্য মামলায়। কারাগারে রয়েছেন ২৩, জামিনে ৮। আর পলাতক রয়েছেন তারেক রহমানসহ ১৮।
×