ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে দেড় কোটিরও বেশি শিশু শ্রমিক- সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ২৬ আগস্ট ২০১৮

 দেশে দেড় কোটিরও বেশি শিশু শ্রমিক- সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই

সমুদ্র হক ॥ মাঝারি যানবাহন লেগুনা (হিউমেন হলার) ছোট যানবাহন টেম্পোর বেশিরভাগ কন্ডাক্টর শিশু। চলন্ত অবস্থায় ঝুঁকির মধ্যে তারা যাত্রীদের ভাড়া আদায় করে। সাংকেতিক থাবায় গাড়ির চালকের মনযোগ আকর্ষণ করে গাড়ি থামানো ও গতির কম বেশি করে। এমন দৃশ্য ঢাকা মহানগরীসহ দেশের সব নগরীতেই চোখে পড়ে। দৃশ্যপট-২. অনেক শিশু শ্রমিক লেদ মেশিন ও মাঝারি কারখানার চাকার কাছে কাজ করে। দৃশ্যপট-৩. বিড়ি ফ্যাক্টরিগুলোর শ্রমিকের বড় একটি অংশ নারী ও শিশু। তারা প্রতিদিন বিষাক্ত তামাক পাতা হাতে নিয়ে কাজ করে। এর বাইরে শহরের ফেলে দেয়া জিনিপত্র কুড়ানোসহ নানা ধরনের কাজ করছে শিশু। পরিসংখ্যান বিভাগের জরিপে দেশে মোট শিশুর সংখ্যা অন্তত সাড়ে ৫ কোটি। এর মধ্যে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। জাতিসংঘ সনদে শিশুর সংজ্ঞা ১৮ বছরের নিচের বয়সীরা শিশু। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশু শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। শ্রম ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের নারী ও শিশু শ্রম শাখার সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রতিটি জেলায় ‘জেলা শিশুশ্রম পরিবীক্ষণ কমিটি’ থাকবে। ২৪ সদস্যের এই কমিটির উপদেষ্টা স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং সভাপতি জেলা প্রশাসক। কমিটি নিজ নিজ জেলার শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। এর বাইরে বাংলাদেশ শ্রম আইনে শিশুশ্রম বন্ধে আইন রয়েছে। শ্রম আদালতের আইনে অপরাধীদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- ও অর্থদ-ের বিধান আছে। এক জরিপে বলা হয়েছে, শিশু শ্রমিকের ৯৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। যার বেশিরভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। মাত্র ৬ শতাংশ শিশু শ্রমিক কাজ করছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। শিশু শ্রমিকরা মোট ৪৭ ধরনের কাজ করে। যে কাজের অনেকগুলোই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। দারিদ্রতা, পারিবারিক বিচ্ছেদ, বাবা মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ, বাবা মায়ের পেশা, মা বাবা ও অভিভাবকের মৃত্যু, অনাকর্ষণীয় শিক্ষাসহ ২৫টিরও বেশি কারণে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে দারিদ্রতার হার কমানোর ক্ষেত্রে শিশুশ্রমের রোজগারও বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে মহানগরী ও বড় নগরীগুলোতে যে বস্তি গড়ে উঠছে সেখানকার শিশুদের বড় একটি অংশ নিয়োজিত হয় নানা শ্রমে। নগরীর পথশিশুরা দোকান ও কোন প্রতিষ্ঠানের ফুট ফরমায়েশ খাটাসহ নানা ধরনের কাজ করে। আবার গ্রামে হতদরিদ্র পরিবারের শিশুকেও পরিবারের আয় বাড়াতে রোজগারের পথে নামতে হয়। তারা চলে যায় রাজধানী ঢাকাসহ বড় নগরী ও শহরগুলোতে। এদিকে গ্রামে কৃষির বহুমুখী কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশুদের কাজ করতে হয়। এতে মজুরির খরচ অনেকটা বেচে যায়। কৃষির শিশু শ্রমিকের একটি অংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কোন রকমে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অতিক্রমের পর মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করতে পারে না। এই শিশুদের বেছে নিতে হয় কোন না কোন কাজ। আবার মেয়ে শিশুদের অনেককে প্রাথমিক পাঠ শেষ করে মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশের পর মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। যদিও বাল্যবিয়ের হার কমে আসছে তারপরও এখনও শূন্যের কোটায় পৌঁছেনি। এই মেয়ে শিশুদেরও ঘর গৃহস্থালির কাজসহ কৃষি কাজ করতে হয়। এক জরিপে বলা হয়, দেশে মোট শিশু শ্রমিকের ৬৬ শতাংশ কৃষিতে, ১৮ শতাংশ শিল্প খাতে, ৪ শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১২ শতাংশ গৃহভৃত্য অন্যান্য খাতে কর্মরত আছে। সম্প্রতি বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও সিরাজগঞ্জ জেলা নিয়ে গঠিত বগুড়া অঞ্চলিক শ্রম দফতরের কর্মকর্তা বলেন, শিশু শ্রম বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। তারপরও জটিল কিছু কারণে শিশুশ্রম একেবারে বন্ধ করা যায় না। দেশের শ্রম আইনে বলা আছে, কোন পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোন শিশুকে নিয়োগ করে কাজ করতে দেয়া যাবে না। কাজে নিয়োগের পর শিশু না কিশোর এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হলে জন্ম নিবন্ধন সনদ, স্কুল সার্টিফিকেট বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হবে। কোন অভিভাবক তার কিশোর ছেলেকে কাজের জন্য অনুরোধ করলে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কিশোরকে পরীক্ষা করে তার সক্ষমতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেবেন। সরকার সময়ে সময়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা ঘোষণা করবে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কোনভাবেই শিশু নিয়োগ করা যাবে না। কোন কিশোরকে কোন কারখানায় দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। কোন কিশোরকে কোন প্রতিষ্ঠানে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যবর্তী সময়ে কোন কাজ করানো যাবে না। তবে এর মধ্যেও কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের স্বার্থে শিশু শ্রমিক নিয়োগে ব্যত্যয় রাখা হয়েছে। শ্রম আইনের ৪৪ ধারায় বলা হয়েছে, বারো বছরের কোন শিশুকে এমন কিছু হালকা কাজে নিয়োগ করা যাবে যাতে শিশু স্বাস্থ্য ও উন্নতির জন্য বিপজ্জনক নয় এবং শিক্ষা গ্রহণে বিঘ্নিত হবে না। খোঁজ খবর করে জানা যায় মাঠ পর্যায়ে এই ধারাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে শিশু শ্রমিককে কাজে নেয়া হচ্ছে। এদিকে শিশু শ্রমিকদের একটি অংশকে কাজে লাগায় অপরাধী চক্র। পুলিশের এক সূত্র জানায়, অবৈধ মাদক কারবারিরা অনেক সময় মাদক পারাপারে শিশুদের ব্যবহার করে। এরা ধরা পরার পর প্রকৃত অপরাধীর নাম বলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত এরা পরিণত হয় কিশোর অপরাধী হিসেবে। জুভিনাইল ধারায় এদের পাঠানো কিশোর অপরাধ সংশোধনাগারে। পরিবেশ ও জীবন বিপন্নের অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে শিশু। বিশেষ করে বিড়ি ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের বড় একটি অংশ নারী ও শিশু। এই শিশুদের বেশিরভাগই অল্প বয়সে কঠিন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এদের আয়ুষ্কাল কমে যায়। ব্যাধির কারণে শারীরিক গঠনেও বাধাপ্রাপ্ত হয়। এদের কেউ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে।
×