ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

মানসিক বিকাশ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনে খেলার মাঠ ও পাঠাগার

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৭ আগস্ট ২০১৮

 মানসিক বিকাশ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনে খেলার মাঠ ও পাঠাগার

আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় বাংলাদেশের ভিত দিন দিন মজবুত হচ্ছে। যথার্থ সহযোগিতা, উৎসাহ আর উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে। উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য ক্রীড়াবিদ তৈরিতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। আজ গ্রামে খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। খেলাধুলায় আধুনিক কৌশল শিক্ষাব্যবস্থাসহ গ্রামের সার্বিক ব্যবস্থাপনা অটুট রাখা জরুরী। আগে গ্রামের মানুষ পতিত জমি মাঠ হিসেবে ব্যবহার করত। সেখানে দৌড়ঝাঁপ, হা-ডু-ডু, ফুটবল আরও কত খেলাই না খেলত। আজ পতিত জমি দখল হয়েছে, জমিগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন। খেলাধুলার উন্নয়নের জন্য এগুলো রক্ষা করা উচিত। সেই সঙ্গে আগামী প্রজন্মকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে হবে। কারণ, বাঙালীরা অলস অথর্ব নয়। এরা পরিশ্রমী-খেলাধুলায় পারদর্শী। এদের রয়েছে অনেক শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস। মানুষকে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য খেলাধুলার কোন বিকল্প নেই। খেলাধুলা মনে স্বাচ্ছন্দ্য আনে, দেহে প্রশান্তি ঘটায়। পরিচ্ছন্ন বিনোদন ও খেলাধুলায় যে শিশু বেড়ে ওঠে তার পক্ষে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব। আবার অপরিচ্ছন্ন বা কুয়াশাচ্ছন্ন বিনোদনে বেড়ে ওঠা শিশুর জীবন ধ্বংস হতে বাধ্য। এ কারণে বলা হয়, শিশু বয়সে মানুষ যা গ্রহণ করে পরবর্তী জীবনে সে তা লালন করে। আমরা আমাদের দেশকে আলোকিত ও পরিচ্ছন্ন মানুষে ভরপুর করে গড়ে তুলতে চাই- এর জন্য দরকার সুস্থ-সুন্দর সহজলভ্য খেলাধুলা ও বিনোদন ব্যবস্থা। খেলার মাঠ কমে যাচ্ছে, লোকসংখ্যা বাড়ছে। নগরীতে আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, মার্কেট, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র, অফিস, হাসপাতাল কোথায় হবে এটা নির্ধারণ ও পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমেই নগরী সম্প্রসারণ দরকার। আবার পরিকল্পনা যাতে যথাযথ বাস্তবায়ন হয় সেই পদক্ষেপও প্রয়োজন। একটা বিষয় আজ লক্ষণীয় যে, রাজধানীসহ সারাদেশের শহরগুলোতে শিশুরা সাঁতার শেখার স্থান খুঁজে পায় না। বাংলাদেশে বন্যা হয়, আবার অতি বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা হয়। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এদেশের মানুষকে দুর্যোগ মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে হয়। এমন দেশের শিশুদের বিপুল অংশ আজ সাঁতার শেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সাঁতার শেখার জন্য শহরে যে কমপ্লেক্সগুলো রয়েছে তা জনসংখ্যার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ, সাঁতার কাটার পুকুর, গাছে গাছে চড়ে আম-জাম-পেয়ারা খাওয়ার গাছ, শুধু এই ঢাকা শহরেই নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব শহরেই উধাও হয়ে গেছে। এ নিয়ে সঙ্গত কারণেই আমাদের আক্ষেপের সীমা নেই। মেয়েরাও সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে এক্কা-দোক্কা, বৌচি, দাঁড়িয়াবান্ধা ইত্যাদি খেলত। তেমনি প্রায় প্রত্যেক পাড়ায়ই ছিল একটি-দুটি পুকুর। সেখানে স্কুলে যাওয়ার আগে ঘণ্টাখানেক পাড়ার ছেলেরা মিলে সাঁতার কাটা, নানা রকম জলকেলিতে মেতে ওঠা, দাপাদাপি করা এসব ছিল নিত্যদিনের রুটিন। আর প্রতিটি শহরে গাছগাছালিও ছিল কত। তার কোনটা ব্যক্তিমালিকানার, কোনটা বারোয়ারি। সব ক’টিতেই ছিল শহরের শিশু-কিশোরদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য, একচ্ছত্র আধিপত্য। এসব নিয়ে নালিশ-সালিশও যে হতো না তা নয়। কিন্তু বিচার-আচার যাঁরা করতেন, তাঁরাও জানতেন জীবনের ঊষালগ্নে তাঁরা নিজেরাও কম দাপিয়ে বেড়াননি চারদিক। তাঁরাও ঘুঘু ডাকা বৈশাখী দিনে কোঁচভর্তি কাঁচা আম, নুন-মরিচ আর ছোট্ট পেন্সিলকাটা ছুরি নিয়ে বগুড়া জেলা স্কুলের বারান্দায় কাটিয়েছেন অনেক দুরন্ত দুপুর। কাজেই ঢিল মেরে কাঁচা আমপাড়া আর সেই সঙ্গে নালিশ-সালিশ- সবই ছিল সেই জীবনের অনুষঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট-নাইকো ভালবাসা, নাইকো খেলা। আম-জাম খাওয়া বাদ দিয়ে আধুনিক নগরসভ্যতা সাবাড় করেছে গাছপালা! আর প্রকৃতির এই অবারিত দানগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত করলাম আমাদের শিশু-কিশোরদের বিকল্পে আমরা আমাদের সন্তানদের কী দিয়েছি? খেলার মাঠের পরিবর্তে পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার। যখন শহরে মাঠ ছিল খেলাধুলার জন্য, তখন ছেলেরা স্কুল থেকে এসে বই-খাতা ছুড়ে ফেলে কোথায় ছুটে যেত? না, ওই খেলার মাঠে। আর এখন? এখন কোথায় যায়? হ্যাঁ, এখনও ছুটে যায় বটে, তবে তা খেলাধুলা করতে মাঠে-ময়দানে নয়, এখন ছুটে যায় তার পড়ার ঘরে দরজা বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে কম্পিউটারে গেম খেলতে, আর না হয় ফেসবুকে ডুবে যেতে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ‘চ্যাটিং’ করে কাটিয়ে দেয়াটাও একটা বড় বিনোদন। আর যারা একেবারে শিশু, তারা টিভিতে তাদের প্রিয় চ্যানেল ঘুরিয়ে টিভি দখল করে বসে থাকে। এটা হচ্ছে হাল আমলের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পরিবারের চিত্র। এদের কোন কোন কিশোর আবার বেপথেও পা বাড়ায়। আর যারা গরিব, নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলে, তারা সহজেই মাদক, ছিনতাই ইত্যাদির অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়ে। তারা যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেখানে নানাবিধ অপকর্মে জড়িত না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। বর্তমানের নাগরিক জীবনে নানাবিধ চাহিদার চাপে পাঠাগার অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। এখন রাজধানী ও বড় বড় শহরের বড় বড় লাইব্রেরি ব্যতীত মফস্বল শহরের ব্যক্তি-উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত পাঠাগারগুলোর দেখা পাওয়াই দুষ্কর। আগ্রহ ও উদ্যোগের অভাবে সেই ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তানী আমলের পাঠাগারগুলোর বেশির ভাগই হয় উঠে গেছে আর না হয় সাইনবোর্ড সর্বস্ব। মানুষের জীবন আগের মতো এখন আর আয়েসি নেই; মানুষ এখন জীবনধারণের জন্য নানা ধান্দায় উদয়াস্ত ব্যস্ত থাকে। এখন পাঠাগার স্থাপন বা পরিচালনার মতো ‘অর্থহীন’ ব্যাপারে সময় না দিয়ে বরং রাজনীতির মতো ‘অর্থকরী’ বিষয়ে সময় দিতে বেশি উৎসাহী তারা। এখন জ্ঞান আহরণ গৌণ, অর্থোপার্জন মুখ্য এবং মোক্ষ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে। বিগত দিনে এ দেশে অনেক ক্রীড়াবিদ ছিল, এখনও আছে। আমরা জানি সাঁতারে যিনি ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি ব্রজেন দাস। তিনি নিজেই একটি ইতিহাস। একাগ্রতা এবং নিষ্ঠার কারণে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। উচ্চাকাক্সক্ষার কারণে তিনি এগিয়ে যেতে পেরেছেন। আরও একজন খেলোয়াড় সুনাম অর্জন করেছেন, তিনি ফুটবলের কৃতী পুরুষ যাদুকর সামাদ। তিনি অপূর্ব কৌশলে গোল করতেন। এই খেলোয়াড় বাল্যকালে এতটাই ফুটবলপ্রেমী ছিলেন যে, সব সময় রাবারের একটি বল সঙ্গে রাখতেন। শুধু এই দুজনই নয়, ক্রীড়া জগতে সুনাম অর্জন করেছেন আরও অনেকে তাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আবাসিক এলাকাগুলোতে খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই, থাকলেও পর্যাপ্ত নয়। একেকটা বাসা-বাড়ি যেন চারদিকে গ্রীল দেয়া একেকটি জেলখানা। এটা শিশুদের প্রতি বড় অন্যায়। প্রতিটি আবাসিক এলাকায় শিশু-কিশোরের মানসিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ অপরিহার্য। এতে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন গড়তে সহজ হবে। এ কার্যক্রমের ফলে শুধু ক্রীড়াবিদ নয়, যোগ্য প্রতিভাবান মানুষে দেশ ভরে যাবে। [email protected]
×