ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিক নজরুল

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৮ আগস্ট ২০১৮

সাংবাদিক নজরুল

ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে জন্ম নেয়া বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকীয় অবিভক্ত ভারতের উত্তাল স্রোত, রাজনৈতিক উন্মাদনা, ধর্মীয় বিভাজন থেকে শুরু করে বিক্ষুব্ধ আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ের এক সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব। শুধু তাই নয়, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে লাঞ্ছিত মানবতার একজন পূজারীও বটে। অর্ধশত বছর রাজত্ব করা রবীন্দ্রসৃষ্ট জগতে নিজের শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্তের দুঃসময় কোনভাবেই সহজ ও স্বাভাবিক ছিল না। সৃজনশীল দ্যোতনায় আপন অভিগমনকে অবারিত করার আগেই রবীন্দ্র ভুবনে নিজেকে উৎসর্গ করা নজরুল সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের মতো রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটানোর চিন্তাও করতে হয়নি। পাশ্চাত্যে সংস্কৃতির দ্বারেও কড়া নাড়তে হয়নি কবিগুরুর সৃজনকর্ম থেকে আলাদা কিছু সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের একচ্ছত্র আধিপত্যে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলীন করেও তাঁর শৈল্পিক সত্তা আর সৃষ্টি উন্মাদনা তাঁকে যেখানে নিয়ে যায় সেখানে বিদ্রোহী কবির নিজস্ব ক্ষমতায় যে স্থান নির্ধারিত হয়, সেটা শুধু আলাদাই নয় একেবারে ব্যতিক্রমীও বটে। সচেতন সৃজনশৈলীতে নিমগ্ন হওয়ার সময় মাত্র ২৪ বছর। অনেক কম সময়। কিন্তু সেই স্বল্প সময়টুকুতে দাপটের সঙ্গে সৃজন শৌর্যকে অবারিত করেছেন। আপন সংস্কৃতির বেড়াজালে নিজের শৈল্পিক বোধকে লালন-ধারণ করেছেন। আর সেভাবেই বাংলা সাহিত্যকেও দিয়েছেন এক অভাবনীয় সম্পদ, যা কাল ও যুগের সীমানা পার করে আজও অজেয়। যার অম্লান দ্যুতি এখনও সারা বাংলাকে দীপ্যমান করে রেখেছে। অতুলনীয় সঙ্গীত সম্ভার উপহার দেয়া নজরুল বাংলার গানের ভাণ্ডারেও এক অপরাজেয় প্রাণপুরুষ। কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ নজরুল সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর সৃজনকর্মের যে ক্ষেত্র প্রসারিত করেছিলেন, সেখানে প্রকাশ মাধ্যমেও ছিল তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা। শুধু যে লিখতেন তা নয়, সে লেখা যাতে সর্বমানুষের দ্বারে পৌঁছায়, সে সব মাধ্যমের প্রতিও ছিল তাঁর এক প্রকার আগ্রহ ও দায়বদ্ধতা। আর তাই সাংবাদিক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে তাঁর সময় লাগেনি। অবিভক্ত বাংলায় সংবাদপত্রের শুভসূচনা এবং বিস্তার ঔপনিবেশিক শাসন আমলেই শুরু হয়। ১৮১৮ সালে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকাটির মধ্য দিয়ে অবিভক্ত বাংলা সংবাদ মাধ্যমের জগতে পদার্পণ করে। ব্রিটিশ রাজশক্তির আধিপত্যে প্রকাশ পাওয়া এসব কাগজে অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকত। রাষ্ট্রীয় কর্ণধার শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লেখনী তো কোনভাবেই ছাপার অক্ষরে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। আর নজরুল তাঁর সৃজনকর্মে নিবেদিত হলেন যখন অবিভক্ত ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, তার চেয়েও বেশি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে আক্রান্ত হওয়া। বিদ্রোহী চেতনা ধারণ করে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠা নজরুলকে বার বার রাজ রোষানলে পড়তে হয়েছিল। ফলে সৃজন দ্যোতনা থেকে সাংবাদিকতার ভুবনে পা রাখা ছিল এক আবশ্যকীয় কর্মযজ্ঞে নিজেকে শামিল করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়ার আগ অবধি তাঁর শৈল্পিক জীবনের তেমন কোন আভাস পাওয়া যায়নি। সমসাময়িক কাল ছিল মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘মাসিক সওগাত’-এর সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। বালক বয়সে গৃহহীন নজরুলকে জীবন ও জীবিকার তাড়নায় লেটো গানের দলের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। সেইভাবে তিনি লেটো গানও লিখেছেন। সেটা তাঁর সাহিত্যিক ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে সেভাবে মেলানো যায় না। তবে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে করাচীতে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে তাঁকে শৈল্পিক দক্ষতায় সৃজনকর্ম তৈরির বৃহত্তর আঙিনায় প্রবেশ করতে হয়। আর করাচীতে বসে লেখা গল্প ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’র মধ্য দিয়েই বিদ্রোহী কবি তাঁর সাহিত্যিক জগতের দ্বার উন্মোচন করলেন। ১৯১৯ সালে করাচী থেকে পাঠানো এই গল্প ‘মাসিক সওগাত’-এ প্রকাশ করলেন সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। বাংলার সাংবাদিকতার জগতে যিনি এক মাইলফলক, অগ্রগামী নায়ক। পত্রিকার নিজের লেখা দেখে বিস্মিত ও অভিভূত কবি তার সহযোদ্ধাদের নিকট পড়ে পড়ে শুনিয়ে গেছেন। সেই স্বপ্নাবিষ্ট হৃদয়ে প্রকাশ মাধ্যমের প্রতিও গড়ে ওঠে এক ধরনের সহমর্মিতা, যা পরবর্তীতে তাঁকে সাংবাদিক হতে বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত করে। শাসক গোষ্ঠীর রোষানলকে পাশ কাটিয়ে বিদ্রোহী সত্তায় উদ্বেলিত কবির সব লেখা পত্রিকায় ছাপার জন্য বিবেচিত হতো না। তেমনই একটি কবিতা, ‘মুক্তি’ যা মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকায় ছাপার যোগ্যতা না পেলেও ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। আর এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বাঙালীর স্বপ্নদ্রষ্টাই শুধু নয়, বহুভাষা আয়ত্ত করা সুপ-িত ড. মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। ১৯২০ সালে নজরুল ফিরলেন করাচী থেকে। সৈনিক জীবনের অবসান। সাহিত্যের আঙিনায় নবোদ্যমে বিচরণ করার পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমের দিকেও তাঁর নজর চলে যায়। সময়টা ছিল অসহযোগ আর খেলাফত আন্দোলনের এক সংগ্রামী অধ্যায়। শুধু তাই নয়, কবির জীবনেও ঘটে যায় নতুন এক শুভযোগ। সরাসরি প্রকাশ মাধ্যমের সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত করা। সেই যুগান্তকারী পর্বের সূচনা হয় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগের যাত্রায়। আর সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে ছিলেন মুজাফফর আহমদ এবং কাজী নজরুল ইসলাম। মুজাফফর আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই দৈনিক নবযুগ প্রথম দিন থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় এবং তা নাকি নজরুলের অসাধারণ লেখনীশক্তির প্রভাবে। সংবাদপত্রের আঙিনায় একেবারে অনভিজ্ঞ নজরুল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তার সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করে যেতেন। বলা হয় দীর্ঘ সংবাদকে অতি সংক্ষিপ্ত আকারে এনে যেভাবে নিজস্ব ধারায় উপস্থাপন করতেন, তা যেমন বিস্ময়ের ব্যাপার, একইভাবে তাঁর অসামান্য ক্ষমতারও পরিচায়ক। নজরুলের দেয়া সংবাদের শিরোনাম সেই সময়ের আকর্ষণীয় এবং নান্দনিক ব্যাপার ছিল। সংবাদের মধ্য থেকে মূল সারটুকু নিয়ে শিরোনাম দাঁড় করানো নজরুলের এক অভাবনীয় কীর্তি। বিস্ময়করভাবে এসব শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের কবিতাও নিয়ে আসা হতো। প্রসঙ্গক্রমে বিদ্যাপতি ও চ-ীদাসের কবিতার লাইনও এসে যেত। নজরুলের বলিষ্ঠ আর দীপ্ত প্রত্যয়ে দৈনিক নবযুগ বাংলার সংবাদপত্রের জগতে নতুন জোয়ার এনেছিল বলে সমকালীন প-িতদের লেখায় পাওয়া যায়। উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত, গতিশীল শব্দচয়নই শুধু নয়, সংবাদের মূল সারবত্তায়ও ছিল যুগের প্রয়োজন, সময়ের দাবি এবং কালের ঘটনা প্রবাহের এক অনির্বাণ শিখা; যা সর্বমানুষের হৃদয়ে আলোর বন্যায় প্রজ্বলিত করে দিত। নবযুগের হাত ধরেই যেমন নজরুলের পথচলা, পাশাপাশি পত্রিকাটিও নজরুলের মনন সম্পদে ঐশ্বর্যবান হয়ে ওঠে। সেটা যেমন সাধারণ মানুষের কাছে, একইভাবে জ্ঞানী-গুণী এবং বিদগ্ধ মহলেও। সংবাদ মাধ্যম কিন্তু সর্বমানুষের। কতিপয় প্রজ্ঞাবান বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য নয়। এই অকৃত্রিম বোধটুকু নজরুলের ছিল বলে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে জয় করার মধ্য দিয়ে চিন্তানায়কদের দ্বারেও কড়া নাড়তে পেরেছিলেন তিনি। জননন্দিত এই নবযুগ এক সময় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকেও নাড়িয়ে দেয়। ফলে শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কঠোর সতর্ক বার্তাও পাঠানো হয়। এমন মুক্ত আর উচ্চকণ্ঠে সমকালীন ঘটনাবিন্যাসকে সুসংবদ্ধভাবে উপস্থাপন করা হলে ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ এতই ক্ষিপ্ত হলেন যে, এক সময় নবযুগকে বাজেয়াফতের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতে হলো। পরবর্তীতে দুই হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে নবযুগ তার জায়গা দখল করলেও বিদ্রোহী কবিকে আর এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনচেতা আর আত্মপ্রত্যয়ী নজরুল তাঁর ব্যক্তিকবোধে কোন ধরনের আঁচড় সহ্য করতেন না। চেতনালব্ধ মনন জগত এতই অনমনীয়, অবাধ আর মুক্ত ছিল সেখানে সামান্যতম বিধিনিষেধও আঁচ লাগাতে পারত না। বিদ্রোহী চেতনা আর সৃষ্টিসুখের উল্লাসে যা যা অনুভব করতেন শেষ অবধি সেটাই অসামান্য সম্পদ ভা-ারে বাংলা সাহিত্যের আঙিনাকে ভরিয়ে তুলেছেন। ১৯২২ সালের ‘দৈনিক সেবক’ পত্রিকায় কবির সাংবাদিকতার জগতে দ্বিতীয়বারের মতো ফিরে আসা। উপমহাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের আর এক প্রাণপুরুষ মওলানা আকরম খাঁর পত্রিকা ছিল এই ‘সেবক’। এখানেও সেই বিশ শতকীয় উত্তাল সময়ের বিক্ষুব্ধ অধ্যায়। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ‘দৈনিক সেবক’-এর ভূমিকা ছিল যৌক্তিক ও অভাবনীয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের উত্তেজনা আর উন্মত্ততায় অবিভক্ত বাংলা তথা ভারত ছিল উত্তাল। তাই চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেবকের ভূমিকাও ছিল একেবারে সংগ্রামী আন্দোলনের অনুষঙ্গ। ফলে জননন্দিত হওয়ার সমস্ত সুযোগই পত্রিকাটির হাতের নাগালে ছিল। সেই কারণে জনগণের বিশ্বস্ত হওয়া থেকে শুরু করে রাজদ্রোহের মতো বিপাকে পড়া সবই মোকাবেলা করতে হয় এই ‘সেবক’কে। আন্দোলনের ঝড়-ঝাপটা স্তিমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তায়ও ভাটা পড়তে থাকে। শুধু তাই নয়, সেবকের দায়ভার নেয়ার কারণে মওলানা আকরম খাঁকেও জেলের ঘানি টানতে হয়। সেবকের স্থবিরতার এমন দুঃসময়ে সবাই ভাবতে থাকে বিদ্রোহী আর বিপ্লবী কবি নজরুল ইসলামকে এর দায়িত্ব অর্পণ করে পত্রিকাটি তাঁর হাতে তুলে দেয়া। উদ্দীপ্ত আর সচেতন নজরুলকে এই দায়ভার গ্রহণ করতে মোটেও ভাবতে হয়নি। মনুষ্যত্বের অতন্দ্র প্রহরী নজরুল সব সময় মানবতার জয়গান গেয়েছেন। সেখানে জাতি, ধর্ম আর বর্ণের রোষানলকে উপেক্ষাই করেননি, একেবারে বর্জনই করেছিলেন। কিন্তু সেবকের বিশিষ্টজনদের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি তাঁকে ভীষণভাবে আহত করে। উদার আর মুক্ত মনের নজরুল কোন ধরনের গোঁড়ামিকে সহ্য করতে পারতেন না। ফলে সেবকের সঙ্গে তাঁর মতদ্বৈধতা শুরু হলে তাকে পেছনে ফেলে আসতে কবিকে একবারও ভাবতে হয়নি। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার যেদিন তিনি হারালেন সেদিনই সেবক তাঁর কাছে হয়ে গেল দূর অতীত। এর পরে নজরুল ‘দৈনিক মোহাম্মদী’তে ব্যঙ্গ রসাত্মক কলাম লিখতে শুরু করেন। ১৯২২ সালে এই পত্রিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। নজরুলের লেখা ব্যঙ্গের কলাম সারা বাংলায় হাসির বন্যা বয়ে দিল। শুধু ব্যঙ্গ রসাত্মক আলোচনায়ই নয়, শিরোনাম তৈরিতেও কবি অবিভক্ত বাংলায় হাসির ঝড় তুললেন। সাংবাদিক হিসেবে নজরুলের এই অসামান্য কৃতিত্ব সমকালে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে ‘দৈনিক মোহাম্মদী’কে নজরুল যেভাবে জমজমাট করেছিলেন, সেখানেও উগ্র সাম্প্রদায়িকতায় ছন্দপতন ঘটে। মানুষ আর মানবতার কবি নজরুল সমস্ত হীনমন্যতা এবং সঙ্কীর্ণতার উর্ধে উঠে যেভাবে মনুষ্যত্বের পায়ে অঞ্জলি দিয়েছিলেন, সেখানে জাতপাতের কোন বালাই ছিল না। আর এই স্পর্শকাতর জায়গাটিতে কবি বার বার আঘাতপ্রাপ্ত হন। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তাকে রীতিমতো শঙ্কিত করে তোলে। স্বাধীন মত প্রকাশের এই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যদি উগ্র আর মৌলবাদের শিকার হয়, তা হলে মানুষের সঙ্গে মানুষের ফারাক তৈরি হতে সময় নেবে না। এই বোধে নজরুলের চিন্তার জগতে উঠে আলোড়ন, সৃজন দ্যোতনায় আসে বিপ্লবী আবেদন। মানুষ আর মানবতা সব কিছুর উৎসই শুধু নয়, শক্তিও বটে। ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে নতুন একটি রাজনৈতিক পত্রিকা প্রকাশ করতে নজরুল আর মুজাফফর আহমদ একমত পোষণ করেন। এর জন্য অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। সপ্তাহে দু’দিন বের হবে এই সিদ্ধান্তে ঐকমত্য হওয়ায় নজরুল এই নতুন পত্রিকার নাম ঠিক করেন ‘ধূমকেতু’। এই ‘ধূমকেতু’ বাংলার সংবাদ মাধ্যমে যে অভাবনীয় আবেদন রেখেছিল, তা ওই সময়ের জ্ঞানী-গুণীদের লেখায় স্পষ্টভাবে দীপ্যমান। সাধারণ মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল অবিস্মরণীয়। ফলে জনপ্রিয়তাও আকাশ ছোঁয়া হতে সময় লাগেনি। এত অল্প সময়ের মধ্যে পত্রিকাটির এমন প্রচার সারা বাংলায় তোলপাড় হয়ে যায়। ব্রিটিশ রাজন্যবর্গের মসনদ কেঁপে ওঠে। ১২টি সংখ্যায় প্রকাশিত এই সংবাদপত্রের ১২তম সংখ্যায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ এক কবিতা ছাপা হয়। এতে সচেতন রাজনৈতিক বক্তব্য উঠে আসায় ঔপনিবেশিক শাসক নজরুলের ওপর শুধু ক্ষুব্ধই হলো না, তাঁকে আটক করে ১ বছর কারাবন্দী অবস্থায় জেলখানায় রেখে দেয়। আর এভাবেই ধূমকেতুর সঙ্গেও নজরুলের চিরবিচ্ছিন্নতার সূত্রপাত হয়। সৃজন চেতনায় উদ্দীপ্ত নজরুলের মননশক্তির অনবদ্য পরিচয় মেলে তার সাংবাদিকতার জীবন প্রবাহে। যদিও তার সময়কাল ছিল অতি অল্প। তবে সেখানেও তিনি রেখে গেছেন তাঁর যুগান্তকারী সাফল্যের স্বাক্ষর। লেখক : সাংবাদিক
×