ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বীকারোক্তিতে মুফতি হান্নান

তারেক রহমানের আশ্বাসে হাসিনাকে হত্যার জন্য মোহাম্মদপুরে মিটিং করি

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৭ আগস্ট ২০১৮

 তারেক রহমানের আশ্বাসে হাসিনাকে হত্যার জন্য মোহাম্মদপুরে মিটিং করি

শংকর কুমার দে ॥ জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার নীলনক্সা সাজানো হয়েছিল হাওয়া ভবনেই। মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়া জঙ্গী নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে পাওয়া যায় কীভাবে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিতে পরিকল্পনা এঁটেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট ও হরকত-উল-জিহাদ বাংলাদেশসহ (হুজি) জঙ্গী সংগঠনগুলো। ওই হত্যা-পরিকল্পনার বর্ণনায় বিএনপির বর্তমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের তৎকালীন রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে পরিচিত হাওয়া ভবনের নাম বারবার আসে। মুফতি হান্নান জানিয়েছিল, ২১ আগস্টের হামলার জন্য অন্তত তিন দফায় মিলিত হয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। মুফতি হান্নানের বক্তব্য অনুযায়ী, সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার নীলনক্সা সাজানো হয়েছিল হওয়া ভবনেই। ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট একান্ত গোপনীয় সেই বৈঠকে অংশ নেন বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ অন্তত নয়জন। পরবর্তীতে দফায় দফায় মিটিং করে হামলা নিশ্চিত করা হয় এবং বাবরের তত্ত্বাবধানে গ্রেনেড সরবরাহ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে আর বাঁচতে দেয়া হবে না। তাকে মারতেই হবে। হান্নানের জবানবন্দী অনুযায়ী ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট হাওয়া ভবনে আলোচনায় বসেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভূমি উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের একজন (মেজর নূর), জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও জঙ্গী সংগঠন আল মারকাজুল ইসলামীর এক নেতা ও মুফতি হান্নান। ২১ আগস্টের বোমা হামলায় কোন বাড়তি সময় নিতে চায়নি ষড়যন্ত্রকারীরা। হওয়া ভবনের মিটিংয়ের পরপরই দ্বিতীয় মিটিং হয় বাবরের মিন্টু রোডের সরকারী বাসভবনে। এরপরের মিটিং হয়েছিল আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসায়। হান্নানের দাবি, সেখানে অন্য জঙ্গী নেতাদের নিয়ে যাওয়ার পর সালামের ছোট ভাই তাইজুউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। সে (মুফতি হান্নান) জানায়, ‘আমরা অপেক্ষা করার পরে দুইটা কালো পাজেরো গাড়ি আসে। প্রথম গাড়ি থেকে বাবর ও একজন নামে। দ্বিতীয়টা থেকে তিনজন নামে। তারা বৈঠক করে। এরপর আমরা তাদের সঙ্গে বসি। তিনি যে গ্রেনেডগুলো দিতে চেয়েছিল সেগুলো নিয়ে আসি।’ সেখানে বাবর তাদের কাছে গ্রেনেড হ্যান্ডওভার করে বলে উল্লেখ আছে। হামলার ঠিক আগের মুহূর্তের কার্যক্রম বর্ণনা করতে গিয়ে হান্নান জানায়, ২১ আগস্ট দুপুরে তারা রামপুরার বাসায় মিলিত হয়। সেখানেই গ্রেনেডগুলো সবার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এরপর মুফতি হান্নানসহ ১৫ জন ক্যাডার জনসভার আশপাশে অবস্থান নেয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলার পর হামলাকারীরা ভিড়ের মধ্যে মিশে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। একটুর জন্য বেঁচে যান জননেত্রী তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। মুফতি হান্নান এর স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও পাওয়া যায় ইউটিউবে। তিনি বলছেন, ‘হাওয়া ভবনের সভায় তারেক রহমান বলেছিলেন, বর্তমানে দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। শেখ হাসিনা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করেছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। দেশকে উচ্ছৃঙ্খল এবং নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে আমাদের একটা পদক্ষেপ নেয়া দরকার।’ এ সময় মুজাহিদ বললেন, ‘আপনার কথা সত্য, শুধু তাই নয়, ইসলামের বিরুদ্ধেও কাজ করছে। অতএব এটা নিয়ে কাজ করা দরকার। যে অরাজকতা তা রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক মোকাবেলা করতে হবে নচেৎ তাকে এ দেশ থেকে চিরবিদায় দিতে হবে, শেষ করে দিতে হবে।’ জবানবন্দীতে মুফতি হান্নান বলেছে, শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে। তাকে প্রথম টার্গেট করা হয় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। পরবর্তীকালে জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আবার হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আর সে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। মুফতি হান্নানের জবানবন্দী ॥ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আসামি জঙ্গী নেতা মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সী। আদালতের মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় জবানবন্দী দিয়েছেন মুফতি হান্নান। আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি আবদুল হান্নানের সেই জবানবন্দী তুলে ধরা হলো : আমি মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সী ‘এই মামলায় পূর্বে একবার স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছিলাম। তখন আমি সব কথা বলতে পারি নাই। মাননীয় মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্বেচ্ছায় একটি দরখাস্ত দিয়ে আরও কিছু কথা বলার ও লেখার আছে জানালে তিনি আমার দরখাস্ত মঞ্জুর করেছেন। আজকে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন ওই বিষয়ে আমার বক্তব্য আপনার মাধ্যমে রেকর্ড করতে। আমি বিবেকের তাড়নায় পূর্বের প্রদত্ত দোষ স্বীকারোক্তির সঙ্গে আজকের বক্তব্য পেশ করিতেছি। জোট সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসা থেকে নেয়া ১৫টি গ্রেনেড দিয়ে ওই দিন শেখ হাসিনার জনসভায় হামলা চালানো হয়। ওই হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিএনপির সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের মাধ্যমে জঙ্গী নেতাদের সঙ্গে জোট সরকারের প্রতিনিধি ও তারেক রহমানের পরিচয় হয় এবং হাওয়া ভবনে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বৈঠক হয়। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করে। তখন বিএনপির সঙ্গে আমাদের সংগঠনের সম্পর্ক আরও জোরদার করার লক্ষ্যে হুজির আমির মাওলানা আবদুস সালাম, শেখ ফরিদ, মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বক্কর, জাহাঙ্গীর বদর (জান্দাল), চট্টগ্রামের এমপি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও কুমিল্লার মুরাদনগরের এমপি কায়কোবাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমাদের আমির আবদুস সালাম তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তারা ১৯৯৬ সালে ধানখালীতে গ্রেফতার হওয়া ৪১ জনকে হাইকোর্ট থেকে জামিনের ব্যবস্থা করে দেন। এইভাবে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত থাকে এবং তারাও সহায়তা করতে থাকেন। ২০০৩ সালের শেষের দিকে আমাদের আমির আবদুস সালাম, শেখ ফরিদ, মাওলানা তাইজুউদ্দিনের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের যোগাযোগ হয়। তারা বাবর সাহেবের বেইলি রোডের সরকারী বাসায় যান। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জি কে গাউস, কমিশনার আরিফ (সিলেট), মাওলানা ইয়াহিয়া আবু বক্কর ওরফে আবদুল করিম। আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আমির সাহেবের সঙ্গে আলোচনার পর জি কে গাউস এবং আরিফকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর সিলেটে কাজ করে যাওয়ার জন্য বলেন। এরপর সিলেটে স্থানীয় বিএনপি ও হরকতের লোকরা বিভিন্ন জায়গায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। ২০০৪ সালের প্রথমদিকে হুজির একটি মিটিং হয়; যেখানে উপস্থিত ছিলেন আমির আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ ও জান্দাল। মিটিংটি হয় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হুজির অফিস দারুল আরকান মাদ্রাসায়। মিটিংয়ে আবু বক্কর, মাওলানা ইয়াহিয়াও উপস্থিত ছিলেন। মিটিংয়ে কিভাবে তারেক রহমান ও বাবরের সঙ্গে কথা বলা যায় সে আলোচনা হয়। পরে মোহাম্মদপুর সাতমসজিদে মাওলানা আবদুস সালাম, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা তাইজুউদ্দিন, কাশ্মীরী নাগরিক আবদুল মাছেদ ভাটসহ একসঙ্গে পরামর্শ করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা করি। মাওলানা তাইজুউদ্দিন গ্রেনেড সরবরাহ করার দায়িত্ব নেন। তাজ ভাই বলেন, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর আমাদের সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন। তারেক রহমানের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর একদিন (তারিখ ও সময় মনে পড়ছে না) মুরাদনগরের এমপি কায়কোবাদ সাহেব আমাদের হাওয়া ভবনে নিয়ে গিয়ে তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমরা আমাদের কাজকর্মের জন্য তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা চাইলে তারেক রহমান সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এরপর আমরা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যার জন্য মোহাম্মদপুরসহ কয়েক জায়গায় গোপন মিটিং করি। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে (তারিখ স্মরণ নাই) সিলেটে গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে ঢাকার মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভার সংবাদ জানতে পারি। সেখানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর আক্রমণের সিদ্ধন্ত নেই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পুনরায় তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত হয়। আমি মাওলানা আবু তাহের, শেখ ফরিদ, মাওলানা তাইজুউদ্দিন, মাওলানা রশিদসহ আল মারকাজুলের গাড়িতে করে হাওয়া ভবনে যাই। সেখানে হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামের আলী আহসান মুজাহিদ, ব্রিগেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার, ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিমকেও উপস্থিত পাই। কিছুক্ষণ পর তারেক রহমান আসেন। আমরা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর হামলার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তাদের সহায়তা চাই। তখন তারা আমাদের সকল প্রকার প্রশাসনের সহায়তার আশ্বাস দেন। তারেক সাহেব বলেন যে, আপনাদের এখানে আর আসার দরকার নাই। আপনারা বাবর সাহেব ও আবদুস সালাম পিন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করবেন। তারা আপনাদের সকল প্রকার সহায়তা করবে। ১৮ আগস্ট আমি আহসান উল্লাহ কাজল, মাওলানা আবু তাহেরকে নিয়ে আবদুস সালাম পিন্টুর ধানম-ির সরকারী বাসায় যাই। সেখানে আবদুস সালাম পিন্টু, বাবর, মাওলানা তাইজুউদ্দিন, কমিশনার আরিফ ও হানিফ পরিবহনের হানিফ উপস্থিত ছিলেন। পিন্টু ও বাবর বলেন যে, কমিশনার আরিফ ও হানিফ সাহেব আপনাদের সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করবে এবং আমাদের সকল প্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থায় থাকবে। সে মোতাবেক ২০ আগস্ট জান্দাল ও কাজল আবদুস সালাম পিন্টুর বাসা থেকে ১৫টি গ্রেনেড ২০ হাজার টাকা গ্রহণ করে বাড্ডার বাসায় নিয়ে আসেন। পরদিন ২১ আগস্ট আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে গ্রেনেড হামলা চালাই।’ মুফতি হান্নানের মৃত্যুদন্ড কার্যকর ॥ মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর করা হয় ১০ এপ্রিল রাতে, ২০১৭ সালে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার মামলায় হরকত-উল-জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ তার দুই সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
×