ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাফিক সপ্তাহে ঢাকায় প্রায় ৪৪ হাজার মামলা ॥ কঠোর আইন প্রয়োগের পরামর্শ

সড়কের লাটভাইরা চলেন বেপরোয়া, ভ্রুক্ষেপ নেই কানুনে!

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৬ আগস্ট ২০১৮

  সড়কের লাটভাইরা চলেন বেপরোয়া, ভ্রুক্ষেপ  নেই কানুনে!

রাজন ভট্টাচার্য ॥ অনেকে বলেন সড়কের লাটভাই। অনেকে বলেন রাজা। দুটো ছদ্মনামের প্রকৃত নাম হলো ‘মোটরসাইকেল’। অর্থাৎ আইন না মেনে চলা, আর বেপরোয়া গতির কারণেই লাটভাই হিসেবে পরিবহনটির চালকরা এখন সর্বত্র পরিচিত। পুলিশের প্রতিবেদনেও মোটরসাইকেল চালকদের বিরুদ্ধে আইন না মেনে চলার ভয়াবহ চিত্র ওঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক আইন যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কারণেই চালকরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে কাবু করতে দলীয়সহ নানা পরিচয় ঝুলিয়ে রাখা হয় মোটরসাইকেলে! পুলিশ বলছে, সম্প্রতি শেষ হওয়া ১০ দিনের ট্রাফিক সপ্তাহে ঢাকায় সর্বোচ্চ সংখ্যক ৪৩ হাজার ৮৬৩টি মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। উল্টোপথে গাড়ি চলাচলের কারণে মামলা হয়েছে সাত হাজার ৯১৫টি। এবারের ১০ দিনের ট্রাফিক সপ্তাহে মোট মামলার সংখ্যা ৮৮ হাজারের বেশি। জরিমানার পরিমাণ পাঁচ কোটি ১০ লাখ ৯৬ হাজার ২৭৭ টাকা। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ২২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি। আর রাজধানীতে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা চার লাখ ৯৪ হাজার ৯৫৭টি। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশসহ পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইনজীবী, পুলিশ, সাংবাদিক, ছাত্রলীগ, ডাক্তার, সাবেক ছাত্রনেতা, মানবাধিকার কর্মী, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নাম ব্যবহার করে স্টিকার লাগানো থাকে মোটরসাইকেলের সামনে ও পেছনে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পরিচিতি লিখে রাজধানীসহ সারাদেশে মোটরসাইকেল চলছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গাড়ির কোন কাগজপত্র না থাকার কারণেই এসব স্টিকার ব্যবহার করা হয়। মূলত প্রভাব বিস্তার করার মানসিকতা থেকেই এসব স্টিকার লাগানোর কথা বলছেন তারা। তবে সম্প্রতি পুলিশী তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে স্টিকার ব্যবহার কমেছে। তাছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে মোটরসাইকেলে স্টিকার না লাগানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। রাজধানীর মতিঝিল জোনে ট্রাফিক পুলিশে দায়িত্বরত লিটন চৌধুরী জানান, সবচেয়ে বেশি আইন অমান্য করে চলে মোটরসাইকেল। সিগন্যাল দিলেও বেপরোয়া গতিতে রাস্তা পারাপারের দৃশ্য সব সময় দেখা যায়। সিগন্যাল কিংবা যানজট থাকলে ফুটপাথ দিয়ে অনবরত মোটরসাইকেল চলে। আমরা চাই সবাই আইন মেনে পথ চলুক। তাহলে গোটা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার চিত্র পাল্টে যাবে। কমবে যানজট। তিনি জানান, আইন অমান্যকারী চালকদের সিগন্যাল দিলেও দাঁড়াতে চান না। বেপরোয়া গতিতে চলে যায় অনেকে। আবার প্রভাব বিস্তার করে অপরাধ থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টাও আছে অনেকের। এরকম মানসিকতা থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি। গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বেপরোয়া দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে চাপায় পড়ে দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন যানবাহনের লাইসেন্স পরীক্ষা করতে শুরু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এ সময় বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুরও হয়। গোটা এক সপ্তাহ কার্যত অচল হয়ে যায় রাজধানী। এমন বাস্তবতায় ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন ও সড়কে শৃঙ্খলা আনার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এর পর পরই সারাদেশে ১০ দিনব্যাপী ট্রাফিক সপ্তাহ-২০১৮ ঘোষণা দেয়া হয়। সেইসঙ্গে পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে চালক ও গাড়ির লাইসেন্স, ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া বাস চলতে না দেয়ার ঘোষণা আসে। গঠন করা হয় মালিক-শ্রমিক সমন্বয়ে ভিজিলেন্স টিম। পুলিশের পাশাপাশি টার্মিনালসহ বিভিন্ন সড়কে এই টিম অভিযান চালায়। কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি চলাচল আটকে দেয়া হয়। আইনভঙ্গে শীর্ষে মোটরসাইকেল ॥ ঢাকা মহানগরসহ দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হয় ৫ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। ১০ দিনে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মোট মামলার মধ্যে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে বাসের বিরুদ্ধে ১৩ হাজার ৯৩টি, ট্রাকের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৮৪৮টি, কাভার্ড ভ্যানের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৯২৫টি, পিকআপের বিরুদ্ধে ৬ হাজার ৬৩০টি, সিএনজির বিরুদ্ধে ৬ হাজার ৪২৩টি, মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে ৪৩ হাজার ৮৬৩টি, প্রাইভেটকারের বিরুদ্ধে ৮ হাজার ৪৯৭টি, মাইক্রোবাসের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৭২৮টি, লেগুনার বিরুদ্ধে ৯৬১টি এবং অন্যান্য ১৩ হাজার ২৫টি মামলা করা হয়। অভিযানে ডাম্পিং ও রেকারিং করা হয়েছে নয় হাজার ৭৭০টি গাড়ি। মামলা হয়েছে ১৯ হাজার চালকের বিরুদ্ধে। ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গাড়ির ফিটনেস, উল্টোপথে গাড়ি চালানো, গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা, হুটার ও বিকন লাইট ব্যবহার এবং মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস ব্যবহার করার জন্য উল্লেখিত মামলা করা হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গবর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিটের সভায় ‘ঢাকা শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সভায় নিরাপদ সড়ক ও মহাসড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগকে চলমান কার্যক্রমের ওপর বিভিন্ন দিক নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থাপনার এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে ২০ আগস্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বিআরটিএ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব দেয়া হয়। সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছে। তবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। ১৮ আগস্ট ট্রাফিক ব্যবস্থার ত্রুটি খুঁজতে রাস্তায় নেমেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। তারা রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট পরিদর্শন করেন। কথা বলেন পথচারীসহ কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে। পথচারীদের রাস্তা পারাপারে ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো উঠে আসে তাদের পর্যবেক্ষণে। শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিআরটিএ, ডিটিসিএ, রাজউক, ট্রাফিক বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মোঃ নজিবুর রহমান। বিআরটিএ সচিব শওকত আলী বলেন, মোটরসাইকেলে দুইজন আরোহীর প্রত্যেকের হেলমেট বাধ্যতামূলক। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো যাবে না। এই আদেশ যারা অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, যে কোন মূল্যে সড়ককে নিরাপদ রাখতে হবে। মানুষ আইন মানলেই সড়ক অনেকটা নিরাপদ হয়ে যাবে। তাছাড়া পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর নতুন নতুন প্রযুক্তি ও নিয়মের বাস্তবায়ন জরুরী বলেও মনে করেন তিনি। সমন্বয় কমিটি গঠন ॥ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সার্বিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মনিটরিং করার জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসানকে প্রধান করে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি গৃহীত সিদ্ধান্ত কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে তা তদারকি করবে। সমন্বয় কমিটির সঙ্গে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, গণপূর্ত, ডিটিসিএ, রাজউক, বিআরটিএ, ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। নজিবুর রহমান জানান, আগামী একমাস পর আবারো দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে চলমান সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হয়েছে তা পর্যালোচনা করা হবে। তিনি বলেন, ২০ তারিখ থেকেই আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্বল্প মেয়াদী যেসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব তা বাস্তবায়ন শুরু হবে। কেউ যেন কোন কাজে গাফিলতি না দেখান। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে আশাকরি রাজধানীর চেহারা বদলে যাবে। মোটরসাইকেলে সবচেয়ে বেশি আইন না মানার কারণ জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ট্রাফিক আইন যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে মোটরসাইকেল চালকদের সবচেয়ে বেশি আইন না মানার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া ঢাকায় যান্ত্রিক যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মোটরসাইকেল। তাই আইন ভঙ্গের মাত্রাও বেশি। কঠোরভাবে ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, দল ও মত নির্বিশেষে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। মোটরসাইকেলে দুই জনের বেশি আরোহী নয়। সবার হেলমেট বাধ্যতামূলক এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন জরুরী। পাশাপাশি লাইসেন্স ছাড়া চালক ও গাড়ির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরী বলেও মনে করেন তিনি।
×