ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নেইপল ॥ জীবনান্তিকা

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২৭ আগস্ট ২০১৮

বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নেইপল ॥ জীবনান্তিকা

বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নেইপল ২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। গত ১১ আগস্ট ২০১৮-এ ৮৫ বছর বয়সে তিনি তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পছন্দের বাসস্থান লন্ডনে পরলোকগমন করেন। তার জন্ম হয়েছিল ১৯৩২ এর ১৭ আগস্ট, ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর চাগুয়ানাসে। নিজেকে ভিএস নেইপল নামে পরিচিত রেখে প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি ৩০টিরও বেশি উপন্যাস ও কল্পকাহিনী এবং ভ্রমণ ও অভিজ্ঞানভিত্তিক বই আমাদের ইংরেজী ভাষায় উপহার দিয়ে গেছেন। ১৯৭৬ সালে আমি কয়েক মাস জাতিসংঘের উন্নয়ন কার্যক্রম সংস্থার পরামর্শক হিসেবে উগান্ডায় ছিলাম। উগান্ডার রাজধানী কামপালায় পাহাড় ও বনরাজির পরিম-লে ছবির মতো বসানো আফ্রিকার নামকরা ম্যাকরারে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরতান্ত্রিকতায় পরাক্রম প্রতিভূ ইদি আমিনের পতনের পটভূমিকায় প্রথম শুনি নেইপলের নাম। তিনি ১৯৬৫-৬৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবাসী লেখক হিসেবে থাকার, লেখার এবং উগান্ডা, কেনিয়া ও রুয়ান্ডার প্রত্যন্ত এলাকায় ঘোরার সুযোগ পেয়েছিলেন। আফ্রিকার লোকমানস ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। ম্যাকরারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে তার নাম শুনে আমি প্রথম তার লেখা ‘আঁধারের এক এলাকা’ (অহ অৎবধ ড়ভ উধৎশহবংং, ১৯৬২) বইটি পড়ি। প্রায় অবিশ্বাস্য সততা ও সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে নেইপল এই বই- যা মূলত ভ্রমণ বৃত্তান্ত; এ ইংল্যান্ড থেকে আগত ভারতের উত্তর প্রদেশে দারিদ্র্য জর্জরিত ভিন্নতর ও দুর্বল আর্থ-সামাজিক পরিমন্ডলে তার পিতৃপুরুষের ভিটা খুঁজতে গিয়ে দেখলেন এক বুড়িকে- যিনি সেখানকার অভাব ও অপ্রাপ্ততায় আত্মসম্মান হারিয়ে তার চকচকে ইংলিশ জুতা আঁকড়িয়ে ধরেছিলেন। বুড়ির কাছে সেই চকচকে জুতা পায়ে মানুষটি ভিন্নতর ও উন্নততর এক পরিম-লের অধিকারী হিসেবে রূপ পেয়েছিলেন। দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে মহাসাগরের ওপারের বার বার শোনা বিত্তের বৈভব ভারত উপমহাদেশের সাধারণ মানুষকে ভিন্নতর ও উন্নততর জগতে মুক্তি পাওয়ার প্রায় অসম্ভব অভিলাষে আচ্ছন্ন এবং সম্ভবত নিজ দেশের প্রতি অনীহা নিয়ে জীবনকে দায় হিসেবে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলতে বাধ্য করে বলে নেইপল প্রকারান্তরে বলতে চেয়েছেন। ভারত নেইপলের অনুভূতি ও উপলব্ধিতে এক আহত সভ্যতা বা আবেগের নিলয় যা তিনি সহজ-সাধারণ কথায় মনকাড়াভাবে তুলে ধরেছেন। ১৯৭৭ সালে এই অনুভূতিই প্রকাশ পেল আরও একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘ভারত- এক আহত সভ্যতা’য় (India : A Wounded Civilisation, 1977)। তার মতে এই সভ্যতাকে অনধিকারভিত্তিক পরাক্রম নিয়ে তার মূল সত্তা ও পরিচিতি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মভিত্তিক ভিনদেশী আগ্রাসন। এই অনুভূতি অনেকাংশে সংবেদনশীলতায় মুক্তি পায় ১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘ভারত : এ সময়ের লক্ষ্য দ্রোহের নিলয়’ (India : A Million Mutinies Now, 1990)-এ। এর পরে একে একে তেমনি চমকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম ‘বিশ্বাস মহোদয়ের বাড়ি’ (A House for Mr. Biswas, 1961) ‘নদীর এক বাঁক’ (A Bend in the River, 1979) ‘এক মুক্ত রাষ্ট্রে’ (In a Free State, 1971) ও ‘মিগুয়েল সড়ক’ (Miguel Street, 1953) পড়ে। ‘বিশ্বাস মহোদয়ের বাড়ি’তে নেইপল ত্রিনিদাদে ভারতীয় বংশোদ্ভূত তিন প্রজন্মের বিবর্তনীয় উন্মেষ তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসের নায়ক তার দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা সংগ্রামী সাংবাদিক পিতার প্রতিচ্ছবি বিশ্বাস মহোদয় তার বিশ্বকে ব্যাপক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অপরিবর্তনীয় বলে দেখে নিজেকে অনাকর্ষণীয় কোন কিছুর পর্যায় থেকে তুলে পৃথক শনাক্তীয় সত্তায় উঠিয়ে নিয়েছিলেন। তার লেখায় তিনি বিফল আকাক্সক্ষা সত্ত্বেও অস্তিত্বের সঙ্কটে হারিয়ে যাননি। ‘নদীর এক বাঁক’-এ নেইপল ক্যারিবিয়ান এলাকার গণউত্থানের পটে পৃথিবীকে তুলে ধরেছেন অর্থহীন অবয়বে- এমনকি কোন অর্থ-বহনের সম্ভাবনার বাইরের স্তবক হিসেবে। তার চারদিকের অর্থবিহীন বর্তমানকে পেছনে রেখে অর্থ উদ্দীপনের নিলয় হিসেবে পারিপার্শ্বিকতাকে দেখার এবং দুঃখে লালিত অভিলাষ অনুযায়ী আর্তি ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। ‘এক মুক্ত রাষ্ট্রে’ (১৯৭১) নেইপল আফ্রিকার নাম-না-বলা ছোট এক দেশের মাঝ দিয়ে এক ইংরেজ সুশীল সেবকের সঙ্গে তার বন্ধুর স্ত্রীকে সঙ্গী করে গাড়ি চালানো ভ্রমণকে কেন্দ্র করে সে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতির অর্থহীনতাকে সাধারণের নিরাপত্তার নির্দিষ্ট অস্তিত্বে ফিরে নিয়ে যাওয়ার অভিলাষ তুলে ধরেছেন। এর বর্ণনা ও সংলাপ দিয়ে নেইপল তার চারপাশে দাঁড়ানো অর্থহীন বর্তমানকে, অর্থবহ ভবিষ্যতে নিয়ে যাওয়ার আর্তি তুলে ধরেছেন। ‘মিগুয়েল সড়ক’-এ নেইপল তার তারুণ্যের ত্রিনিদাদের এক নিম্নবৃত্ত ঘিঞ্জি শহর এলাকার জীবনধারার দৃশ্যমান অর্থহীনতা, ব্যর্থতা কিংবা সামনে এগিয়ে যাওয়ার সন্দিপনের অনুপস্থিতি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই ধরনের করুণ ও প্রায় নিষ্ফল জীবন থেকে মুক্তি নেয়ার মানবিক প্রয়োজনীয়তা তিনি তুলে ধরেছেন সবার বিবেককে সাড়া দেয়ার লক্ষ্যে। তার ‘মধ্য পথ’ (The Middle Passage, 1962) তার জন্মদেশের সমাজ ব্যবস্থার অকৃত্রিম প্রতিফলক। সময় ব্যাপ্ত নিষ্ফল আর্থ-সামাজিক প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে তিনি নিরাশার সঙ্গে বলেছেন যে, ওই ধরনের প্রচেষ্টা পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় সফল হবে না। এসব বইয়ে সাধারণ্যে দৃশ্যমান, নিরানন্দ ও দারিদ্র্যে ঘেরা পটে পাঠককে ভাবিয়ে তোলার উপকরণাদি কম কথায় ও সোজা ভাষায় হৃদয় স্পর্শ করে বলতে পেরেছেন নেইপল। প্রায় ৫০ বছর ধরে ৩০টির চেয়েও বেশি উপন্যাস, ভ্রমণ বৃত্তান্ত ও ব্যক্তিগত প্রবন্ধ লিখে গেছেন তিনি। তাঁর অনুভূতি-উপলব্ধি ভারত ও আফ্রিকার সাধারণ মানুষের অনুকূলে হলেও তাদের পরিমন্ডল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তিনি অকপটে এবং ভাবনার খোরাক হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরেছেন। এরূপ বিষণ্ণ তাভিত্তিক পরিবর্তনের অবচেতন ডাক অবশ্য সব সময় প্রকাশ পেয়েছে ইংরেজীতে। কোন ভারতীয় বা আফ্রিকান ভাষার চর্চা নেইপল করেননি। ১৯৭১ সালে তিনি বুকার পুরস্কার পান ‘এক মুক্ত রাষ্ট্রে’-এর জন্য। তিনটি ছোট গল্পের সঙ্কলনে তিনি এই বইয়ে ৩টি ভিন্নতর রাষ্ট্রের পরিবেশ ও লোকমানস তুলে ধরেছেন। ২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। স্বাভাবিক জীবনধারার বাইরে নিজ আবহ থেকে দূরে সরে যাওয়া বা আসা মানুষকে তাঁর লেখার উপজীব্য হিসেবে ফুটে ওঠানোর পটে সাহিত্য আলোচকরা তাঁকে উদ্বাস্তুদের কবি (চড়বঃ ড়ভ ঃযব উরংঢ়ষধপবফ) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নেইপল তার লেখা সম্পর্কে নিজেই বলেছেন : লেখার ভেতর দিয়ে তার আত্মা, হৃদয় ও স্মৃতির গভীরতম অংশ স্পর্শ করে উতলে ওঠে (Nwe York Reviwe of Books, এপ্রিল ২৩, ১৯৮৭)। নোবেল পাওয়া উপলক্ষে তার দেয়া বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, তিনি তার বইয়ের মধ্যেই মিশে আছেন, তার বইগুলোই তিনি। তার মতে সকল সাহিত্যিকের অবয়ব বা কর্ম বস্তুনিষ্ঠতার বাইরে মৌলিকতা বিবর্জিত বা কৃত্রিম এবং তা বিবর্তমান সংস্কৃতির নতুন সুরে ও মানসের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়ায় নিয়ত পরিবর্তনশীল। নেইপলের জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ শাসিত ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর চাগুয়ানাসে। তার পূর্বপুরুষরা ১৮৮০ এর দশকে চুক্তিবদ্ধ আখচাষী হিসেবে ভারত বা নেপাল হতে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোতে এসেছিলেন কিংবা দাস হিসেবে তাদের উপনিবেশ স্থাপনকারী শ্বেতাঙ্গ বিত্তবানদের অধিকতর বিত্ত আহরণের জন্য আনা হয়েছিল। তার নেইপল গোত্রিক নাম ভারতের উত্তর প্রদেশ নয়, লাগোয়া নেপালের ওই নামীয় গোত্র উৎসারিত বলে জানা যায়। তার বাবা শ্রীপ্রসাদ নেইপল ১৯৩০ এর দশকে ত্রিনিদাদে তার পৈত্রিক দারিদ্র্যের বাইরে নিজ ভাষার চর্চা ছেড়ে একজন ইংরেজী ভাষার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। নেইপলের মা দ্রোয়াপাতি কপিলদেও সেখানকার- ভারতীয় সমাজের উৎসারণ, স্বামীর তুলনায় বিত্তশালী ছিলেন। সাংবাদিক বাবার জীবন ও বৃত্তি নেইপলকে লেখক হিসেবে নিজকে বিকশিত করার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ৬ বছর বয়সে নেইপল তার বাবা-মার সঙ্গে চাগুয়ানাস থেকে ত্রিনিদাদের রাজধানী পোর্ট অব স্পেনে আসেন এবং সময়ান্তরে সেখানকার নামকরা সরকার পরিচালিত মহারানীর রাজকীয় কলেজে পড়াশোনা করেন। শিক্ষার সংগ্রামে তিনি ছিলেন অকুতোভয় ও সর্বক্ষণিক। ফলত এই কলেজ থেকে সরকারী মেধাবৃত্তি নিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে আসেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে সেকালের অভিজাত বিষয় ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইংরেজী সাহিত্যের সঙ্গে তার এই পরিচয় ভাষার নিরন্তর ও নিরলস চর্চায় উন্নীত হয়। ইংরেজীকে তিনি তার সব অনুভূতি প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ ও প্রয়োগ করতে থাকেন। সেখানে তিনি সহপাঠী প্যাট্রিসিয়া এনহালের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব পান। ১৯৫৩ সালে তারা দু’জনই অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক হয়ে বেরিয়ে আসেন। প্যাট্রিসিয়া তার সেবাযতœ ও আর্থিক সঙ্গতির ভার নিয়ে তাকে বিত্তস্বল্প জীবন সত্ত্বেও লেখার চর্চায় সারাজীবন সন্দীপিত করে গেছেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ও প্যাট্রিসিয়া অক্সফোর্ড থেকে লন্ডনে আসেন এবং ১৯৯৫ সালে তারা বিয়ের বাঁধনে একে অন্যকে আবদ্ধ করেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগ পর্যন্ত নেইপল নিদারুণ অর্থকষ্টে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি লন্ডনে থাকাকালীন নামকরা নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন এবং কিছুদিন বিবিসিতেও খ-কালীন সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। এই জীবনের এক সময়ে প্যাট্রিসিয়াকে স্বল্প বেতনের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেও ইংরেজী সাহিত্যের এই সাধকের ভরণ-পোষণ চালাতে এবং লেখাকে সব কাজের ওপর রেখে স্বামীর সৃজনশীলতাকে লালিত করতে হয়। প্যাট্রিসিয়া নেইপলকে লিখতে, বাঁচতে ও উপরে উঠতে একনিষ্ঠ সেবা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও নেইপল, মার্গারেট মারে নামক এক মহিলাকে একই সময়ে ২৫ বছর ধরে রক্ষিতা রূপে সময়ান্তরিক সাহচর্য দেন। মার্গারেট মারে ও প্যাট্রিসিয়ার সাহচর্যে থাকাকালীনও তিনি তিন সন্তানের জননী মার্গারেট গুডিং নামে এক ব্রিটিশ-আর্জেন্টাইন মহিলাকে প্রায় ২৪ বছর ধরে ১৯৯৫ পর্যন্ত জীবন ও ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে সময় দেন। মারে এরূপ ত্রিমাত্রিক জীবনযাপনের স্মৃতিচারণ করে নেইপলের বিরুদ্ধে সময়ান্তরিক নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু অভিযোগ করেননি। প্যাট্রিসিয়া ও এই বিষয়ে কখনও সরব হননি। ১৯৯৫ এ স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া ক্যান্সারে মারা যান আর সঙ্গে সঙ্গে নেইপল গুডিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টেনে অভাবনীয় দ্রুততার সঙ্গে নাদিরা আলভি নামের এক পাকিস্তানী বিধবা সাংবাদিককে বিয়ে করেন। নাদিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল পাকিস্তানের লাহোরে এক মার্কিন কূটনীতিকের বাসস্থানে। নাদিয়া তার যুবতী জীবনের একাংশ স্বাধীনতা পূর্বের বাংলাদেশে কাটিয়েছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি নাদিয়ার আগের ঘরের সন্তান মালিহাকে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেন। তার ব্যক্তিগত এই জীবনের উড়নচ-ীর ধারা অúূর্ণ সন্তোষ নিয়ে বেঁচে থাকার পথে কল্পিত সুখ ও তৃপ্তি পাওয়ার সর্বক্ষণিক বাসনার প্রতিফলন বলে ধরা যায়। এই জীবনকথা তিনি বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি অকাট্য বিশ্বস্ততার আলোকে কখনও গোপন করতে চেষ্টা করেননি। সাহিত্য চর্চার পথে সম্ভবত ভিন্নতর কোন কিছুই তিনি ব্যত্যয় হিসেবে গ্রহণ করেননি। ২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সময়, সুইডিশ একাডেমি উল্লেখ করে যে নেইপল তার লেখায় কল্পীয় বিবরণীর সঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত সমীক্ষণ মিলিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাদের মতে এভাবে মিলিয়ে দেয়া সাধারণত চেপে রাখা ইতিহাসকে আমাদের সামনে উপস্থিত করতে সহায়তা করে। এই প্রেক্ষিতে তাদের সযতœ বিচারে নেইপল এক আধুনিক দার্শনিক। তাদের বীক্ষণে নেইপল প্রহরী-প্রখরশৈলীতে ক্রোধকে সঠিকতায় রূপান্তর এবং ঘটনার পরম্পরাকে তার অন্তর্নিহিত সহজাত পরিহাসে ফুটিয়ে সমাজকে কশাঘাত করেছেন। ভাষার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ এবং সহজ-সরল বচনশৈলী পাঠককে তার শনাক্তকৃত সত্য আংশিক সঠিক হলেও পূর্ণ বিশ্বাস ও সমর্থনের বলয়ে নিয়ে এসেছে। তার স্মৃতিতে সমকালীন অন্য লেখকদের বিবেচনা বা স্মৃতিতে স্থান না পাওয়া বঞ্চিতদের ইতিহাস দৃঢ়তার সঙ্গে স্পন্দিত হয়েছে। আমার সযতœ বিবেচনায় সমসাময়িক ইংরেজী ভাষার অন্যান্য লেখকের তুলনায় অন্যকে সজাগ করার এরূপ নিরানন্দ সক্ষমতা তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। ইংরেজ না হয়েও এভাবেই তিনি ইংরেজী ভাষাকে ব্যবহারিক দিকদর্শন দিয়েছেন। তার এই সক্ষমতা আমার প্রতীতি দৃঢ়তর করেছে যে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে ইংরেজদের সবচেয়ে বড় অবদান ইংরেজী ভাষা এবং স্থিতিশীল ও রাজনৈতিক প্রশাসন, যে ভাষার ভিনদেশী ভিনজাতি চর্চা ও প্রয়োগকে তারা সবসময় স্বাগত জানিয়েছেন এবং যে সমাজ ব্যবস্থার অনুসরণ ও পরিমার্জন তারা সব দেশে উৎসাহিত করেছেন। নেইপল তার লেখায় ধনতান্ত্রিক ও বিত্তশালী প্রথম বিশ্বের আপেক্ষিকতায় তৃতীয় বিশ্বের জাগতিক অপূর্ণাঙ্গতাকে তুলে ধরেছেন এবং তৃতীয় বিশ্বের অনুকূলে সকল সহানুভূতি ও সমর্থন দিয়েও প্রথম বিশ্বের স্থিতিশীল আর্থ-সামাজিক বলিষ্ঠতাকে পছন্দনীয় আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যৌবনের পরিচ্ছন্ন মুখাবয়বের পরিবর্তে শেষ জীবনে তিনি ফরাসী আদলের দাড়ি রেখে হয়ত ইংল্যান্ডের আপেক্ষিক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অববায়িত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তথাপিও সেখানকার সমাজ ব্যবস্থা ও জীবনশৈলী আফ্রিকা বা এশিয়ার অন্য কোন এলাকার তুলনায় বড় বা গ্রহণীয় বলেই প্রতিভাত করেছেন। তার লেখা ও জীবনধারায় তিনি বর্ণ-মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হয়েও ইংল্যান্ডের অধিবাসী ও ইংরেজী ভাষার শৈলী-সাধক রয়ে গেছেন। ভাষা হিসেবে ইংরেজীকে গ্রহণ করে ও এর ব্যবহারশৈলীতে দৃশ্যমান সরল বৈচিত্র্য এনে তিনি তার উৎকর্ষ সন্ধানী মানসকেও ফুটিয়ে তুলেছেন। ইংরেজ না হয়েও ইংরেজীর এমন তীক্ষè সংবেদনশীল ব্যবহার তার সকল লেখাকে বিশেষত্ব দিয়েছে, ইংরেজ ও ইংরেজীভাষীদের কাছেও প্রশংসার্হ হয়েছে। তার শেষ জীবনের লেখা ‘অর্ধজীবন (ঐধষভ ধ খরভব, ২০০১) এবং ‘জাদু বীজ’ (গধমরপ ঝববফং, ২০০৪)-এ উইলি চন্দ্রারে ভারত থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে আফ্রিকা, আফ্রিকা থেকে ভারত হয়ে লন্ডনে এসে থিতু হয়ে বসার কল্পকাহিনী সে সময়কার জীবনের অর্থবিহীন উদ্দেশ্যবিমুখতার ওপরে প্রতীতিতে স্থান পাওয়া ধনতান্ত্রিক প্রথম বিশ্বে আশ্রয়-নিলয়ের অনুকূলে উপসংহার যেন তারই জীবন কথা হিসেবে প্রতিভাত। ত্রিনিদাদের আকর্ষণ, ইউরোপ-আফ্রিকা ভ্রমণের বৈচিত্র্যলব্ধ সন্তোষ সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের সলেসবারির উইল্টশায়ার এভনকে তিনি তার শান্তির শেষ নিলয় হিসেবে ব্যবহার করে গেছেন। ২০১৬ এর নবেম্বরে তিনি একবার ঢাকা এসেছিলেন। সে সময় আমি ও আমার স্ত্রী, এ দেশে অন্যান্যের মধ্যে তার দুই গুণগ্রাহী, তার তারুণ্যের আকর্ষণ ক্যারিবিয়ান ছাড়িয়ে আরও দূরে পোটওরিকতে ছিলাম বলে দেখা হয়নি। সেখান থেকে ফিরে এসে তার আহত সভ্যতার নিলয় ভারতের উত্তর প্রদেশ ছাড়িয়ে এই ঢাকায় তার লেখা বইগুলো জীবনবোধের টুকিটাকি হিসেবে আমাদের দু’জনের চিত্ত ও চিন্তার বৃত্তে তার পরেও ছড়িয়ে আছে বলে বোধ করছি। জয়তু বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নেইপল। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী
×