ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সবকিছুরই দাম বাড়ে, বাড়ে না চামড়ার

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২৭ আগস্ট ২০১৮

সবকিছুরই দাম বাড়ে, বাড়ে না চামড়ার

হাসান নাসির ॥ সবকিছুরই দাম বাড়ে। এমনকি চামড়াজাত পণ্যের মূল্যও উর্ধমুখী। কিন্তু বাড়ে না শুধু কাঁচা চামড়ার দর। বরং প্রতিবছরই চামড়ার দাম কমছে। বিগত পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছর রীতিমতো ধস নেমেছে। মাঠ পর্যায়ে চামড়া কেনায় আগ্রহ দেখা যায়নি মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কোরবানিদাতারা আগে যেখানে দর কষাকষি করে একটু বেশি দাম পাওয়ার চেষ্টা করতেন, এবার তার বিপরীত চিত্র। চামড়া গছিয়ে দিতে পারলেই যেন মুক্তি। আড়তদাররা বলছেন, আগের বছরের চামড়া এখনও অবিক্রিত রয়ে গেছে, এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণও যথেষ্ট নয়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে দেশে চামড়া শিল্পের অগ্রযাত্রা নিয়েও। তবে কি এত বেশি চামড়ার চাহিদা দেশে নেই ? যদি তাই হয়, তাহলে ভবিষ্যতে চামড়ার দাম নামতে নামতে কোন পর্যায়ে ঠেকবে ? সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পের অগ্রযাত্রাও বেশ ভালভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রতিবছর চামড়ার দাম শুধু কমছেই। কোরবানি ঈদের আগেই উঠে আসে নানা অজুহাত। পাঁচ বছর আগেও যেখানে প্রতিপিস গরুর চামড়া ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে, তা কমতে কমতে ২০১৮ সালে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা। চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন মাঠ পর্যায়ের স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ক্রেতা পাওয়া যাবে কি না সংশয় দেখা দিয়েছে। এ বছরও চামড়া বিক্রি করতে না পেরে অনেক কোরবানিদাতা নিজ অর্থে রিক্সা বা ভ্যান ভাড়া দিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চামড়া পৌঁছে দিয়েছেন, এমন তথ্য রয়েছে। সেক্ষেত্রে চামড়া নিয়ে ভবিষ্যতে বিপাকে পড়তে পারেন কোরবানিদাতারাও। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারিত হয়েছিল ঢাকায় ৮৫ থেকে ৯০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। ২০১৪ সালে দাম নির্ধারিত হয় ঢাকায় ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় এবং ঢাকার বাইরে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। ২০১৫ সালে ঢাকায় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। ২০১৬ সালে প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য ছিল গড়ে ৫০ টাকা। ২০১৭ সালে চামড়ার মূল্য নির্ধারিত হয় ঢাকায় প্রতি বর্র্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে চামড়ার মূল্য আরও কম। যে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে সেই মূল্যেও চামড়া বিক্রি করতে পারেনি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কাঁচা চামড়ার দাম আর কত কমবে ? বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জানান, দেশে ট্যানারির সংখ্যা ১৫৫টি। এরমধ্যে উৎপাদনে রয়েছে ১১৪টি। কিন্তু এক্ষেত্রেও রয়েছে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি হস্তান্তর নিয়ে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা। এ বিষয়টিও শিল্পের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে। তিনি জানান, প্রতিবছর কোরবানির ঈদে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ গরুর চামড়া সংগৃহীত হয়ে থাকে। ছাগল ও ভেড়ার চামড়া সংগৃহীত হয় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ। কোরবানিতে সংগ্রহ হয় মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ। কাঁচা চামড়ার মূল্য দিন দিন কমতির দিকে কেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। বর্তমানে বিশ্বে চামড়ার বাজার ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এরমধ্যে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের, যা মোট বাজারের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। চামড়াজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ সুসংহত অবস্থা ভারত, পাকিস্তান এবং তুরস্কের। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারে নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ, যার ৯০ ভাগই গো-মাংস ভক্ষণে অভ্যস্ত। কোরবানির ঈদে বিপুলসংখ্যক পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়ে থাকে। সে হিসেবে এ দেশের চামড়া শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে যে পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব, সেটিও ঠিকমতো সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। চট্টগ্রামের আড়তদাররা জানান, এবার কোরবানির চামড়া সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ লাখ ৫০ হাজার পিস। এর মধ্যে ৫ লাখ পিস চামড়া ইতোমধ্যে সংগৃহীত হয়েছে। গতবছর চামড়া সংগৃহীত হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার পিস। জেলায় এক সময় ১০-১২টি ট্যানারি থাকলেও এখন একটিও নেই। ফলে এই চামড়া বিক্রির জন্য তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ঢাকার ট্যানারিগুলোর ওপর। কিন্তু সাভারে ট্যানারি হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা এবং হাজারীবাগে চামড়া সংরক্ষণে নিষেধাজ্ঞা জনিত কারণে সংগৃহীত এই চামড়া তারা কবে নাগাদ বিক্রি করতে পারবেন তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
×