নিখিল মানখিন ॥ বেসরকারী কোম্পানিগুলোর ওষুধের মূল্য নির্ধারণের পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা সরকারের হাতে নেই। দেশের বিভিন্ন প্রকারের প্রায় ২৮ হাজার ওষুধের মধ্যে মাত্র ১১৭টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। ফলে ওষুধ কোম্পানি, পাইকারি ও খুচরা বাজারের চিত্র প্রায় একই রকমের। পরিস্থিতি এমন যে ওষুধের বাজারে এখন লাগামহীন উর্ধগতি। বেড়েছে সব স্তরের নিত্যপ্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম। প্রতি মাসেই যেন দাম বাড়ে। এলাকা বিশেষে একই ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দামে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস ওঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ওষুধের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে একটি আদেশ জারি হয়। ওই আদেশে ১১৭টি ওষুধের মূল্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর নিয়ন্ত্রণ করবে এবং অন্যান্য ওষুধ নিজ নিজ কোম্পানি নির্ধারণ করবে বলে উল্লেখ রয়েছে। তারপর থেকেই কোম্পানিগুলো নিজ নিজ ওষুধের মূল্য তালিকা ওষুধ প্রশাসনে জমা দেয়। মালিকপক্ষের মূল্য তালিকা কমানো বা বাড়ানোর ক্ষমতা অধিদফতরের নেই। তারা শুধু বিভিন্ন কোম্পানির জমা দেয়া মূল্য তালিকার মধ্যে সামঞ্জস্যতা তৈরি করেন। মূল্য নির্ধারণী গেজেট প্রকাশ না করার কারণে এক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানির মালিকপক্ষ ও অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মধ্যে সুবিধা বিনিময়ের সুযোগ রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ উঠেছে, প্রায় দেড় দশক ধরে ওষুধের মূল্য নির্ধারণী গেজেট প্রকাশ করছে না ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। এ সুযোগে ওষুধ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো ওষুধের দাম নিচ্ছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছে রোগীরা। কারণ তারা চড়া দামে ওষুধ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ দেশের ওষুধের বাজার দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর উৎপাদনে আসছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে বাড়ছে ওষুধের সংখ্যাও। অথচ আইনী বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ওষুধের মূল্য নির্ধারণে অনেক বছর ধরে গেজেট প্রকাশে গড়িমসি করছে। ওষুধ প্রশাসন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ১১ ধারার ১ উপধারা মতে, যে কোন ওষুধের বিক্রয় মূল্য সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করবে। একই ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, আমদানিকৃত কাঁচামালের দামের নিরিখে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু দেশে ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সর্বশেষ গেজেট প্রকাশ হয়েছিল ২০০০ সালে। আর দীর্ঘ দেড় দশক ধরে ওষুধের মূল্য নির্ধারণী গেজেট প্রকাশ না হওয়ায় ওষুধ কোম্পানিগুলো তার অনৈতিক সুযোগ নিচ্ছে। বিভিন্ন সময় নিজেদের খেয়ালখুশি মতো তারা ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওষুধের মূল্য নির্ধারণী গেজেট প্রকাশ প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন প্রকারের প্রায় ২৮ হাজার ওষুধ রয়েছে। কিন্তু ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর মাত্র ১১৭টি ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। স্বল্পসংখ্যক ওষুধের কারণেই গেজেট প্রকাশ করা হচ্ছে না।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের আরেক পরিচালক রুহুল আমিন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, পুরনো আদেশের কারণে ১১৭টি ছাড়া বাকি ওষুধগুলোর মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নেই। অন্যান্য ওষুধ নিজ নিজ কোম্পানি নির্ধারণ করে থাকে। কোম্পানিগুলো নিজ নিজ ওষুধের মূল্য তালিকা ওষুধ প্রশাসনে জমা দেয়। মালিকপক্ষের মূল্য তালিকা কমানো বা বাড়ানোর ক্ষমতা অধিদফতরের নেই। তারা শুধু বিভিন্ন কোম্পানির জমা দেয়া মূল্য তালিকাসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্যতা তৈরি করেন বলে জানান রুহুল আমিন।
এদিকে, সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সারাদেশেই নানা অজুহাতে বেড়েছে ওষুধের দাম। বিশেষ করে খুচরা বাজারে মূল্য বৃদ্ধির মাত্রা যেন বেশি। খুচরা বিক্রেতারা নিজেদের মতো করে দাম নির্ধারণ করে থাকে। ওষুধ বিক্রেতাদের মুখের কথাই যেন ওষুধের নির্ধারিত দাম। পাইকারী বাজার থেকে কিছুটা ছাড় পান খুচরা ব্যবসায়ীরা। আবার পাইকারি ব্যবসায়ীরাও ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন পান। কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা কোন কমিশন দেন না।
ঘন ঘন মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৪ সালের এক নির্দেশনার কারণেই ওষুধের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধিতে হস্তক্ষেপের ক্ষমতা হারিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জীবন রক্ষাকারী অত্যাবশ্যকীয় ১১৭টি ওষুধের ন্যূনতম ৬০ শতাংশ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো অন্যান্য ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জনকণ্ঠকে জানান, ২০০৯ সালে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় ২০৯টি ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ- অনুযায়ী ওই তালিকায় ২৫৬টি ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখনও ওই তালিকা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাংলাদেশ কেমিস্ট এ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির উপ-সচিব মনির হোসেন বলেন, বাংলাদেশের ছোট-বড় কোন ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিই অত্যাবশ্যকীয় এই ওষুধগুলোর ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে না। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাভুক্ত অনেকগুলোই বাজারে পাওয়া যায় না। কোম্পানিগুলো কাগজে-কলমে দেখিয়ে দেয় যে, তারা ৬০ শতাংশের বেশি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ উৎপাদন করছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পর্যবেক্ষণের অভাব এবং সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের কারণে অনিয়ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো।
